হাজং যাপনে পাখি

By Published On: May 11, 2025Views: 60

হাজং যাপনে পাখি
জ্যোতি পোদ্দার

উঠান জুড়ে পাকা আমনের মাতাল করা গন্ধ।শেষ বিকালের স্বর্ণকেশী রোদ চিকচিক করে ঝলকে ঝলকে পড়ছে এখানে সেখানে। উঠানে মেলে দেয়া ধান পায়ের আঁচড়ে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে কালাইমণি হাজং।বড় কাঁঠাল গাছের নিচে আমরা কয়েকজন মুখোমুখি বসে নানা কথার ভারে জমে উঠেছে তখন আড্ডা। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও কালাইমণি এখনও কর্মঠ। ধুলায় সাদা হয়ে ওঠা দুই পা উঠানের এককোণে
একটু ঝাঁকিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

এই উত্তর জনপদ হাজং ও মারগান কোচের জনপদ।এখন সংখ্যায় স্বল্প হলেও তাদের যাপনে রয়ে গেছে নানা গল্প নানা কাহিনি নানা কিরছা।এই যেমন পাখি নিয়ে নানা গল্প। জীবনের পরতে পরতে গেঁথে থাকা এই গল্প। কালের দাপটে ক্ষয়ে গেছে বেশির ভাগ। বিশ্বাস নড়ে গেছে। কেচ্ছা হয়ে সংস্কার হয়ে রয়ে গেছে তাদের স্মৃতিতে পুরাণে।ধর্মালোচনায়।নেই শুধু প্রাত্যহিক যাপনে।একদিন যে গল্প জীবনের ভেতর থেকে জীবন্ত অনুষঙ্গ হয়ে জীবনকে রাঙিয়েছে সময়ের পালা বদলেই সেই অনুষঙ্গের প্রাসঙ্গিতা হারায়।গতিমানতা হারায়।অর্থ দ্যোতকতা লোপ পায়। থেকে যায় গল্পের খোলস—ভাঙা খোলস।তার ভেতরই জমে কালের ধুলা।প্রকৃতপক্ষে কোন গল্পই জীবনের বাইরে নয়।জীবনের নিরিখে জীবন ছুঁয়ে নির্মিত হয় গল্পের বুনন হয়—যেমনটি সুতা দিয়ে শাড়ি।
সময়ের চালচিত্র পাল্টে গেলে পাখি উড়ে গিয়ে থাকে শুধুছায়া আবছায়ার মতো বিশ্বাস অবিশ্বাসের নড়বড়ে গাঁথা।

এই বিকালের গল্পের আসরে বৃদ্ধ বীরেন্দ্র হাজং স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে তুলে আনলেন টুকরো টাকরা গল্পের না-ফোটা গল্পের মুখ।যা ছিল একদিন জীবনের প্রতি পলে পলে দেখা পুনদেখার পরীক্ষিত ফলাফল তাই এখন কুসংস্কার।

যেমনটি বীরেন্দ্র হাজং পরম্পরায় জেনেছে ‘নিশিকালে দাঁড়কাকের কা কা মৃত্যু সংবাদ বয়ে আনে।” নিজেও দেখেছে।হোক সে পরিবার বা সমাজে অথবা দেশকালের কোন আপদ বিপদের বার্তা। সন্ধ্যায় কাক ঘরে ফিরে—রাত গভীরে কাকের কর্কশ আর্তচিৎকার অমঙ্গল ডেকে আনে। ব্রজেন্দ্র হাজং বললেন, শুধু কি কাক? প্রহরে প্রহরে প্যাঁচার তার স্বরে চিৎকারে ছড়ায় রোগ ব্যাধির নানা আলাই বালাই। হুতুম প্যাঁচার ডাকে মন উচাটন হয়। ব্যথিত হয় পড়ে মন। ব্রজেন্দ্র এমন ভাবে বলে যেন এখনই শুনছে কোন কালরাতের প্যাঁচার ডাক।

যাকে আমরা রাঙা চেগা বলে চিনি হাজং বিষ্ণু চেনে আলি কঙ নামে।সেইও গাওবুড়োদের মুখে শুনেছে জমির নামায় আলি কঙ ডাকলে বৃষ্টিবাদলে ভাসে ঘরদোর জল জমি জঙ্গল।আর যদি জমির কান্দায় বসে ডাকে আলি কঙ ভর শ্রাবণেও চরাচর থাকে খটখটা খট শক্ত জমির হা-করা মুখ।এই দেখাদেখি পরম্পরা দেখাদেখি। বারবার দেখাদেখির রাঙা চেগার উপস্থিতি আর প্রকৃতির খড়া বৃষ্টির এক সূতায় গাঁথা বুনন নিয়েই হাজঙের যাপন।

ঘরের অতিথি সাদা ছাইরঙা কবুতরও হাজং পরিবারের নানা ধর্মিক অনুষ্ঠানে জড়িয়ে রয়েছে।হোক সে বাস্তুপূজা বা শীতলা বা কালি পূজা। লাল সিদূর মাখা মাটির ঢিপি ফুল জল তুলসি নিবেদনের সাথে সাথে উৎসর্গিত মানতের জোড়া কবুতর গেরস্থ পুরুষ দুই হাতে উড়িয়ে দেয় মুক্ত করে দেয় সংসারের বালাই ষাটের দূর হবে এই বিশ্বাসের মনোবাঞ্ছা নিয়ে।

