৭৮৯ বাটন চাপুন, স্বাস্থ্য সেবা তো পকেটে !! সুখে অসুখে আছি, হাত বাড়ালেই আছি

By Published On: July 14, 2021Views: 252

৭৮৯ বাটন চাপুন, স্বাস্থ্য সেবা তো পকেটে !!
সুখে অসুখে আছি, হাত বাড়ালেই আছি

আমার এক বন্ধু বেসরকারী ব্যাংকে চাকরী করে। উত্তরোত্তর পদন্নোতিতে বেসরকারী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার সুনাম সারাদিনই বলে বেড়ায়। কোন সন্দেহ নেই বাংলাদেশের বেসরকারী ব্যাংক বিপ্লব ঘটিয়েছে মানুষের জীবনে। সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘন্টা ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এটিএম বুথ স্থাপন, জীবনের প্রয়োজনীয় সময়ে ও সংকটময় মূহুর্তে ঋণ প্রদানসহ নানা আয়োজন। কিন্তু তাই বলে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলোও কি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃক প্রদান হবে? যে সিদ্ধান্তগুলো পরিবারকেন্দ্রিক কিংবা স্বামী-স্ত্রী কেন্দ্রিক তাও আজকাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত! বন্ধু কাজলকে (ছদ্মনাম), তার ব্যাংক উপদেশ দিয়েছিল ফ্ল্যাট কেনার লোনটা শোধ হলেই যেন বিয়ে করে, কাজল সে কথা রেখেছিল। পাঁচ বছর পর বিয়ে করেছিল ব্যাংকের লোন রেকর্ড ভালো রাখার জন্য। সেদিন কাজল বললো, ব্যাংক বলেছে গাড়ির লোনটা শোধ না হলে এখনই বাচ্চা নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিয়ে করা, বাড়ি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা, গাড়ি কেনা, উচ্চতর শিক্ষা অর্জন কিংবা স্বামী স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বাচ্চা গ্রহন করার সিদ্ধান্তসমুহ প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনে ব্যাংকের পরোক্ষ ভূমিকা থেকেই যাচ্ছে। ব্যক্তি জীবনের সিদ্ধান্ত এখন আর ব্যক্তি নিজে নিতে পারে না, সিদ্ধান্ত নেয় ইট সিমেন্ট আর কাঠের অফিস ব্যাংক। স্বামী স্ত্রী তাদের নিজেদের বাচ্চা গ্রহন করার সিদ্ধান্ত কিংবা উপদেশ নিতে হয় ব্যাংক লোন সেকশনের কর্মকর্তার কাছে, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করবো কি করবো না কিংবা সুযোগ হবে কি হবে না তা নির্ভর করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে; আমার গ্রহনযোগ্যতার উপর। কেননা উচ্চশিক্ষার জন্য লোন পাশ হতে হবে। তথাকথিত ও উন্নত সেবা ব্যবস্থাপনা মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, সিদ্ধান্ত গ্রহন করার ক্ষমতার উপর প্রতিনিয়তই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা।

কিছুদিন আগেও বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কিংবা পড়শীদের নিকট ঋণী থাকা ছিল অনেকটা লজ্জার বিষয়, পারতো পক্ষে কেউ ঋণ নেয়ার কথা ভাবতোই না। সেটা ছিল বেহিসেবী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। আয় ও ব্যায়ের মধ্যকার ভারসাম্যহীন আচরণকেই বলা হতো বেহিসেবী। কিন্তু আজকাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হলো আভিজাত্যের প্রতীক। কারনে অকারনে মানিব্যাগ কিংবা পার্টস খুলে একাধিক ব্যাংকের ডেভিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড প্রদর্শন জানান দেয়, ঋণ দেয়া কোন লজ্জার বিষয় নয় বরং মানিব্যাগ কিংবা পার্টসে ক্রেডিট কার্ড না থাকার অর্থ দাঁড়ায় ছেলেটি/মেয়েটি গ্রামে থাকে কিংবা গ্রাম থেকে সদ্য শহরে এসেছে কিংবা তারা অ-আধুনিক মানুষ। ঋণ শব্দটির প্রকৃত অর্থ একই আছে, বদলে গেছে শুধু ঋণের উৎস। ঋণের উৎস বদল হওয়ার কারনে তা আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সবই কর্পোরেট কালচার যা প্রতিনিয়তই মানুষকে প্রভাবিত করছে নানা কৌশলে, নানা আদলে। মানুষ বন্দী হয়ে পড়ছে কর্পোরেট বিশ্বে যেখানে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগত বলে কোন শব্দ নেই, আছে কেবল কোম্পানী। আমরা অসুস্থ হলে এখন আর পাশের ফ্ল্যাট কিংবা পড়শীর উপর ভরসা করি না বরং মেট লাইফ কোম্পানীতে একটা ইন্সুরেন্স পলিসি করে রাখি। কর্পোরেট বিশ্ব ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করতে যাচ্ছে। সারা বিশ্ব যেমন পরিচালিত হয় কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের নখের ইশারায়, বাংলাদেশেও তেমনি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী পরিষদ, জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সাংসদ কর্পোরেট ব্যবসায়ী, তারাই দেশের নীতি নির্ধারন করে থাকেন। এখন মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের পরিবর্তে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যালয়, বীমা কোম্পানী কিংবা বেসরকারী টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানী গ্রহন করছে। আমাদের দুশ্চিন্তার সময়গুলো কি ক্রমেই কমে যাচ্ছে?

ডায়াল করুন ৭৮৯… স্বাস্থ্য সেবা তো পকেটে কিংবা সুখে অসুখে আছি, হাত বাড়ালেই আছি……ল্যাব এইড এর এরকম নজরকাড়া বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়তই আমাদের চেতনার পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমরা ভাবতে শিখছি, কোম্পানীগুলোই আমাদের পরম আপন এবং আপদে বিপদে সহায়ক। একটা সহজ হিসেব মেলানো যাক- বাংলাদেশের কত পার্সেন্ট মানুষের বছরে/মাসে অন্তত একবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর কত পার্সেন্ট বেসরকারী হাসপাতালে (যেমন-এপোলো, স্কয়ার, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড) ভর্তি হন বা হতে পারেন, তার মধ্যে কত পার্সেন্ট মানুষের আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উল্লিখিত হাসপাতালগুলোর সেবা গ্রহন করতে পারেন? অল্প সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্য সেবার বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে এ ধরনের ব্যয়বহুল হাসপাতালগুলো কি চালানো সম্ভব? তাহলে চলছে কেমন করে? সম্ভাব্য পথ হলো-সেবার বিপরীতে ধার্যকৃত টাকার পরিমান মাত্রাতিরিক্ত বেশী অথবা মানুষ তার আয় থাক বা না থাক ভালো সেবার প্রত্যাশায় এ জাতীয় হাসপাতালের সেবা নিচ্ছে জমি বিক্রি করে, ধার দেনা করে, সঞ্চিত অর্থ থেকে অথবা অবৈধ অর্থ আয়ের মাধ্যমে অথবা মালিকপক্ষ আপাত লোকসান দিয়ে বিনিয়োগ করেই চলেছে- ভবিষ্যতে রোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে লোকসান উঠিয়ে মুনাফা করার প্রত্যাশায়। ফলে হাত বাড়ালেই আছি, সুখে অসুখে আছি……… এ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করতেই হবে। প্রশ্ন হলো, কতজন মানুষ হাত বাড়ালেই এ সেবা পায় বা পাবার ক্ষমতা রাখে তার বিপরীতে কতজন মানুষ এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেখতে বাধ্য হয়? এ দুয়ের মধ্যকার সংখ্যা অর্থাৎ জনগোষ্ঠীই ভবিষ্যৎ কাঙ্ক্ষিত সেবা গ্রহীতা। তাদের কাছে প্রাইভেট আয়োজনে স্বাস্থ্য/চিকিৎসা সেবার মাহাত্ম প্রচার করেই আকৃষ্ট করতে হবে। ধরা যাক, উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ নজরকাড়া বিজ্ঞাপনে বিমোহিত হয়ে রাতারাতিই চিকিৎসা সেবা গ্রহীতা হলো কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা রাতারাতি পরিবর্তন হবে কিভাবে? যদি প্রমান করা যায়, সরকারী ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সেকেলে, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা দুর্বল, সঠিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবার মারাত্মক ঘাটতি ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থার তো প্রশ্নই উঠে না- সেতো আরো সেকেলে, অবৈজ্ঞানিক ইত্যাদি। তাহলে মানুষের জন্য একটি মাত্র পথ খোলা রইলো- আধুনিকতার মোড়কে এলোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা তাও আবার বেসরকারী ব্যবস্থাপনায়। ফলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের জীবন মরণ সমস্যা সমাধানের জন্য যে কোন উপায় অবলম্বন করেই বেসরকারী চিকিৎসা সেবা নিতে বাধ্য হবে। রাতারাতি আয়ের উৎস বৃদ্ধি না হলেও একই উৎস থেকেই আয়ের পরিমান বাড়াতে থাকবে, সেটা বৈধ কিংবা অবৈধ তা ভাবার সুযোগই আর রইলো না, কেননা সামনে রোগীর জীবন মরন সমস্যা। দ্বিতীয় পথটি খোলা আছে জীবনের সর্বোস্ব দিয়ে হলেও রোগীর সর্বোত্তম বেসরকারী চিকিৎসা সেবা পাওয়া। এরকম একটা প্রেক্ষাপটে “হাত বাড়ালেই আছি………” প্রলোভনে সাড়া না দেয়ার কোন উপায়ই নেই।

কয়েক বছর আগে “বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অর্জন সমস্যা সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ” শীর্ষিক এক সেমিনারে পেপার পড়ছিলাম, সভা প্রধান ছিলেন একজন বেসরকারী কলেজের প্রিন্সিপাল, সভা প্রধানের বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন-

“সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা বলতে কিছুই নেই, বাংলাদেশে সরকারী ব্যবস্থাপনায় কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা উচিৎ নয়। সকল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ক্লিনিক সবই বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় থাকা উচিৎ। প্রতিযোগীতামূলক বাজারে মানুষ কিছুটা হলেও সেবা পাবে ইত্যাদি”।

তার কিছুদিন পর অন্য এক সেমিনারে স্বনামধন্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরও প্রায় একই সুরে বলেছিলেন-

“টাকা প্রদান ছাড়া কোনদিনই জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে না। বেসরকারী ক্লিনিক বা হাসপাতালে বেশী অর্থ প্রদান করে হলেও মানুষ সেবা পাবে অন্তত নিজেদের প্রাপ্য দাবীটুকু করতে পারবে যা সরকারী হাসপাতালে সম্ভব নয়”।

দু’জনের কাছে কতগুলো প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু তাদের উত্তরটা আর জানা হয়নি সময়ের অভাবে।

বাংলাদেশের অল্প সংখ্যক ঔষধ ছাড়া সবই বেসরকারী কোম্পানী কর্তৃক প্রস্তুত হয়। কিন্তু দরিদ্র মানুষের হাতের নাগালে কি ঔষধ আছে? বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ছাত্র/ছাত্রীদের পড়াশুনা করতে হয় কিন্তু এর গুণগত মান কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেশী ভাল? বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশীর ভাল শিক্ষকই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর শিক্ষক কিন্তু কেন? অলিতে গলিতে হাজারো বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল কিন্তু জনগণ কি তাদের প্রাপ্য সেবাটুকু অর্থের বিনিময়ে হলেও পাচ্ছে? আর যাদের অর্থ নেই তাদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব তাহলে কে নেবে? গুনগত মান, সেবা, জবাবদিহিতা ও প্রাপ্য সেবা অর্থাৎ চিকিৎসা, পানি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, রাস্তা ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, যানবাহন, নিরাপত্তা সেবা (আজকাল বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় দেখা যায়), টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি সবই বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় থাকবে? তাহলে চিকিৎসা সেবা না বলে চিকিৎসা ব্যবসা/বানিজ্য বলি না কেন? বেশ কয়েক বছর আগে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটের সেবা ব্যবস্থাপনার উপর একটি গবেষনার জন্য ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর সাথে আলাপকালে একজন বার্ণ রোগী বলছিলেন-

বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা হলো- আত্মীয়ের বাড়ীর মত আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হলো বাবার বাড়ীর মত। আত্মীয়ের বাড়ীতে যথার্থ আপ্যায়ন পেতে হলে হাতে অনেক গিফট (দই মিষ্টি, ফল ইত্যাদি) থাকা লাগে আর নিজেকেও আত্মীয় বাড়ীর সমকক্ষ হতে হয়। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান সহজেই ভেতরে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু বাবার বাড়ী, নিজের বাড়ী, সেখানে প্রান থাকে, মর্যাদা থাকে, দাবী থাকে, আত্ম-সম্মান থাকে। হোক না সেটা গরীবী হালত। আমাদের সবার চেষ্টা চালাতে হবে বাবার বাড়ীকে কিভাবে উন্নত করা যায়? বাবার বাড়ী খারাপ বলে আত্মীয়ের বাড়ীকেই নিরাপদ আশ্রয় ভাবাটা বোকামী।

দরিদ্র ও তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না সেই নারী, হয়তো সে তার আত্মীয়ের সমকক্ষ নয় বলেই বাবার বাড়ীকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রিন্সিপাল নিঃসন্দেহে তার আত্মিয়ের সমকক্ষ, ফলে কোন সমস্যা অনুভব করেননি। চেতনা ও অনুভবের মাত্রা নির্ভর করে শ্রেনী অবস্থানের উপর যার সাথে তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থার হয়তো কোন সম্পর্ক নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বলেছিলেন- রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের সেবা প্রদান নয় বরং সেবার নিশ্চয়তা প্রদান করা। সরকার সবার জন্য, সকল সেবা প্রদানের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিতে পারবে না, নেয়া উচিৎও নয়। বরং বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় থাকবে সকল সেবা যেমন চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা-সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেবলমাত্র তা রেগুলেট করবে অর্থাৎ সেবার পরিমানগত এবং গুনগত মান নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরোটাই তো বেসরকারী খাতে। বাণিজ্য খাতও পুরোটাই নিয়ন্ত্রন করছে বেসরকারী খাত কিন্তু তারপরও কেন জনগণ যথার্থ সেবা পাচ্ছে না? ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের সাথে সরকারের কেন তোষামোদী আচরন করতে হয়? সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কঠোর মনোভাবের কারনে কেন অর্থনৈতিক কর্ম চাঞ্চল্য স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে? e½eÜz মেডিকেল কলেজ কিংবা অন্য কোন সরকারী হাসপাতালে কেন ডাক্তারদের ধর্মঘটের কারনে সরকারকে সকল দাবী মেনে নিতে হয়? যেখানে সরকারী হাসপাতালেই সরকার কোন প্রকার কঠোর রেগুলেশন আরোপ করতে পারে না, সেখানে সম্পুর্নভাবে সরকারী নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দিয়ে সকল বেসরকারী সেবা ব্যবস্থাপনার উপর সরকারী রেগুলেশন আরোপ করা যাবে তা ভাবাটা কতটা যৌক্তিক?

আজকাল “সিন্ডিকেট” একটি বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ। সিন্ডিকেট সমস্যা শুধুমাত্র কোন নিত্যপণ্য কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের সাথেই সম্পর্কিত নয়। চিকিৎসা সেবা খাতেও সিন্ডিকেটের প্রভাব মারাত্মক। দেশের মোট ঔষধের চাহিদার প্রায় পুরোটাই বেসরকারী কোম্পানী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত, বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডিসপেনসারী ও কোয়াক ডাক্তারদের উপর গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা সেবার জন্য নির্ভরশীল, সিন্ডিকেটের প্রভাব এ খাতকেও মারাত্মক হুমকির মধ্যে রেখেছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাখাত অন্যান্য খাতের তুলনায় ভিন্ন মাত্রা দাবী করে কেননা আজ পর্যন্ত দেখিনি কোন মানুষ জমি বিক্রি করে স্কুলের বা কলেজের বেতন দিয়েছে বা বই কিনেছে কিংবা জমি বিক্রি করে বড় মাছ কিনেছে রসনা তৃপ্ত করার জন্য কিংবা নুতন জামা/শাড়ী কিনেছে জমি বিক্রির টাকা দিয়ে। কিন্তু হাজার হাজার উদাহরন আছে, মানুষ জমি বিক্রি করে, ঘরের চাল বিক্রি করে, হালের গরু বিক্রি করে এমনকি সুদে ঋণ নিয়েও চিকিৎসার খরচ যুগিয়েছে। চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত মানুষের জীবন মরণের, মানুষের আবেগের, মানুষের অসহায়ত্বের, মানুষের নির্ঘুম রাতের, মানুষের সর্বোচ্চ বিসর্জনের। শিশুর দুধের দাম যে কারনে হু-হু করে বাড়ে সেই একই কারনে ঔষধের দামও অযৌক্তিকভাবে বাড়ে। ডাক্তারদের প্রতি মিনিটে কনসালটেন্সি ফি লাগামহীনভাবে বাড়ে আর ডাক্তারদের কাছে গেলেই প্রস্তুত থাকতে হয়, কারনে অ-কারনে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার এর ফি যোগান দেবার জন্য। বেসরকারী খাত মানেই পুঁজির বিনিয়োগ আর বিনিয়োগ মানেই মুনাফার নিশ্চয়তা। পুজি বিনিয়োগ ও মুনাফার সমীকরণে মানুষের আবেগের কিংবা অসহায়ত্বের কোন জায়গা নেই। চিকিৎসাখাতের মতো একটি জরুরী সেবাখাত কিভাবে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেবার যুক্তি তৈরী হয় ভেবে পাই না, তাও আবার সচেতন জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। একটি দেশে বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা থাকতেই পারে (এবং অবশ্যই থাকবে) কিন্তু তাই বলে সরকারী সেবাকে উপেক্ষা করে, নানা কৌশলে সরকারী হাসপাতালকে অকার্যকর করার প্রতিযোগীতায় নেমে?

মিডিয়ার ক্ষমতা, তৎপরতা ও চৌকষ উপস্থাপনা সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ধারনা আছে। ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ, সিরিয়া যুদ্ধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা মিডিয়ার ক্ষমতার ব্যবহার দেখেছি, অর্থের কাছে মিডিয়ার পরাজয় সম্পর্কে আমরা খুব ভাল জানি। বাংলাদেশে অসংখ্য হত্যাকান্ড এবং মাফিয়াদের অপকর্মে মিডিয়ার ভূমিকা সম্পর্কেও আমরা অবগত। করোনাকালীন সময়েও আমরা দিখেছি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অপকর্ম এবং মিডিয়ার ভূমিকা। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে চিকিৎসা ব্যবস্থার নানা রকম চটকদার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। হুজুরের পানি পড়ায় ২০ বছর পর সন্তান লাভ, কম্পিউটারাইজড ক্যান্সার চিকিৎসা, মোটা হতে চিকন এবং চিকন হতে মোটাসহ টাক মাথায় চুল গজানোর অপূর্ব কৌশল টাকার বিনিময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে মিডিয়ার কল্যাণে দেশের আপামর জনগণ “স্বাস্থ্য সেবা তো পকেটে” নিয়েই মৃত্যুবরণ করে। একদিকে মিডিয়া অর্থের বিনিময়ে অসচেতন জনগণকে এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন করার যেমন গুরু দায়িত্ব পালন করছে তেমনি আবার সচেতন জনগোষ্ঠীকে “মেদ ভুড়ি কি করি” প্রচার করে অসচেতন করে তুলছে। সচেতন থেকে অসচেতনতা আবার অসচেতনতা থেকে সচেতনতা! সরকারী হাসপাতালগুলোকে টপকে বেসরকারী হাসপাতালের গুণগান আবার বেসরকারী হাসপাতালের সার্ভিস চার্জ উপেক্ষা করে সরকারী হাসপাতালের অবহেলার দিকে কটাক্ষপাত, সবই অর্থের বিনিময়ে। বিনিময় মূল্য যত বেশী গুনগান ও ততই বেশী- “আমার দেশের সোনার ছেলেরা আছে না”, “ সুখে অসুখে আছি” কিংবা “স্বাস্থ্য সেবা তো পকেটে” বিজ্ঞাপন। আমরা জানি যে বিজ্ঞাপন ছাড়া মিডিয়া অচল, বিজ্ঞাপনের বদৌলতেই মিডিয়ার সচলতা। কিন্তু নূন্যতম মূল্যবোধও কি মিডিয়া ধারণ করবে না? অন্তত খাদ্য-পণ্য ও চিকিৎসা সেবার বিজ্ঞাপনেও কি মিডিয়া একটু সচেতন হবে না?

