কবিতাকে লালিত প্রজ্জ্বলিত করতে হলে কাব্যকে জাতীয় হতে হবে। কথাটি বলেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)। কবিরা বিশিষ্ট যে প্রতিফলন তুলে ধরবেন তা হবে মূলত দেশকালপাত্র-উদ্বুদ্ধ। পরিপার্শ্বকে বর্জন করে অন্তর্গত ভাবনা প্রকাশ কখনোই ফলপ্রসু হয় না। তিনি আরো বলেছেন, ‘বস্তুত সঠিকভাবে জাতীয় হতে পারলেই তবে আন্তর্জাতিক শীর্ষগুণগুলো সহজেই আমরা আত্মস্থ করতে পারব, স্ব-স্বরূপ অবিকৃত ও অব্যাহত এবং মর্যাদাসম্পন্ন রেখে ব্যবহার করতে পারব, অনাবিল সচ্ছল প্রগতিতে।… কাব্যের কল্পতরুকে শেষ পর্যন্ত স্বদেশের মাটিতেই বুনতে হয়। তবেই তা আন্তদেশে পল্লবীত হতে পারে।’ সে ক্ষেত্রে নিরাসক্ত দৃষ্টি দিয়েও অতীতের দিকে তাকানো সম্ভব। এই অতীতের পরম্পরায় অনেকেই রয়েছেন, রয়েছেন কল্লোল যুগের বা তিরিশের কবিরা। তবে উল্লেখযোগ্যভাবে কয়েকজনের নাম উচ্চারিত হতে পারে। তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। উপরোক্ত কবিদের দুরূহতা এবং সাম্প্রতিক কাব্যের দূরপরায়ণ এক নয়। দেশজ রসভিত্তির উপর তাদের কবিতার আস্থা ছিল। বর্তমান কৃত্রিমতা ও অতিনাটকীয়তা কবিতার স্বাভাবিকতাকে কঠিন এবং জটিল পথে নিয়ে যাচ্ছে। কবিতায় কি আন্তরিকতার অভাব রয়েছে! আট এবং নয় দশকের কবিতা বা উনিশ শতকের শেষ দশকের কবিরা রয়ে গেছেন বর্তমান শতক ও পূর্বসূরীদের মধ্যবর্তী অবস্থানে। এক্ষেত্রে সার্বজনীন হওয়ার যোগ্যতা সামগ্রিকভাবে অনেক কমে এসেছে। কেননা কেবল ব্যক্তিগত প্রতিনিধিত্ব হয়ে উঠে এসে অন্যের বোধের প্রতিনিধিত্ব হারিয়েছে একুশ শতক। সেই শতকেই প্রবেশ আট ও নয়-এর দশকের কবিদের। কতটা নতুনকে গ্রহণ করেছে আর কতটা আতীতকে বর্জন করেছে এর মূল্যায়ন রয়েছে তাদেরই কবিতায়। আট-এর দশকের কবিতা বর্তমান সময়েপ্রবেশ করে বা বলাযায় একুশ শতকে প্রবেশ করে দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের প্রথাগত লালিত আঙ্গিক বা প্যাটার্ন বর্জন করবে না একুশ শতকের ফাঁপা জটিল ফর্মগ্রহণ করবে! তারা না পারছে পরম্পরা থেকে গৃহীত চেতনাকে পরিহার করতে, না পারছে যুগের তালে ব্যক্তিতবর্জিত কবিতাকে আত্মস্থ করতে। ফলে সার্বজনীন হওয়ার যোগ্যতা সামগ্রিকভাবে কমে এসেছে।এটাই মূল দ্বন্দ্ব বর্তমান এবং অব্যবহিত অতীতের মধ্যে।
তিরিশের আধুনিক কাব্যের বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছিল আট দশক ও নয় দশক, সাথে মিশে ছিল নিজের ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও বিশ্বের সাম্প্রতিক কবিতার আগ্রহ থেকে অধিকার করা দায়। আরো ছিলো পাঁচের দশকের কবিদের থেকে পাওয়া স্বাপ্নীক বিশ্বাস ও দেশাত্মভাবনার সমষ্টিগত রূপরেখা। সবচেয়ে অবাক ও বিস্ময়ের বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা। একটি জাতির জাগ্রত অবস্থান, যার মূল ভিত্তিস্তম্ভ ‘বাংলাভাষা’ ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বৈভবময় প্রকাশ। একটি শক্ত প্ল্যাটফর্ম-এর উপর দাঁড়াবার মতো অবস্থান। তাই এই দশকের কবিতা বিচারে অব্যবহিত পূর্ববর্তী দশক সহ আরো অগের সময়পর্বগুলো প্রতি দৃষ্টি ফেরাতেই হবে। সেখানে ছিল সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ববাংলা’র মত প্রতীক্ষিত পথ অতিক্রান্ত কবিতা।