কালাইমণি হাজং স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনলেন ‘আম চিকলুক ভিকলুকের কিরছা।’ সেই কবে তিনি শুনেছিলেন তার ঠাকুরমার কাছে খুব ছোট্ট বেলায়।হয়ত তার ঠাকমাও শুনেছে তার ঠাকুমার কাছে।এই গল্পগাছা পরম্পরায় গল্প।সামাজিক গল্প।কালাইমণি সত্তর ছাড়িয়ে গেছে অনেক দিন হলো।সব কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। অসমাপ্ত বাক্য ঝুলে থাকে পান খাওয়া দাঁতপরা ঠোঁটের কোণে। স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে অল্প কথায় স্বল্প কিরছা শুনিয়ে দিলেন তিনি।বেনে বৌয়ের কিরছা—চিকলুক ভিকলুকের কিরছা।

কোন এক কালে সলাজ এক নতুন বৌ ঘোমটা বুক বরাবর টেনে স্বামীর হাত ধরে এলেন গৃহলক্ষ্মী হয়ে গেরস্থের ঘরে।নতুন বৌ নতুন ঘরের নতুন মানুষ।চঞ্চলামতি বালিকা বধু। বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে সব কথা কি আর শাশুড়িকে বলতে পারে? পারে না।বালিকার চঞ্চলতা আর আবদার যেমন মায়ের কাছে করেছিল বাপের ঘরে।তেমনি বৌ হয়ে এলে কী হবে নতুন মা শাশুড়ির কাছেই তার নানা আবদারের বায়না।
নানা আহ্লাদ।

বালিকা বধু এবার পণ করেছে সে আমটক খাবে।শাশুড়ি মায়ের পেছনে ঘ্যানঘ্যান করছে—তার আমটক চাই-ই।এখন তো আম কাঁঠালেই সময়।গাছে গাছে থোকাথোকা আম ঝুলছে। আমটক খাবারের এই তো সময়।

জৈষ্ঠ্যমাসের কাঁচাপাকা আমের ফালির সাথে হলুদ মরিচ লেবু পাতা ডলে ডলে আমটকের নাম শুনেই তো জিবে জল আসে। শাশুড়ির নানা কাছ ফেলে কালিঝুরি মাখা কড়াইয়ে বেশ খানিকটাই করেছেন আমটক।তা বলে শুধু বালিকা বধুর জন্য নয় পরিবারের সকলের জন্যই তিনি আমটক করেছেন রসিয়ে বসিয়ে রসালো করে।

বালিকা বৌয়ের জিবে জল আর ধরে রাখতে পারে না।লোভের জলে মুখ ভরে ওঠে তার।মা— আমটক হলো মা— আমটক হলো বলতে বলতে নতুন বৌ পাতপেড়ে বসে পড়ে। তার আর তর সয় না।ঠোঁট গলিয়ে জিবের জল পড়ে আর কি? লোভের জল একবার নয় কয়েকবারই গিলে ফেলেছে। কলাপাতার পাতে শাশুড়ি মা কড়াই থেকে কয়েকবার তুলেও দিল আমটক।হাতচেটে টাকরায় শব্দ তুলে চেটেপুটে খেলো কানিকটা।

দুধে আলতা রঙের নতুন বৌয়ের স্বাদ আর সাধ মেটেনা। আরেকটু চাই আমটক।আরেকটু চাই আমটক। এমন রসালো কাঁচা-পাকা আমের হলুদ মরিচের আমটক কি একটুতে সাধ মেটে? মেটে না। আরো চাই। আবারো আরেকটুর জন্য বায়না। দাও না মা।আরেকটু দাও…

শাশুড়ি মা কি আর নিজ মায়ের মতো অবুঝ বালিকার এতো আবদার রাখে? রাখে না। রাখতে পারে না। আরেকবার বধূটি চাইতেই কড়াইরাখা বানানো রসালো আমটক রেগেমেগে শাশুড়ি মা বধূরার মাথায় শরীরের উপুড় করে ঢেলে দেয় সবটুকু আমটক।

আমটকে স্নাত দুধে আলতা রঙের বালিকা বধূর শরীর নিমিষেই  উজ্জ্বল হলুদ রঙে রঙিন হয়ে উঠল আর কড়াইয়ের মাখা কালিঝুলিতে মাথা ও দুই হাত কালোতে চকচক করে উঠতে ‘হোয়াই ইউ…হোয়াই ইউ…সুর ঠোঁটে ঝুঁলিয়ে চোখের পলকে নতুন বৌ বেনে বউ হয়ে কালো মাথা উজ্জ্বল রঙের শরীর নিয়ে উড়ে গেলো উঠানে বেড়ে ওঠা আমগাছের উঁচু ডালে। নতুন বৌ বেনে বৌ হয়ে গাছে গাছে ডালে ডালে উড়ে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে গেয়ে উঠে বাঁশির মতো মিষ্টি সুরে হোয়াই ইউ…হোয়াই ইউ… করে।

এই বেনে বৌ-ই  আমাদের ইষ্টিকুটুম পাখি—অতিথি আসবার আগাম বার্তা বাহক। হাজং যাপনের স্মৃতিতে শ্রুতিতে কিংবা পুরাণে এইসব নানা পাখি বিষয়ক বুনন আছে।ইশারা আছে। কালের দোষে নেই শুধু অর্থদ্যোতকতা।কালাইমণি সেই ছোট্টোকালে ঠাকুমার কাছে শোনা গল্প অল্প হলেও ধরে রেখেছেন। যদিও আজও সংসারে জৈষ্ঠ্যে আমটক করেন—ভরে রাখেন কাঁচের বয়ামে।কালের প্রকোপে আম চিকলুক ভিকলুকের কিরছার খোলস পড়ে আছে অবহেলায় অনাদরে।

4 1 vote
Rating
Subscribe
Notify of
guest

3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments