সলিলে না ফোটা স্বর্ণকমল
দীলতাজ রহমান
বাসার কর্তা মোর্শেদ সাহেব অফিসে চলে গেলে বহুদিনের পুরনো কাজের লোক রাফেয়া কর্ত্রী সানজিদা বেগমকে কিছু বলবে বলে স্থির হয়ে বসতে বললো। সানজিদা অর্ধেক খাওয়া চাটুকু নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে বসতে ভাবলেন, রাফেয়া অনেকদিন পর গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে। কত গল্প তার পেটে জমে আছে। সবই যে তার ভালো খবর তা নয়। এর ভেতর সমস্যাও আছে বিস্তর। কোথায় ঘরের বাঁধন খুলে গিয়েছিলো। রান্নাঘরখানা প্রায় ভেঙে পড়েছিলো। কে গাঁছ-বাঁশ কেটে নিয়ে গেছে। বর্গাদার কতগুলো ফসল কম দিয়েছিলো। সে তার বাড়ি গিয়ে ঝগড়া করে আরো চারটে বেশি এনেছে এমন সব খবর। বাড়িঘরের সাথে সম্পর্ক রাখতে গেলে যা হয়। তবু তিনি আয়েশ করে বসলেন। রাফেয়া বসলো তার মুখোমুখি কার্পেট বাদ দিয়ে ফ্লোরে। রাফেয়ার দৃষ্টিতে ভীষণ শঙ্কা। সেখানে গাছ-বাঁশ, ঘর, পুকুর, ফসল কিছু নেই! সে তার সেই শঙ্কা নিয়ে কর্তা বাড়ি থেকে বেরোনোর অপেক্ষাতেই ছিলো। তবু ভালো আজ সানজিদার নিজের ছুটি!
রাফেয়া বললো, ভাবি, একটা তো বিরাট জামেলা বাইদা গ্যাছে মনে অতিছে…।’
সানজিদা ফুরফুরে মেজাজে আধ ঠাণ্ডা চাটুকু এক নিমিষে গলায় ঢেলে খালি কাপটা রাফেয়ার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, কি?
: আমার তো মনে হয় সুখির প্যাটে বাচ্চা!
চমকে ওঠেন সানজিদা বেগম। কারণ এরকম দুর্টনা ঘটলে পুরো দায়ই সানজিদা বেগমের নিজের ওপর বর্তায়।
তার চোখের সামনে শত্রুর মুখ ভেসে উঠলো। নিজের ভাইয়ের কথা ভাবছেন তিনি, মুহূর্তে মনে মনে ভাবলেন, এই কালসাপ আমি পুষেছি…!
সানজিদা বেগমের বিয়ের বয়স বিশ বছর পার হয়ে গেছে। তাদের ছেলেমেয়ে হয়নি। বিয়ের পাঁচ/ছয় বছর পর্যন্ত অনেক চেষ্টা তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে করেছেন। তারপর চূড়ান্তভাবে যখন প্রমাণিত হলো তার স্বামী মোর্শেদ রহমানের ত্রুটি! তারপর থেকে তিনি এই প্রতিবন্ধকতাকে নিয়তি হিসাবে মেনে নিয়েছেন।
সানজিদা রাফেয়াকে বললেন, একটু সময় দে আমাকে। দেখি কীভাবে সুরাহা করা যায়, বলে তিনি নিজের বিছানায় গিয়ে কেন্নোর মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে রইলেন। ভাবছেন, নিজের ভাই তৌহিদের কথা। ঢাকা কলেজে চান্স পেয়ে তৌহিদ তার কাছেই এসে উঠেছিলো। যেহেতু মোর্শেদ-সানজিদা দম্পতির সন্তান হয়নি। তাই তৌহিদকে পেয়ে ওদের বাড়িটা আনন্দে ভরে উঠেছিলো। তৌহিদকে তারা আর অন্যত্র যেতে দেননি। বরং সানজিদা ভাবছেন ওকে বিয়ে দিয়েও নিজেদের কাছে রাখবেন।
রাফেয়া সানজিদার শ্বশুরবাড়ির মানুষ। তার শাশুড়ির কাছে বালিকাবেলা থেকে এসে থাকতো। নিজেদের বাড়ি ছিলো পাশের গ্রামে। রাফেয়া উপযুক্ত হলে বাড়ির লাগাবাঁধা চাকর কুদ্দুস আলীর সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু তার এই মেয়ে সুখি যখন পেটে তখন রাফেয়ার সে স্বামীকে সাপে কেটে মেরে ফেলে। পরে মেয়েসহ ওকে আবার বিয়ে দেয়া হয় তার বাপের বয়সী এক সম্পন্ন কৃষকের সাথে। সে কৃষকের স্ত্রী বারোবাসের রোগী ছিলো। রান্নাবাড়ার অভাবে ছেলেমেয়ে না খেয়ে থাকতো। সংসার ছিলো অচল প্রায়। কিন্তু রাফেয়ার বিয়ের পর তার সতীনের অসুখ ভালো হয়ে যায়। পরে রাফেয়া সেখানে সে সতিনের যন্ত্রণায় না টিকতে পেরে আবার সানজিদা বেগমের শাশুড়ির কাছে চলে আসে। এসবই সানজিদার বিয়ের কিছু আগের ঘটনা! অতএব সুখির সয়স বাইস/ তেইশের কম নয়।
তারপর একে একে শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেলে সানজিদা বেগমের হাতে দায়িত্ব চলে আসে! বাড়ির জমিজমা ভাইদের ভেতর ভাগ হলেও বাড়িটা সানজিদা নিজের ভাগে রাখেন। কিন্তু যার যার ভাগের জমি সবাই বিক্রি করে ফেলেছে বলে বাড়িতে আর কারো তেমন যাওয়া হয় না। কিন্তু সানজিদা বেগমের বাড়িটির ওপর টান আছে। কারণ কাছেই তার বাবার বাড়ি। তাই তিনি প্রায়ই রাফেয়াকে বাড়িতে পাঠান এটা ওটা ঠিক করতে। বর্গাদারের থেকে নিজেদের ভাগের যেটুকু জমি আছে তার ফসল বুঝে আনতে। আর এদিকে রাফেয়ার মেয়ে সুখি এ’কদিনে সংসারে কাজটুকু কোনো রকম সামলে নিতে পারে।
সংসারে মানুষ ওরা পাঁচজন। মোর্শেদ রহমান, সানজিদা বেগম ও তার ভাই তৌহিদ এবং রাফেয়া ও সুখি।
ছেলেমেয়ে হলো না বলে অত হিসেব করে সানজিদা চলে না এবং সংসারে তার কথাই শেষ কথা! মোর্শেদ রহমানকে তার পুরোপুরিই বাধ্য স্বামী বলা চলে। তৌহিদ কোনো কারণে বোনের ধমকের শিকার হলে ভগ্নিপতি দায়টা নিজের কাঁধে নিয়ে সংসারের শান্তি রক্ষা করেন। তৌহিদ ঢাকা ইউনিভার্টি থেকে এমবিএ করার পর এই প্রাইভেট ব্যাংকটিতে তার চাকরির বয়সও বছর দুই হয়ে এলো। এর ভেতর সে কয়েকবার চলে যেতে চেয়েছে। সানজিদা বলেন, তুই বের হয়ে গেলে আমি বড় শূন্য হয়ে যাই…।’ নিঃসন্তান বোনের এ আকুতি তৌহিদ হাসানের পা শেকলের মতো আটকে দেয়।
সানজিদা বুঝে উঠতে পারেননি, একটি বাচ্চা জোগাড় করে তার পোষা উচিৎ ছিলো কি না! কিন্তু তিনি অনেক ভেবে দেখেছেন, পরের বাচ্চাকে তিনি অতো ভালোবাসতে পারেন না! কারণ যে কবারই কথা উঠেছে, তিনি তুলনা করে দেখেছেন, নিজের ভাগ্নে-ভাগ্নি, এবং দেবন-ননদ-ভাসুরের ছেলেমেয়ের জন্য যে টান, সে টান ওই বাইরের বাচ্চাটির ওপর তার আসে না। তাই তিনি নিজের ভাইবোন থেকে দেবর-ননদদের সবাইকে বলেছেন, তাদের জন্যই কাউকে আরেকটা একটা বাচ্চা নিতে। কিন্তু বিষয়টা কেউই তেমন আমল দেয়নি। তাই বলে তাদের কারো যে তিন চারটে বাচ্চাও নেই, তা নয়। কিন্তু তার বুক ভরাতে একটি বাচ্চা তার কোলে তুলে দেয়ার মতো কৃপা কেউই তাকে করেনি।
তবু সানজিদা নিজে যেহেতু একটা স্কুলে চাকরি করেন। সারাদিন সেখানেই কেটে যায়। বাড়িতে ঢুকলেও খালিবাড়ি মনে হয় না! একইভাবে সুখি ও রাফেয়া সততার সাথে তার মন যুগিয়ে আসছে। আর রাফেয়ার সাথে স্বামী মোর্শেদের রক্তের একটা ক্ষীণ সম্পর্কও আছে। মোর্শেদের ও কেমন ফুপাতো বোন নাকি হয়। এটা অবশ্য রাফেয়া হিসেব করে বের করেছে। সানজিদার শ্বশুরবাড়ির মানুষ ওসবে কান দিতে যায়নি।
সুখি তৌহিদকে মামা ডাকে। এমন একটা দুর্ঘটনা সে ঘটাবে, তার রুচি এতো নিচে নামবে সানজিদা বেগম ভাবতেই পারেননি। বছরখানেক যাবৎ তিনি অনবরত তার এই ভাইটির জন্য মেয়ে দেখে চলেছেন। তার স্কুলে নতুন যে মেয়েগুলো জয়েন করছেন, নজর রাখছেন তাদের দিকেও। তিনি মনে মনে ভেবে রেখেছেন, তার অবর্তমানে তার যা কিছু আছে তিনি তা তৌহিদকে দিয়ে যাবেন। যদিও এখনো সেদিন বহুদূর মনে করেন তিনি। জীবনটাকে সানজিদা খুব নান্দনিকতার সাথে যাপন করেন। তবু শেষ হিসেবটা মনে মনে মনের কোনায় ভেজে রেখেছেন !
সারাদুপুর বিছানা থেকে উঠলেন না সানজিদা। সেদিন বিশেষ কি একটা দিন ছিলো, তাই স্কুল বন্ধ ছিলো। তাই বিছানায় পড়েই থাকলেন। যা তার অভ্যাসের আওতায় নেই। একটু ছুটি পেলেই তিনি সুখিও রাফেয়াকে নিয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যান। মার্কেটে যান। বিশেষ করে নিউমার্কেটের বাইরের দোকানগুলো থেকে ওদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে সংসারের প্রয়োজনীয় ও ওদের মা-মেয়ের শখের জিনিস কেনেন। বয়সে রাফেয়া সানজিদা বেগমের সমবয়সী। তাদের দু’জনেরই সেই তরুণী বয়সের রসিকতা এখনো চলে। তবে রয়েসয়ে। সানজিদার থেকে পরিমিতি বোধ রাফেয়ারই বেশি। তাই তারা মা-মেয়ে সানজিদা-মোর্শেদ দম্পতির পরিবারের অংশ হিসাবে এতোদিন একনাগাড়ে টিকে আছে।
আর আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাওয়ার সুযোগ যখনি পান, মোর্শেদ, সানজিদার দু’পক্ষের যার বাসায়ই যাওয়া হোক, তাদের জন্য সানজিদা বেগম কতরকম খাবার রান্না করে, তাদের সবার জন্য কত উপহার কিনে নিয়ে যান। এই যাওয়াতে সানজিদা কখনো সুখিকেও রেখে যান না। প্রতিবন্ধী মেয়েটির দিকে বিশেষ খেয়াল তিনিই রাখেন। যদিও রাফেয়াকেও কম সতর্ক তিনি করেন না! সানজিদা যখনি যেখানে যান, যেন উৎসব লেগে যায়। তিনি রাফেয়াকে বলেন, এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে জীবনকে নতুন করি। আর সে নতুনত্বের ভাগ দিতে তোদেরকেও সাথে রাখি। তাতে আমার আনন্দটা আরো বাড়ে।
বিছানায় পড়ে থাকা সানজিদা বেগমের নিজেকে পাথরের মতো ভার মনে হচ্ছে। আর রাফেয়া সানজিদার কাছে তার সমস্যার কথা বলেই খালাস্! আগের দিনই সে পনেরদিন পর গ্রামের বাড়ি, অর্থাৎ সানজিদার শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে। খোঁজ ও নানান উপাত্ত নিয়ে এসেছে তার বাবার বাড়ি থেকেও। রাফেয়া জানেন একসময় তার বোবা-নির্বোধ মেয়ে সুখিকে নিয়ে তাকে এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতে হবে। তাই গ্রামের বাড়িটির প্রতি সানজিদা বেগমের থেকে রাফেয়ারও টান কম নয়।
রাফেয়া দুঃসংবাদটি সানজিদার কানে তুলে দিয়েই ভাড়ার এবং রান্নাঘর সে বরাবরের মতো তার নিজের মতো করে সব আবার ঢেলে সাজাচ্ছে আর বোবা-কালা মেয়ের প্রতি সংসারের জিনিসপত্র এলোমেলো রাখার জন্য বিষোদ্গার করে যাচ্ছে। নতুন যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা যেন এখন তার কাছে কিছু নয়। যেন নিজের মাথার ব্যথা গৃহকর্ত্রীর মাথায় তুলে দিয়ে সে খালাস!
সানজিদা বেগম বিকেল নাগাদ বহু কষ্টে কুণ্ডলি ছাড়িয়ে উঠে বসলেন। বাড়ির কাজের লোকের মেয়ের অবৈধ গর্ভধারণ, এতে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু সে দায় তিনি এড়ানই বা কি করে! মেয়েটি তো তারই দায়িত্বে ছিলো। সে বাইরেও কোথাও যায় না। তারা কেউ বাসায় না থাfকলে সে লকড অবস্থায় থাকে। তাহলে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে তার নিজের ভাই! সানজিদা বেগম ভাবতেও পারেননি এমন একটা রুচিহীন জানোয়ারকে তিনি সন্তান স্নেহে বাড়িতে পুষে রেখেছেন। আর তা না বুঝে এতো বড় বড় ঘরে তিনি তার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন! কত বড় গলা করে মানুষের কাছে ভাইয়ের সাফাই গাইছেন! স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি সবখানে সেরা রেজাল্ট। পাঁচ ভাইবোনর সবার ছোট সে…! গাঁয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবা কয়েক বছর আগে গত হলেও মা আছেন এখনো সব আগলে।
নিজের বিয়ের বিষয়ে তৌহিদ বড় বোনকে বলে দিয়েছে, আপনার পছন্দই আমার পছন্দ আপা! তবে আর তিন ভাইয়ের বউয়ের থেকে আমার বউ যেন রূপ ও যোগ্যতায় খাটো না হয়!’ ছোট ভাইয়ের থেকে এতখানি নির্ভরতা পেয়েই সানজিদা বেছে বেছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। যেন ভাইটি তার ওপর আস্থা না হারায়।
সুখি না হয় বোবা, কম বুদ্ধির। কিন্তু রাফেয়া? তা ছাড়া এতোগুলো ফ্ল্যাট এখানে। এত মানুষ এখানে, ডজনখানেক কেয়ার টেকার। একযুগ হয়ে গেছে ভাড়াবাড়িতে থেকে তারা ধানমণ্ডিতে এই ফ্ল্যাটটি কিনে এখানে উঠেছেন। একযুগ ধরে এখানে বসবাসের সূত্রে সবাই চেনাজানা হয়ে গেছে। এখন তাদের কানে এই খবরটি কোনোরকম পৌঁছুলেই তারা সাথে সাথে তৌহিদের সাথে ওই বোবা মেয়েটির বিয়ে দিয়ে ছাড়বে। এর বিকল্প পরামর্শ কেউই বাৎলাবে না। গা গুলিয়ে ওঠে সানজিদা বেগমের। নিজের অজান্তে তিনি উঠে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা নেন।
সানজিদার বিয়ের বয়স বিশ বছর। তার বিয়ের তিন চার বছর আগে সুখির জন্ম। শ্বশুর মারা যাওয়ার দশ বছর পর শাশুড়ি মারা গেলে সানজিদা তাদেরকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কারণ রাফেয়ারও তখন কাঁচা বয়স। তারপর চাকরিতে ঢুকেছেন। সেই সুবাদে তাই তিনি তাদের মা-মেয়ে দুজনকেই অরক্ষিত অবস্থা থেকে তুলে এনেছিলেন নিজের কাছে সুরক্ষিত রাখতে। তার উদ্দেশ্য শুধু বাসায় কাজের লোকের অভাব পূরণ করা ছিলো না। সানজিদা বেগম কতবার রাফেয়াকে বলেছেন, তোর মেয়েটা সুস্থ হলে ওকেই আমি আমাদের পরিচয়ে মানুষ করতাম…! যাদের পনের/ ষোল বছরে বিয়ে হয়, তাদের বিশ বছর বয়সের আগেই তারা মা হয় না? আমারও তেমন হতো। একটা বড়সড় মেয়ে থাকতো আমার।
রাফেয়া বলতো, আপনিই তো ওরে পালতিছেন ভাবি! কী না দেচ্ছেন! আমার কি এর কিছু সাধ্য ছেলো?
সানজিদা তখন বলতেন, স্কুল-কলেজে তো পড়াতে পারলাম না! একটা মেয়েকে সাজিয়ে-গুছিয়ে হাত ধরে নিজের সাথে স্কুলে নিয়ে যাবো, দৃশ্যটা ভাব্, কি শান্তির? ভেবে দেখ, আল্লাহ আমাকে কী সুখ থেকে বঞ্চিত করলেন!
রাফেয়ার সেই একই ধাঁচের উত্তর, আপনি না থাকলি কিডা নেতো ওর ভবিষ্যতের দায়িত্ব!
বাথরুম থেকে বিছানায় এসে সানজিদা ডাকলেন রাফেয়াকে। তাকে বললেন, বিষয়টা যে সত্যিই এটা বুঝলি কী করে?
: পনের দিন পর আমি কাইল আইছি, আসার পর ওরে দেহেই তো আমি চমকে গিছি! আর ইসেব কইরে দেখলাম চার মাস ওর মাসিক অয় না। ভাবছিলাম তা এমনি! কিন্তু ওয়ারে দেইহে বুজতিছি তা এমনিই অবে না বাবি! আপনি তো ছামনে আছেন, তাই বোজেননাই।
: চারমাস মাসিক হয় না?’ রাফেয়ার এই কথাতেই চমকে উঠলেন সানজিদা। তারপর বললেন, আচ্ছা তুই যা। যা করছিলি কর গিয়ে কাজগুলো সার্!
: আপনি কিছু তো খালেন না? এতক্ষণ তো না খাইয়ে থাহেন না তো কোনিদিন!
: পরে খাবো, তুই যা!
তৌহিদ তার ভাই এটা তার ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি তো ঘটেছে তার ছত্রচ্ছায়ায়। তিনি সে দায় কাকে দেবেন! মোর্শেদ শুনলে কেমন হবে! আর না শুনিয়েই বা তিনি কী করবেন! এত বড় দুর্ঘটনা একা ক’দিন চাপা দিয়ে রাখবেন?
তিন সপ্তাহের জন্য অফিস থেকে কোরিয়া গেছে তৌহিদ। বিষয়টি কী করে তার কাছে তুলবেন ভেবে পাচ্ছেন না সানজিদা। দেশে থাকলে খবরটা শোনামাত্র এতক্ষণ তার অফিসে গিয়ে হলেও অথবা ডেকে এনে তাকে জুতো পেটা করতেন।
সানজিদা বেগমের এভাবেই ক’দিন গেলো। তিনি অবদমিত হয়েই থাকলেন। যে রাফেয়াকে তিনি সব সময় নিজের ডানহাত ভেবে এসছেন, তাকেই এখন তার দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভয়। কখন কী বলে, তার কাছে কী প্রতিকার চেয়ে ফুঁসে উঠে সে জন্য।
দুর্ঘটনাটি জানার দিন পাঁচেক পর তৌহিদ ফোন করলো। ওখানে গিয়ে আগেও সে ফোন করেছে। তাই নাম্বারটি তার নামে সেইফ করাই ছিলো। তাই প্রথমে সানজিদা বেগম ফোন ধরতেই চাননি। কিন্তু পরপর কয়েকবার রিং বাজার পর না ধরে পারলেন না।
তারপর যখন গম্ভীর হয়ে কথার উত্তর দিতে শুরু করলেন, তৌহিদ ওপাশ থেকে ভয় পেয়ে গেলো। বারবার জানতে চাইলো, আপা, আপনার কী হয়েছে?’ সানজিদা বেগম তখন আরো চুপ হয়ে গেলেন। ফোনের এপাশের টানা নীরবতা তাকে শঙ্কিত করে তুললো। সে অনুরোধ করে বললো, আপা যা-ই হয়েছে, যা-ই ঘটুক আমাকে খুলে বলেন। কী দুর্ঘটনা ঘটলো, যে আমাকে বলতে পারছেন না? আপনি ভালো আছেন তো? দুলাভাই? আর সবাই? তৌহিদ নিজেও ভাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাত্র ক’দিন আগে সবাইকে সে ভালো দেখে গেছে।
একসময় সানজিদা বেগম বললেন, ‘সুখির পেটে মাস চারেকের বাচ্চা!’
: ও মাই গড! তো তা নিয়ে আপনি এতো ভেঙে পড়ছেন কেন? সে দায় তাদের!’ তৌহিদ বললো।
: সে দায় তাদের মানে? ও মেয়ে ঘর থেকে বেরোয়?
: সেটা আমি জানবো কী করে? আপনি আমার দিকে আঙুল তোলার সাহস দেখাচ্ছেন কী করে? হতে পারি আমি আপনার ছোট ভাই, তাই বলে আপনার ইচ্ছে মতো এতো নীচ আপনি আমাকে ভাবতে পারেন না আপা! আপনি আমাকে কাছে রেখে ভাল খাইয়ে-পরিয়ে কৃতার্থ করতে করেছেন…।
: তুই বলছিস্, এরজন্য তুই দায়ি নস্?
: এবস্যুলেটলি…। ছিঃ ছিঃ…! আমার বমি পাচ্ছে আপা!
বলেকয়ে ফোন রাখার সুযোগ হলো না। সানজিদা বেগমের হাত থেকে ফোটা খসে পড়ে গেলো ফ্লোরে। তিনি আর তা সহসা তুলতে পারলেন না। তার পুরো শরীর অবশ হয়ে এলো। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি যে খাদে পড়েছিলেন, এটাই তার শেষ তল! সুখির পেটের বাচ্চা এখন আর নষ্ট করার সময় নেই। সুখিকে সরাসরি একটা দামি ক্লিনিকে নিয়ে তা তিনি পরশু জেনে আসছেন। ক্লিনিক থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনি ভাবছিলেন, মানে নিজেকে তিনি মনে মনে প্রস্তুত করলেন, তিনি ভালোভাবেই সুখির এই বাচ্চা তিনি প্রসব করাবেন। তারপর তাকে নিজের পরিচয়ে বড় করবেন। আর রাফেয়াকে বলবেন, উচ্চবাচ্য না করতে। বিনিময়ে তিনি গ্রামে যা জমি আছে সবসহ বাড়িটি তাকে ও সুখিকে লিখে দেবেন। সুখির পেটের সন্তানটি অবৈধ সম্পর্কের ফসল হলেও তার নিজের রক্ত ও সন্তানে মিশ্রিত বলে একটু টানও মনের কোনায় জেগে উঠছিলো। এই ক’দিন ধরে ভেতরে ভেতরে তার যে ভাঙচুর চলছে, তার একটুও তিনি স্বামী মোর্শেদ রহমানকে বুঝতে দিতে চাননি। কিন্তু তার সতর্ক অবস্থান ভেদ করে মোর্শেদ রহমান ক’য়েকবারই তাকে আক্রমণ করার মতো জানতে চেয়েছেন, তোমার কী এমন হলো যে আমি জানতে পারি না? পৃথিবীতে সমাধান নেই এমন কোনো সমস্যা আছে নাকি? তুমি আমাকে বলো? না বললে, ভাববো, আমার ওপর এই বিশ বছরেও সম্পূর্ণ আস্থা তোমার আসেনি!
মোর্শেদ রহমানের কথার ওপর সানজিদা বেগম মেজাজে ফুরফুরে ভাব আনার চেষ্টা করেছেন। হোন তিনি স্বামী। কিন্তু সত্যটা বলে দিয়ে কী করে নিজের ভাইটিকে এতো নিচে নামাবেন। মাঝে মাঝে নিজেকেও তার দোষী মনে হয়েছে, মেয়েসহ রাফেয়াকে যখন তার রাখতেই হয়েছে, তখন তৌহিদকে তার কাছে রাখা ঠিক হয়নি। অন্তত চাকরি পাওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়া উচিত ছিলো। তা না দিয়ে তার পুরনো খাট বাতিল হওয়ার পর বড় দেখে খাট কিনে দিয়ে বলেছে, ক’দিন পর বউ আসবে। তখন কি আবার তার জন্য খাট কিনবো? তাই তো বড় এবং দামি খাট এনে দিলাম। এবার তুই তোর রুমের চেহারা আস্তে আস্তে পাল্টে নে!
তৌহিদের থেকে স্পষ্ট জবাব পাওয়ার পর থেকে সানজিদা উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠলেন। কারণ তিনি নিশ্চিন্ত হলেন, বোবা, ভ্যাবলা মেয়ের পেটের ও বাচ্চা তৌহিদের নয়! কদিন ধরে যাকে জীবনের চূড়ান্ত বিপদ বলে জেনেছিলেন, এখন তিনি তারচে গহীন খাদে পড়লেন। যেখান থেকে পরিত্রাণের পথ নেই। কারণ তিনি তাহলে এতদিন মিথ্যে জানেন যে তার স্বামী চিরকালের বন্ধ্যা!
তাদের বিয়ের পর বছর তিনেক তারা বাচ্চা চাননি। কিন্তু চাওয়ার আরো দু’বছর পেরিয়ে গেলেও যখন বাচ্চা হলো না। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে ক্রমান্বয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করালেন। ওদের বাচ্চার জন্য যাদের বেশি চাপ ছিলো সেই ওর শ্বশুর-শাশুড়িকে তাদের পুত্র মোর্শেদ রহমান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, সমস্যাটা তার নিজের। কোনোদিনই তার বাবা হওয়ার সাধ্য নেই। অতএব তার সন্তানের জন্য যেন তার মা-বাবা, ভাই-বোনেরা আর হাহাকার না করেন।
যেহেতু ত্রুটিটা স্বামীর। তাই তার পৌরুষে আঘাত না লাগে, রেজাল্ট শোনার পর থেকে সানজিদা কথাবার্তায় সবসময় সমঝে থাকেন। উচ্চকণ্ঠে কখনো রিপোর্ট দেখতেও চাননি! তিনি দু’একবার রিপোর্টের কথা বললে, তিনি বলেছেন, ওই অলুক্ষুণে প্রমাণ মানুষ ঘরে রাখে নাকি, সারাক্ষণ কাঁটার খোঁচার মতো বুকে বিঁধতে! আমি ওটা ছিঁড়ে ফেলেছি। আমি তো পরীক্ষাই করতে চাইনি। ভাবছিলাম যার ত্রুটি হয় হোক। না জেনেই আমরা জীবন পার করে দিই! কিন্তু কি হলো? তুমি আমাকে দাগী প্রমাণ করে তবে ছাড়লে! এরপর যদি এ নিয়ে আর একটা কথা শুনি, আমি কিন্তু জঙ্গলে চলে যাবো!
সত্যি সত্যি স্বামীর এমন হুঁশিয়ারীর পর সানজিদা খুবই সংযত হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি তার তার নিঃশ্বাসটিও তিনি সাবধানে ফেলেছেন। যেন তা তার স্বামীর কানে দীর্ঘ না শোনায়। কিন্তু আজ তার কী হলো, সে মরিয়া হয়ে মোর্শেদ রহমানের যত কাগজপত্র ছিলো তার ভেতর থেকে সেই রিপোর্ট তিনি খুঁজে বের করলেন। বারান্দার আলোতে চোখের সামনে মেলে ধরে যা তিনি বুঝলেন, তার পায়ের নিচের মাটি দুলে উঠলো। তবু তিনি মোর্শেদ রহমানের বন্ধু ডা. তানভীরকে ফোন করলেন। সানজিদা ডা. তানভীরকে বললেন, আপনার সাজেশনেই তো আমরা পরীক্ষাগুলো করেছিলাম। যেখান থেকে করাতে বলেছিলেন, সেখানেই করিয়েছিলাম। তাহলে রিপোর্টও আপনি জেনেছিলেন নিশ্চয়?
ডা. তানভীর বললেন, হ্যাঁ! কিন্তু এতো বছর পরে সে রিপোর্ট নিয়ে কিসের কথা?
: আপনি সত্যি করে বলেন আমাদের দু’জনের ভেতর ত্রুটিটা কার ছিলো?
ডা. তানভীর থতমত খেলেন বুঝতে পাছেন সানজিদা। তিনি তানভীরকে অনুনয় করে বললেন, আজ সত্যিটা আমার বড় জরুরী ভাই। প্লিজ…!
: শোনেন ভাবি, আমি জানি না আপনার এই সত্যিটা জানার জন্য এতো বছর পর কেন জরুরী হয়ে উঠলো! তবে আমি প্রমিজ করেছিলাম, শুধু আপনাকেই নয়, কাউকে কখনো বিষয়টা না জানাতে।
: আপনার মনেহয় এই ক্ষুদ্র একটি বিষয় আমি হজম করতে পারবো না?
: ভাবি, বিষয়টি শুরুতেও ক্ষুদ্র ছিলো না। এতো বছরে এটা আরো অনেক বড় বিষয় হয়ে গেছে। তাই আপনার হজমশক্তির ক্ষমতায় কুলোবে না জানার পর এটা হজম করতে!
: তবু কোনরকম বিব্রতকর অবস্থায় আপনি পড়বেন না। কথা দিচ্ছি।
: কথা দিলেও আপনি রাখতে পারবেন না ভাবি। আমি জানি। কারণ এতো বছর পর এমনিই প্রশ্নটা আপনার মনে জেগেছে, আপনার কন্ঠ তা বলছে না। যা হোক গড ব্লেস ইউ…। ত্রুটি আপনার ছিলো। কিন্তু মোর্শেদের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। পরীক্ষাটা যেহেতু আপনারা ভারত থেকে করেছিলেন, আমি ছাড়া এ দেশে আর কেউ জানে বলে মনে হয় না!
কোনোদিন কারো কাছ থেকে একবিন্দু বুদ্ধি ধার নেননি সানজিদা। এমন কি স্বামীর নামের অংশ পর্যন্ত নিজের নামের সাথে জোড়েননি তিনি। কিন্তু তাকে দেখলে কেউ বুঝে উঠতে পারেন না, মনে মনে যে কোনো বিষয়ে তিনি কতোটা দৃঢ়। তার চারপাশে যারা আছে, যেই তার ওপর নির্ভর করে সবাইকে তিনি নিজের ভাবনার ভেতর রাখেন। শ্বশুরবাড়ির সব জমিজমা মোর্শেদের ভাইবোনেরা সবাই যখন বিক্রি করে দিলো, সানজিদা সম পরিমাণ মাঠের জমি ছেড়ে দিয়ে বাড়িটা নিজের করে রাখলো, যেখানে রাফেয়া বেঁচে থাকলে তার মেয়েকে নিয়ে থাকতে পারে। সুখিসহ আজো যে তিনি রাফেয়াকে নিজের কাছে রেখেছেন, সেটা গ্রামের খোলা বাড়িতে কেউ তাদেরকে উত্যক্ত না করে, প্রথমত সেজন্য। আর সেই দুর্ঘটনা কিনা তারই ছত্রচ্ছায়ায় ঘটলো!
গোপালগঞ্জের ঘোষেরচরের ওই বাড়িটাতে শেষ পর্যন্ত রাফেয়া তার মেয়েকে নিয়ে থাকবে, আর তারপরেও কে-ই বা আসবে ও বাড়ির দাবি নিয়ে, এটা জানার পর কেউ কেউ রাফেয়ার বোবা নিবোর্ধ মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু রাফেয়া রাজি হয়নি। বলেছে, দুই-দুইডা বিয়া বইসা আমি দেখছি। বিয়া মজা না! কেউ আমার বোবা-বোকা মাইয়েরে বিয়ে কইরে দুই’একটা বাঁদাইয়ে দিয়ে বাগবে, শ্যাষে তা আমারই মানুষ করতি অবে। আমি আর কয়দিন! তারচে’ আমি চাই আমার আগে আমার ও মাইয়ে মরুক! আমি নামাজ ফড়তি বইসেও সেই দুয়া হরি। নিজির সুন্তানের নিরাপদ মরণ কামনা…।
বিভিন্ন সময়ে ডাক্তারের দেয়া ঘুমের বড়ি বাসায় এখানে-ওখানে পড়েই থাকে। তারই দুটো খুঁজে নিয়ে মুখে দিতে গিয়েও সানজিদা বেগম সে বড়ি ফেলে দিলেন। তিনি ভাবলেন, এখন কী সুখে তিনি গভীর ঘুম চাইছেন! তাকে তো বিপুল প্রতাপ নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে বিষয়টির সাথে! যাকে তিনি সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর ভেবে রেখেছেন, যে তার হাসিখুশি মুখখানা দেখতে মরিয়া হয়ে থাকে, আজ তাকেই তার বেশি ভয়। কারণ অস্ত্রে যে শান দেয়, সেই তার ধার জানে! তাই রাফেয়ার ধার তার জানা। বিশ্বস্ত হলেও সে অধিকার সচেতন লড়াকু এক নারী। আর তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন, রাফেয়ার যে দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিলো, সতীনের যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে নিজেই সে চলে এসে আর যায়নি। কিন্তু ছাড়াছাড়ি তাদের হয়নি। তাই সেই লোক মারা গেলে একাই লড়াই করে তার ভাগের সম্পত্তি সে বের করে তবে ছেড়েছে! তাই পরাস্ত তিনি যুদ্ধটা করছিলেন কেবল নিজের সাথে!
সানজিদার এমন ঘনঘোর অবস্থার ভেতর রাফেয়া এসে বললো, ভাবি, আপনি মাথার উপর আছেন বইলে আমি নিশ্চিন্তি। কিন্তু তাই বুইলে আমি তো হতভাগির মা! সেদিন তো শুনলামই ডাক্তার কলো, এহন আর ও বাচ্চা ফেলানোর সুমায় নাই। কিন্ত আপনি কী সমাধান বাবলেন, বাবি?
সানজিদা বুঝলেন, ভাবনাটা তার একার নয়। রাফেয়া তার দিকে খেয়াল রাখছে। তার মনে হলো কেউ তার রক্তে রাশি রাশি বরফ ঢেলে দিয়েছে।
অনেকক্ষণের নীরবতা ভেদ করে রাফেয়া আবার বলে ওঠে, আমি এক অক্ষম মা! আসল মা তো আপনিই…!
রাফেয়ার কথা শুনে সানজিদা বেগম ষষ্ঠেন্দ্রয়ের সমস্ত অনুভূতি এক করে, যেন গভীর ঘন ধোয়ার ভেতর একদানা লাল কুঁচের মতো আগুনের এতটুকু ফুলকি ফোটানোর মতো বলে উঠলেন, আমি তোর পেটেধরা প্রতিবন্ধী মেয়ের মা হলেও কোনো পুরুষ তো জন্ম না দিয়ে কারো বাবা হতে পারে না, সেটা তোরও বোঝা উচিৎ ছিলো!
সানজিদার এ কথার মানে রাফেয়া বুঝলো না। কারণ সে জেনে এসেছে, বাড়ির আরেকজন পুরুষ, তার শ্রদ্ধেয় বড় ভ্রাতৃপ্রতিম মোর্শেদ রহমান আজন্ম বন্ধ্যা! তাই রাফেয়ারও লক্ষ্য ওই সানজিদার নওল ভাই তৌহিদ! কিন্তু রাফেয়াকে কথাগুলো বলতে সানজিদার নিজের কণ্ঠ নিজের কাছে আর্তনাদের মতো শোনালো। তার যে সমাধান এখন মাথায় খেলা করছে। আর সে খেলা বড় নিষ্ঠুর খেলা। তবুও তিনি একবেলা তো বুঁদ হয়ে ছিলেন এই ভেবে, চৌদ্দ পনেরো বছর পর্যন্ত মোর্শেদ তাকে জানতে দেয়নি, আসলে সানজিদারই মা হওয়ার ক্ষমতা নেই! তার হৃদয় এতেই আদ্র হতে হতে তা নদী হয়ে ওঠা দূরে থাক, বর্তমান ঘটনায় নিমজ্জিত তার হৃদয়জুড়ে মরুভূমির শূন্যতা। রৌদ্রতপ্ত বালির দুঃসহ তাপে সে ঝলতে যাচ্ছে!
অথচ এতোটা বছর তাকে ঘিরে ছিলো জলন্ত আগুনের মতো প্রমাণিত ভালোবাসার নহর। অথব জীবন তাকে অবকাশ দিলো না তার ভেতর কিছুটা সময় বসবাস করার। আজ সে বড় একা। কেউ নেই তার পাশে। কিন্তু শত হলেও পুষ্প-পল্লবে তিনি স্বামী মোর্শেদের জীবন ভরা দেখছেন। যেন সৃষ্টিকর্তার উপহার হিসাবে তার জন্য পাঁকে ফুটতে যাচ্ছে একটি স্বর্ণ কমল। আর সেখানে সানজিদার নিজেতে অতি তুচ্ছ মনে হয়। এতোদিনের যে ভরা সংসারের সফল গিন্নী তিনি নিজেকে সাজিয়ে রেখেছিলেন, সে সংসারের সব আজ তার কাছে ছাই!
রাফেয়া কিছুক্ষণ পর আবার এসে সানজিদার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, বাবি, সুখিরি তো আপনারা সব সুমায় তালা বন্দ করেই রাকছেন, তাই নে! আর আমিই তো ছয়মাস পরে সেদিন দ্যাশে গেলাম। দিন পনারো দিন থাকলাম। কিন্তু গটনা তো দেহা যায় আমি থাকতিই…। এমন এট্টা গটনার সুমায় আমিই বা কুহানে ছিলাম!
সানজিদা বেগম এবার সুযোগ পেয়ে ধমকে উঠলো, তাই তো? তুই কোথায় ছিলি?’
রাফেয়া কাচুমাচু করে সানিজিদার সামনে থেকে সরে গেলো। কিন্তু সানজিদা মনে মনে ভাবলো, নজর যদি কারো পড়েই থাকে কারো ওপর, তাকে পাহারা দিয়ে কি আটকানো যায়! রাফেয়াকেও তো বাজার করা থেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি কতখানে তিনি নিজেই পাঠান। তিনি নিজেও থাকেন স্কুলে। যা ঘটে গেছে এখন তা নিয়ে লগ্ন ও প্রমাদ গোণার মানসিকতায় তিনি আর আটকে নেই। আজ ফাঁকে ফাঁকে তার নিজের মায়ের কথাও মনে পড়ছে। মা বলতেন, মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখানোর কারণ, তারা এমনিতে চাকারবাকরি না করলেও যেন জীবনের যে কোনো সময়ে প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে পারে! যে সব মেয়েরা যে কোনো কারণে অত্মহননের পথ বেছে নিতো, মা তাদের ধিক্কার দিতেন। নিজের মেয়ের সাথে অন্যান্য মেয়েদের ডেকে বোঝাতেন, যার সাথে জীবন যাপন করবে, তার দ্বারা অসম্মানীত, অসুখি বোধ করলে, তুমি তোমার জীবন নিয়ে সরে যাবে। পরের ওপর নির্ভর করে সুখের জন্য বেঁচে থাকা, সে সুখ প্রকৃত সুখ নয়, ওর নাম আধমরা হয়ে বেঁচে থাকা। এই বিশ্বাসটি তোমাদের এখন থেকেই লালন করতে হবে।
বিকেল নাগাদ জরুরী ভিত্তিতে সানজিদা বেগম তার বড় ভাইকে বললেন, তোমার নতুন ফ্ল্যাটের জন্য যে ভাড়াটিয়া খুঁজছিলে…।
: ভাড়াটিয়া পেয়ে গেছি! গতকাল এডভান্স করে গেছে।
: টাকাটা ফেরত পাঠাও। ওটা আমি নিচ্ছি!
: তুই নিচ্ছিস মানে?
: তৌহিদের জন্য মেয়ে খুঁজে পেয়েছি। ও ফিরলে বিয়ে। আমি ওখানেই ওর জন্য সংসার সাজাতে থাকি…!
: আমি ভাবলাম আচমকা মোর্শেদের সাথে ঝগড়া হয়েছে তোর!
: বিশ বছরে শুনেছো কখনো?
: নায়া!
: আশ্বস্ত থাকো। বাকি জীবনেও হবে না! ঠিকাছে, তুমি লোক পাঠিয়ে একটু পরিস্কার করে রাখো। আমি সন্ধ্যায়ই কিছু জিনিস নিয়ে যাচ্ছি একবার। আর শোনো ভাইয়া, এ কথা তুমি কাউকে বলতে যেও না। তৌহিদকে বিয়ে দিয়ে যে আমার কাছে রাখবো ভেবেছিলাম, তোমাদেরকে বলেছিলামও তাই। এখন ভাবলাম এই ভালো…। তাই হঠাৎ কেউ এমনটি জানলে মনে করবে ভাইবোনে ঝগড়া হয়েছে!’ একটা সত্যকে ঢাকতে আরো কীসব কথা বড়ই রয়েসেয়ে বলতে হলো সানজিদা বেগমকে। নাহলে বিষয়টা ছড়ানোর বিপাক তার ওপর এসে পড়বে, সেটা খুবই মর্মান্তিক লজ্জার হবে তার জন্য।
বড়ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে সানজিদা আলমারির ওপর থেকে ছোট-বড় সব সুটকেসগুলো নামালেন। রাফেয়াকে বললেন, আমার সাথে আমার শাড়ি-জিনিসপত্র স-ব সুটকেসে ভর…!
রাফেয়া আঁৎকে উঠে বললো, ও বাবি, ও আল্লাহ্ আমারে এই পিপদে ফেলাইয়া আপনি কোনোহানে যাতি পারবেন না! তাঅলি কিন্তু আমি চেঁচাবানি!’
সমাধান মনের মতো নাহলে যে রাফেয়ার মূর্তি ভিন্ন হয়ে যাবে, সে চেঁচিয়ে মানুষ ডেকে এক করবে তা ভালোই জানেন সানজিদা। কারণ তিনি নিজেই তো সাথে রেখে তাকে প্রতিপদে সচেতন করেছেন আর বলেছেন, দেখ রাফেয়া, অন্যখানে কাজ করলে ভাত-কাপড় পেতি, কিন্তু এমন সত্যজ্ঞান অর্জন করা তোর সম্ভব হতো না!
এখনি রাফেয়ার এমন কথা শুনে ভড়কে গেলেন সানজিদা! তিনি বললেন, আমার ওপর আস্থা রাখ্ রাফেয়া! আচ্ছা, শোন্, তুই কি ওকে জিজ্ঞেস করছিলি…। কে…।’
: না, ওরে ডাহি আপনার সামনে। আপনি জানতি চান! ও আপনি তো ওর বাষা বোজবেননানে! তবু ডাহি, আপনার সামনেই আমি জানতি চাই আপনি বুজার চিষ্টা হরবেন। কিন্তুক বাবি, আমার মনেঅয়, কিডা আবার তৌহিদ ছাড়া!
: ওকে ডাকতে হবে না থাক। বাদ দে!’ বলে সানজিদা ভাবলেন, শেষ মুহূর্তের স্মৃতিকে আর কলুষিত না করি। যেটুকু জেনেছি, তাই যথেষ্ট। জগতে এমন কষ্ট তো কেবল আমার একার নয়। চোখের সামনেই তো কত দেখলাম, স্বামী স্ত্রী’কে বিয়ে দেয়। নিজের দাসীকে সতীন করেছে, এরকম ঘটনা তিনি কয়েকটিই দেখেছেন। তখন মনে হতো, ওরা কি আর কেনো সমাধান পায়নি! আসলে এক্ষেত্রে কোনো একজনের মৃত্যু ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই! কিন্তু কাউকে মারার তো তার অধিকার নেই! তিনি নিজেকে কেবল নিজে মারতে পারেন। কিন্তু তাও বা কেন! তার তো একটা চাকরি আছে। তিনি মরার অধিক আগুন বুকে নিয়ে বাঁচতে চান। বরাররের মতো নিজের সাহসী সত্তাটা এবারও বেরিয়ে যেন তার পাশে দাঁড়ালো। যেন তার হাতে হাত রাখলো। ওই যে একজন স্বামীকে নিজের বোনের সাথে বিছানায় দেখে ফেলে তিনি সন্যাসী হয়েছিলেন। তারপর নিজের যা কিছু ছিলো, তার থেকে যার যেখানে যেটুকু প্রয়োজন দেখতেন, সেইটুকু করে তিনি তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে তুলে দিয়ে আসতেন। সেই তিনিই বলেছিলেন, অন্যের প্রয়োজনের লাগার মতো জীবনের সার্থকতা আর নাই। এই যে সমাজের নিয়ম-নীতি এসবই একটা ঘেরাটোপ। স্বামী ও বোনের ওই দৃশ্য দেখে ফেলার পর তার নাকি মনে হয়েছে, ঘেরাটোপ ছিঁড়ে সৃষ্টিকর্তা যাকে বের করে আনেন, তাকে আসলিই তিনি কোনো বিভ্রমে রাখতে চান না। তাদের জীবনটা আরো বড় কাজে লাগাতে চান। তিনি হেসে বলেছিলেন, তাই প্রতিদিনই আমি বড় কাজ খুঁজছি…। আগে ছেলেমেয়ে একটাও ছিলো না। আর এখন মনেহয় ছেলেমেয়ের আমার অভাব নেই…।’
সানজিদা বেগম রাফেয়াকে বললেন, তুই আমার সুটকেসগুলোতে আমার কাপড়-চোপড়গুলো তোল্।’ বলে শুধু তার নিজের টাকায় কেনা নতুন দামি শাড়িগুলো সুটকেসের দিকে ফেললেন, আর বোঝা না বাড়াতে যেগুলো অন্যপাশে ফেলছেন, রাফেয়াকে বললেন, এগুলো তোর!
: কপালে আমার কি আছে, আমি তো তাই জানিনে। আর আপনি আমারে শাড়ি দেচ্ছেন! তারচে’ কাফন কিনে দেন! জামেলা যাক…! আফনি এহন কী পরিকল্পনা করতিছেন বাবি, আমি কিছুই বুঝতি পারতিছি না!
সানজিদা বেগম তার বিয়ের গহনাগুলোতেও হাত দিলেন না। শুধু নিজের কেনা জিনিস, আর মা-বাবার দেয়া জিনিস থেকে হাতের কাছে যা পেলেন, তাই দিয়ে সুটকেসগুলো ভরে নিজেই টেনে দরজার কাছে নিয়ে রাখলেন। মোর্শেদ রহমান ঘরে ঢোকার আগেই তাকে বেরোতে হবে। আর একবারও তিনি তার দর্শন চান না! তিনি রাফেয়াকে পাঠিয়েছেন একটি সিএনজি ডাকতে।
কিন্তু রাফেয়া এবং মোর্শেদ রহমান একসাথে ঘরে ঢুকলেন। দরজার কাছে সুটকেস দেখে মোর্শেদ রহমান বললেন, এগুলো এখানে কেন? আর রাফেয়াই বা সিএনজি এনেছে কেন? কোথাও যেতে হলে আমি তো এসে গেছি। গাড়িতে যাও! তবে এতোগুলো সুটকেস এখানে রাখা কেন?’
স্বামীর বুকের ভেতর বল্লম ঢুকিয়ে দেয়ার মতো হীমস্বরে সানজিদা নিজের অজান্তে বলে ফেললেন, রাফেয়ার মেয়ের পেটে বাচ্চা। চারমাস পার হয়ে গেছে…।’
: তো?
: সানজিদা টের পেলেন, এই একটা অক্ষরের ‘তো’ শব্দটা উচ্চারণ করে বাইরে আনতে মোর্শেদের ঠোঁটে শব্দটা যেন আগে পিছলে ভেতরে আছাড় খেয়েছিলো!
সানজিদা আরো হীমস্বরে বললেন, আমাদের সেই রিপোর্টটা আমি খুঁজে বের করেছি। সন্তান জন্ম দিতে তুমি নও, আমি অক্ষম।
মোর্শেদ রহমানের কন্ঠে আর একটিও কথা নেই। তিনি ঘরে ঢুকেই সোফায় যেভাবে বসে পড়েছিলেন, সেভাবে ধংসস্তূপের মতোই পড়ে রইলেন। কিন্তু রাফেয়া এবার বুঝলো সানজিদা বেগমের চলে যাওয়ার বিষয়টি। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বাবি…। ও মাইয়েরে আপনি বিষ খাওয়াইয়ে মারেন। তবু আপনি গরেরতে বাইর অইয়েন না! ও আল্লাহরে আমি এহন কী করবো…!’
সানজিদার আর পিছনে ফিরে তাকানোর রুচি রইলো না। তিনি তার গোছানো সুটকেসের কথা ভুলে গিয়ে লিফটের অপেক্ষাও না করে সিঁড়ি দিয়ে হনহন করে নেমে গেলেন।