‘আমার পূর্ব বাংলা অনেক রাত্রে গাছের
পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতো
কখনও মৃদঙ্গ, হঠাৎ কখনও বেহালা
এক সময় বাঁশীর সুর’।
এক প্রত্যয়ী কবি আহসান হাবীবের নিজেকে অতিক্রম করা সৃষ্টিশীল প্রয়াস।
‘বড় হচ্ছি ভেবে ভেবে ক্রমাগত ছোট হয়ে যাওয়ার আগেই/ নিঃসঙ্গ হওয়ার আগে ফিরে আসবি এ্ই কথা দিয়ে
আশৈশব স্বপ্নের বন্দরে তুই যা।
তুই
মনে রাখবি যে যায় সে ভাটার পথিক আর
ফিরে আসা মানেই জোয়ার, তবে যা!’
[দু’হাতে দুই আদিম পাথর]।
সাথে পেয়েছিল জীবনের ঝাঁঝালো প্রান্তকে স্পর্শ করা কবি শামসুর রাহমানের অসাধারণ সব সৃষ্টি। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’-এর মত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সুতোয় গাঁথা মন্ত্রোচ্চারণের মতো অসাধারণ সব কাব্যপঙ্ক্তি।
‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;’ বা
‘পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে’ বা
‘বর্গীরা লুটেছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।’ বা
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন’ বা
‘গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।’ বা
‘ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যেও শপথ।’
বাঙালি জাতীকে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সরূপ সন্ধানের প্রয়াসে শৈল্পিক তাৎপর্যপূর্ণ নান্দনিকতার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।
‘যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
[আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি]।
একই প্ল্যাটফর্মে ছিলেন বাঙালি জাতীর ঐতিহ্যকে অনুসন্ধানে স্পৃহা ও তপস্যার কবি আসাদ চ্যেধুরী।
‘নদীর জলে আগুন ছিলো আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে।
..এখন এসব স্বপ্নকথা দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প।’
[আসাদ চৌধুরী]।
আবুল হাসান খুবই নীচু স্বরে শিল্পের গভীর থেকে বেদনার্ত হৃদয়ে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে দ্রোহের কথা বলেছেন।
‘শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা ক্ষুধা।’
উপরোক্ত জাতীয় বোধ ও চেতনার উত্তরসুরী আট ও নয়-দশকের কবিরা। তাই তাদের নির্মাণচিন্তার পরিসর অনেক বিস্তৃত।আট ও নয় দশকের কবিতা উঠে এসেছে চরম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরবর্তী অপরিপক্ক সমাজ কাঠামোর মধ্য দিয়ে। সেখানে ছিল চরম বাম রাজনীতির সমাজবদলের দর্শন। অনেকটা টালমাটাল অবস্থা ও অবক্ষয়ের মধ্য দিয়েই আট দশকের কবিতার বিকাশ শুরু বা যাত্রাপথ। বলা যায় এতসব বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়েই বস্তুকেন্দ্রিক পশ্চিমি ভাবনাও যুক্ত হয়েছে কবিতায়। পূববর্তী দশকের যুদ্ধ বিদ্ধস্ত অনিশ্চয়তা পরিহার করে জীবনচর্চার মাত্রাগুলিও বদলে যেতে থাকে তাদের কবিতায়। সমাজ ও সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পূববর্তী কবিদের যে আত্মত্যাগ ও বলিষ্ঠকণ্ঠ থেকে আট-এর কবিরা কিছুটা বিচ্ছিন্ন হতে থাকলো। তারা নতুন কাব্যভাষার সন্ধানে উন্মুখ হয়ে রইলো। কবিতার বিষয়বস্তু ও পাল্টাতে থাকলো। নিজস্ব মেজাজ ও আত্মখননে ডুবে থাকলেন কবিরা। অনেকেই গদ্যের পথ ধরে হাঁটলেন। কেউ অবশ্য ছন্দ চর্চা করেছেন, ভেঙেছেনও, কাব্যিক স্বাধীনতা নিয়েছেন।
বর্তমান শতকে তথ্যপ্রযুক্তির অতিমাত্রায় দ্রুত থেকে দ্রুততম বিকাশ যেন পথে হারিয়ে যাবার উপক্রম, তাই তাদের কবিতার বন্ধ্যাত্ব চলছে। অনেকেই ঢিলেঢালাভাবে কবিতা লিখছেন আর স্বরূপ হারিয়ে ফেলছেন। শুধুমাত্র অবচেতনের উপর যতটুকু সম্ভব নির্ভর করছেন, চেতনার উপর নির্ভরকরতে গিয়ে মৌলিকত্ব হারাচ্ছেন। কেন এই দৈন্যদশা! কবিতা যেন কৃত্রিমতায়পূর্ণ অনিবার্য বক্তব্যের অভাব রয়েছে। বর্তমানে আধুনিকতার সাথে উত্তর অধুনিকতার স্পর্শ বা টাচ্ দিয়ে যাকে রাঙ্গিয়ে তুলছে কবিরা তা কতটা বাস্তব, কতটা পরাবাস্তবতা বা কতটা অধিবাস্তবতায় ভরপুর! যেন অবচেতন মনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যসব সব রূপকল্পদ্বারা প্রকাশ করা। এসবই কৌশল এবং কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনার প্রয়াস। অনতে পারলেই সার্থকতার দ্বারে কড়া নাড়া সম্ভব নচেৎ শ্রেফ আস্তাকুড়ে। আট দশকের কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন-এর একুশ শতকে এসে লেখা একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছিÑ (কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকায় ২৪-১২-২০২১)।
লোকটার চোখে বরফের নীল ঘোড়া
প্রাণের কুয়াশা উঠে গেছে বাড়ি বেয়ে
জানালা ডাকছে চিৎকার করে পাড়া
চৌকাঠে নাক ঘষে পাথরের মেয়ে
বাড়িটা ধূসর অনঙ্গ করে রাখা
দরজার দাঁত কামড়ে ধরেছে হাওয়া
খিড়কির পায়ে গজিয়েছে পিপিলিকা
হাতলের ঠোঁটে রক্ত গিয়েছে পাওয়া
চার দেয়ালে প্রাচীন পরাধীনতা
হার মানিয়েছে শ্যাওলার নীরবতা
বাড়িটির নাসারন্ধ্রে বিড়াল কাঁদে
জিহ্বায় জ্বলে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো
খেয়াল করেনি কখন হয়েছে বুড়ো
যেই গাছগুলো বাস করছিল ছাদে
সিঁড়ির চোয়াল ফেটে গেছে শীত লেগে
চিলেকোঠা থেকে দু-একটি আরশোলা
পালাতে চেয়েছে মৃত্যুর উদ্বেগে
একজন তবু হয়তো রয়েছে জেগে
ছাদসমুদ্রে যখন বাতাস লাগে
লোকটি তখন বেড়িয়ে পরতে চায়
কিন্তু বাড়িটা সবকটা হাত দিয়ে
চেপে ধরে রাখে পরের সে অধ্যায়র্।
[বাড়ির গল্প, রেজাউদ্দিন স্টালিন]
স্টালিনের এই কবিতাটা বর্তমান ধারায় একাকার হয়ে গেছে। উপবাস্তবতার সুর বাড়িটা’র চারদিকে ধ্বনিত। বাড়িটার গল্পে ছন্দের নহর বয়ে গিয়েছে (শুধুমাত্র ‘বাড়িটির নাসারন্ধ্রে বিড়াল কাঁদে’ এই লাইনটি ছাড়া) যা ছিল আট দশকের কবিদের বৈশিষ্ট। অর্থাৎ কবি তার নিজস্বতা বিসর্জন দেননি, কিন্তু মিশে গেছেনে একুশ শতকের আজগুবি কাতারে। কবি নিজেকে অতিক্রম করে অন্য অধ্যায়ে পৌঁছেছেন। তাই মেটাফর ও প্রয়োগবিধি ও বিন্যাসে মুন্সিয়ানা বর্তমানের কবিদেরঅনুপ্রেরণা হতে পারে। আট দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার কবি মিখাইল এপ্স্টাইনই প্রথম উপবাস্তবতা বা মেটারিয়ালিজম-ধারণার তাত্ত্বিক। এই উপবাস্তবতা রাতারাতি বদলিয়ে দেয় উপমা বা মেটাফর-এর ধারণাকে। অর্থাৎ চিন্তা বস্তু ও তার উপমার মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। উপমার অন্য অর্থেও জায়গাগুলো খুঁজে দেখে, সাথে সাজুস্য খোঁজে মূল ভাবনার ‘অন্য’ একটি দিকের। তাত্ত্বিকদের মতে এটি উপ-উপমা বা মেটাবোলা। কারণ একটি চিন্তাবস্তুও সাথে এই উপমা কোন বিশেষ প্রাকৃতিক বস্তু বা বাস্তবতাকে মেলায় না। এ কবিতাটি পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে না, কেননা কবিতাটি স্বেচ্ছাচারিতায় আক্রান্ত নয়। কবিতায় রয়েছে সৃষ্টি রহস্যের পূর্ণঙ্গ স্বাদ ও সৌন্দর্য। পাঠক আজ কেন কবিতা বিমুখ! কবিতা স্বেচ্ছাারিতায় আনিবার্য হয়ে রয়েছে, পঠনে তৃপ্তি নেই, আশাবাদ নেই। বিবর্তনের কোন ফল কি না বলা মুশকিল। কবিতার এই স্বতন্ত্র স্বভাবী স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার কারণে পাঠকের চেয়ে কবি পাঠক বেশি। কবিতার অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত হন তারা কেউ কেউ ফেসবুকসর্বস্ব কবি বা উঠতি কবিস্বভাব নিয়ে ভবিষ্যতের কবি হবার বিপুল বাসনায় হাজির, নয়তো গোপনে কবিতা লিখেন আর অগ্রজ কবিদের বোঝার চেষ্টা করেন, নতুবা প্রেমিকা বা প্রেমিকের হাত ধরে বাধ্য হয়ে উপস্থিত, বা কেউ কেউ আত্মীয়সজন। আর বাকী যারা থাকেন তারা অনুষ্ঠানের কবিতা পাঠের অনুষঙ্গ। সব মিলিয়ে বড় জোড় এক কুড়ি।
বর্তমানে কবিতার পুরো কাঠামো স্পষ্ট থাকে না, স্টালিনের কবিতাটি এর ব্যতিক্রম। বিষয় ও বৈচিত্রের অভাবে কবিতা ব্যক্তিত্ববর্জিত হয়ে পড়ছে। আর আট দশকের কবিতা অনেকাংশেই অতীতের অবক্ষয়ী পুনাবৃত্তিতে ঠাসা।
‘আশির কবিতা এক অর্থে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যিক মন্ময়তা, দার্শনিক অনুভব এবং প্রাজ্ঞ উচ্চারণের দিকে পাশ ফিরেছে। কিন্তু সেই সাথে সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা, মানুষের বিবিধ প্রাত্যহিক বাস্তবতা, তার স্বপ্ন হতাশা, অভিকাঙ্খা ও প্রত্যয়কেও মিলিয়ে নিতে চাইছে একটি সিনন্থেথিসের ভেতর।’ [খোন্দকার আশরাফ হোসেন]।
আসাদ আহমেদ রচিত-‘আশির দশকের কবিতা : বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা’কে বিশ্লেষণ করলে খুঁজে পাওয়া যায় রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির অনুষঙ্গ রয়েছে সরকার মাসুদ, সৈয়দ তারিক, বিষ্ণু বিশ্বাস, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ফেরদৌস নাহার ও ওমর কায়সারের কবিতায়। মনোচেতনা ও আত্মচেতনা রয়েছে কাজল শাহনেওয়াজ, মারুফ রায়হান, সরকার মাসুদ এবং সুহিতা সুলতানার কবিতায়। পুরাণের ব্যবহার ও ঐতিহ্যের প্রয়োহ রয়েছে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মারুফুল ইসলাম ও অসীম কুমার দাস-এর কবিতায়। দর্শনচিন্তা আবার কখনো বৈজ্ঞানিক চিন্তা রয়েছে মাসুদ খান ও মারুফ রায়হানের কবিতায়। স্যাটায়ার, হিউমার, নাটকীয়তা ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা রয়েছে কাজল শাহনেওয়াজ, মাসুদ খান এবং রহস্যময়তা রয়েছে শোয়েব শাদাতের কবিতায়। ছন্দে বৈচিত্র বা ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন ফরিদ কবির, মারুফ রায়হান, মারুফুল ইসলাম, অসীম কুমার দাস প্রমুখ। আবার ফেরদৌস নাহার বিবৃতিধর্মী কবি। চিত্রকল্প ও পরাবাস্তব পরশ রয়েছে ফরিদ কবির, রেজাউদ্দিন স্টালিন সহ দু’একজনের কবিতায়।
সাপ-লুডু বেশ বিপজ্জনক!
খেলতে গেলেই দেখি, সাপগুলি জ্যান্ত হয়ে যায়
ছোবলের ভয়ে আমি লুডুর এ-ঘর থেকে অন্য ঘরে
ক্রমাগত ছুটতে থাকি!
ওপরে যাওয়ার জন্য মইগুলি খুঁজি
একটু আগেও পড়ে ছিল, যত্রতত্র
কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ একজন
সিঁড়িগুলি সরিয়ে ফেলেছো
আমি যে ধরবো, নেই তেমন একটা হাতও
অথচ পাশেই ছিলে তুমি
অথবা তোমার মতো অন্য কেউ!
সাপগুলি আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছে চারপাশ থেকে
আর, আমি ছোবল খাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি
[সাপ-লুডু, ফরিদ কবির]
নব্বইয়ের কবিতা নিয়ে বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন, ‘নব্বইয়ের কবিতা মূলত মনন ও অত্মোপলব্ধির কবিতা। আবেগ আর মননে মিথষ্ক্রিয়ায় বাংলাদেশের ন্বইয়ের কবিতা প্রকৃতি, প্রকৃত প্রস্তাবেই সত্তর-আশির কবিতা থেকে একবারে ভিন্ন হয়ে গেছে।’বেগম আকতার কামাল অবশ্য লিখেছেন অন্যভাবে, ‘কবিতার অস্তিত্বিক সংকটে কবিচিত্তের সংকটের সঙ্গে যুক্ত করেও নতুন একটি ধরণ সৃষ্টির সচেতন চেষ্টায় নব্বইয়ের কাব্যভাষা একভাবে শব্দতত্ত্বের ও সংস্কৃতির মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে।’
নয় দশকের কবিদের মধ্যে অত্মিজৈবনিক কবি হিসেবে ধরা যায় কবি হেনরী স্বপন, আশিক আকবর। মিথের প্রয়োগ করেছেন রায়হান রাইন, শোয়াইব জিবরান, শাহেদ শাফায়েত প্রমুখ। ব্রাত্য রাইসু’র কবিতায় রয়েছে সুররিয়ালিস্ট চেতনা ও গল্পের বীজ। তিনি প্রথাগত কবিতা থেকে মুক্ত থেকেছেন। তবে তার চিন্তাধারয় দার্শনিকতার ছোঁয়া আছে। কবিতায় জটিল ভাবধারা ফুটিয়ে তুলেছেন যেমন শামীম মাহমুদ-এর কবিতায় রয়েছে ম্যাজিকেল রিয়ালিজম, বায়েজিদ মাহমুদ চিত্রকল্পকে জটিল করে উপস্থাপন করেছেন, মুজিব মেহেদি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন প্রতীকী কবিতার মধ্যে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন যারা তাদের মধ্যে তুষার গায়েন। দার্শনিক তত্ত্বের প্রয়োগ ও সুক্ষ্মতর দার্শনিক সত্তাকে বিজ্ঞান মনস্কতায় অন্য দৃষ্টিভঙিাগ সৃষ্ট করেছেন দাউদ আল হাফিজ ও সাখাওয়াত টিপু। সঙ্গীতধর্মী চিত্রকল্প গড়েছেন ঈশম জয়ভদ্র, আহমদ নকীব, সরকার আমিন প্রমুখ। কামরুজ্জামান কামু কবিতায় চিত্রময়তা সৃষ্টিতে ও শব্দচিত্র তৈরিতে দক্ষ কারিগর। আয়েশা ঝর্না ইমপ্রেসনিস্ট কবি। চঞ্চল আশরাফ আধুনিক মনষ্কতার কবি। মুজিব ইরম গদ্য ফর্মকে কবিতার রীতি হিসেবে নিয়েছেন, তবে তিনি আঞ্চলিক শব্দ ও লোক উপাদান বেছে নিতে ভুল করেননি। তবে এদের মধ্যে টোকন ঠাকুর যিনি প্রকৃতিকে মেখে দিয়েছেন শব্দের সঙ্গে। উপমা ও রূপক ব্যবহারে তিনি বুঝিয়েছেন মূখ্য ও মৌল হচ্ছে প্রকৃতি। তার ভাবনার বিশুদ্ধতা ও রুচি উচ্চতররূপে প্রতিষ্ঠিত। তার কাব্যক্ষমতা ও পরিশ্রম তারই অনুসন্ধিৎসার ফসল। প্রকৃতি ও জীবন থেকেই তার কবিতা ভিন্নমাত্রা তুলে ধরে পাঠকের কাছে।
দেখেছ তুমি?
বধ্যভূমি
দ্যাখো, সকালÑ
রক্তলাল
পেয়েছ দেশ?
ভগ্নাবশেষ
আসে যে দিন
সত্যি স্বাধীন?
যেদিকে দেখি
খাঁটি, না- মেকি?
কবিতা লিখে
তোমার দিকে
দিলাম ছুড়ে
কী রোদ্দুরে?
লেখার আমি
কেমনে থামি?
কেমনে তবে
লিখতে হবে!
জানি না কিছু
স্বপ্ন পিছু
নিয়েছে তাই
যা-ই লিখে যাই
[টোকন ঠাকুর]
আমাদের পরিপ্রেক্ষিত প্রেম
আমাদের নন্দনতত্ত্বে
ভরে ওঠে করিডোরের পর
করিডোর। দেখি ঘোড়ার লাগাম হাতে
চলে পাচ্ছেন সাইকোলজিস্টরা। অথচ
কেউ আমাকে বুঝতে চায় না
[স্যানাটোরিয়ম ব্রাত্য রাইসু]
আসলে বহু পথ ও মতের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেছে নব্বইয়ের কবিতা। যখন অধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতার প্রবল অলোড়ন উঠেছিল সাহিত্যাঙ্গনে। কবি আল মাহমুদ মনে করেন, ‘নব্বইয়ের কবিতা আমাকে বিস্মিত করে-এ কথা বলার আগে আমি বলতে চাই নব্বই-দশকে এতো কবির আবির্ভাব বাংলা ভাষার জন্য সত্যিই বিস্ময়কর।… এই হলো নব্বই দশকের অন্য আকাশ। দূর থেকে অসংখ্য তারার টিপটিপ আয় আয় শব্দ আছে গেলে উল্কার মতো নিজের পুচ্ছ পুড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।’ তবে উপসংহারেবলা যায় স্বাধীনতা পূবসুরিদের কবিতা থেকে আট ও নয় দশকের কবিদের ভাষা ভিন্নতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তার ছন্দশৈলির আবর্তে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চাননা। ছন্দে দখল ঠিকই রেখেছেন। তারা কবিতাকে মানব হৃদয়ের নিগূঢ় রসায়ন হিসেবে ভাষারূপ দিতেও অগ্রগামী পথিক।