স্বাস্থ্য সেবা ও চিকিৎসা সেবা দুটো ভিন্ন প্রপঞ্চ। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য সেবাকে মেডিকেল মডেল অর্থাৎ 4D (Disease, Doctor, Diagonosis and Drug) মডেলের মধ্য দিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়। স্বাস্থ্য সেবাকে চিকিৎসা সেবার মধ্যে রূপান্তরিত করতে পারলেই চিকিৎসা খাতে বাণিজ্যের প্রসার ঘটে অন্যদিকে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে অকার্যকর ও সেকেলে প্রমান করতে পারলে বাণিজ্যের যথেষ্ট সুবিধে হয়, কর্পোরেট বাণিজ্যের দুয়ার উন্মুক্ত হয়, বেসরকারীভাবে একচেটিয়া চিকিৎসা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। জনগনও ভাবতে শেখে সরকারী হাসপাতাল দিয়ে চিকিৎসা সেবার সমাধান হবে না (যেমনটি ভাবছিলেন, শুরুতেই বলা প্রিন্সিপাল এবং অধ্যাপক)। চিকিৎসা সেবার মধ্যে কেবল রোগ নির্ণয়, রোগের ডায়াগনসিস ও রোগ প্রতিকারই প্রধানত সীমাবদ্ধ কিন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা ও সুষ্ঠ বন্টন ব্যবস্থা, জীবনের নিরাপত্তা ও কর্মসু্যোগ, পরিবেশ ও সামগ্রিক ভারসাম্যতা ইত্যাদি বিষয়গুলো জড়িত থাকে। শুধুমাত্র রোগের অনুপস্থিতি কিংবা নিরোগ জীবনই সুস্বাস্থ্যের ইঙ্গিত দেয় না। হতে পারে ৭৮৯ ডায়াল করে কোন রোগ নিরূপনের প্রাথমিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় কিংবা কোন ইমার্জেন্সী প্রেক্ষিতে প্রাথমিক করনীয় সম্পর্কে উপদেশ পাওয়া যায় কোন চিকিৎসকের কন্ঠে। কিন্তু সেটা সামগ্রিকভাবে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা/সেবা নয়, স্বাস্থ্য সেবা তো নয়ই। কিন্ত আমরা প্রতিনিয়তই গ্রামীন ফোনের কল্যানে ও মিডিয়ার বদৌলতে “চিকিৎসা সেবা তো পকেটে” নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সেবার পরিবর্তে পণ্যে রূপান্তরিত করছি। কর্পোরেট কালচার আমাদের এটাই শেখাচ্ছে, আমরাও গোগ্রাসে শিখছি।

 

সরদার আরিফ উদ্দিন
উন্নয়ন ও আচরন পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞানী
(Development & SBCC Expert and Public Health Anthropologist)

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop