সৈয়দ হকের ছোটগল্প ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’
দৃশ্যমানতার আড়ালে অন্য কিছু
– শেখ ফিরোজ আহমদ
‘‘আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে বিশেষ একটি মানুষকে রেখে তাকে এবং পরিস্থিতিকে দেখবার চেষ্টা করেছি মাত্র।’’ – গল্পের কলকব্জা/ সৈয়দ শাসসুল হক
‘গল্পের কলকব্জা’ নামের লেখায় গল্প খুঁজতে যাওয়ার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে ওই মন্তব্য করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘গল্পের কলকব্জা’ গল্প-লিখন নিয়ে তার সম্যক অভিজ্ঞতা ও দার্শনিক ব্যাখ্যার অনবদ্য সৃষ্টি। পুরো লেখাটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে হয়। কী অবলীলায় লিখলেন- খানিকটা ঈর্ষা যে হয় না, তা তো নয়! একজন গল্পলেখক কীভাবে মানসিকভাবে তৈরি হোন, লেখেন, লিখবার প্রবণতা সঞ্চয় করেন- যদিও প্রশ্নগুলোর চেহারা সহজ মনে হয়, কিন্তু উত্তরগুলো কঠিন, তাও তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় দিয়েছেন। লেখক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার মিশেল সেগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। মনে হচ্ছিল বৈঠকি আড্ডায় তিনি বলছিলেন আর আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। ওটা তখন অন্যদের জন্যও যেন হাতেকলমে শেখার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ। যে ক্লাশের শিক্ষার্থী তিনি নিজেও। তিনি পড়তে পড়তে শিখেছেন, লিখতে লিখতে শিখেছেন, জারিত অভিজ্ঞতার কেমিস্ট্রি বিলিয়ে দিয়েছেন। কবি পিয়াস মজিদ তাঁর ‘ অপ্রতিম সৈয়দ শামসুল হক’ লেখায় বলেছেন-
‘‘গল্পের কলকব্জা’’ এবং ‘কবিতার কিমিয়া’য় এ দুইভাগে বিশিষ্ট ‘মার্জিনে মন্তব্য’। খণ্ড খণ্ড ব্যাখ্যায় তিনি বাংলা ভাষায় গল্পকার ও কবিদের জন্য গল্প-কবিতার নিগূঢ় রসায়ন, গঠনকৌশল, ভাষারহস্য ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়কে সউদাহরণে ব্যাখ্যা করেছেন। সাহিত্য যে সাধনার বিষয় সেটি নিজ অভিজ্ঞতাসূত্রে উপার্জিত বলে ভবিষ্যৎ লেখককে সে দুরূহ সাধনপথে স্বেচ্ছা-সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’’
‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’- সৈয়দ শামসুল হকের একটা দুর্দান্ত ছোটগল্প।
গল্প সংক্ষেপ-
পাটুরিয়া ঘাটে গাড়ি, বাস ও লোকজন- সবাই ফেরি জাহাজের জন্য অপেক্ষা করছে। দৌলতদিয়া যাবে। ফেরি জাহাজটি কোনো এক ডুবোচরে আটকে পড়ায় আসতে দেরি হচ্ছে। অপেক্ষার সময়টায় একজন ভদ্রলোক নিজের ড্রাইভ করা প্রাইভেট গাড়ি থেকে নেমেছেন। চা খাবেন। তিনি স্তন ক্যান্সারে মৃত স্ত্রী রাহেলার চল্লিশা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন।
সেই ভদ্রলোকটি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে এদিক ওদিক দেখছিলেন। হঠাৎ ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল প্রকৃতির চোখঅলা একজন লোকের ওপর তার দৃষ্টি আটকে যায়। ওই লোকটি কোনো বাসের যাত্রী। লোকটির চোখ বাসযাত্রী-মোটরযাত্রী এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার ওপর নাচানাচি করছে। রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটিও স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে লোকটির চোখ অনুসরণ করে তা-ই করছে। অথচ বিয়ের রাতেও তিনি স্ত্রীর দিকে ভালো করে তাকাতে পারেননি। স্ত্রী এ নিয়ে পরবর্তীতে তাকে মর্মান্তিক রকমের ঠাট্টা করেছে। বলত- ’সকলে তো আর তোমার মতো না! নিজের বউকেও যার দেখতে লজ্জা।’
হঠাৎ কী যে হলো ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল প্রকৃতির চোখঅলা লোকটি ভিড় ঠেলে চলতে শুরু করে। লোকটি যেদিকে যায়, ভদ্রলোকও তাকে অনুসরণ করতে থাকে। এভাবেই ঘটনাচক্রে বারবার জায়গা বদল ঘটছিল। লোকটার পাল্লায় পরে অনিচ্ছাকৃতভাবে ‘নজর নষ্ট মানুষ’ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন এপিসোডে ভদ্রলোকটি তিনজন নারীর বুক দেখে ফেললেন। তাদের একজন জিনসের ট্রাউজার পরা তরুণী, অন্যজন পঁচিশ বা সাতাশ বয়সী এক মা এবং শেষেরজন ছিলেন লোকটির বুড়ি মা। এই যে বুক দর্শনের অস্বস্তি এবং স্তন-ক্যানসারে মৃত স্ত্রীর প্রতি উপলদ্ধি, এই অনুতাপ নিয়েই গল্পটি লেখা।
‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ একটি নিরীক্ষাপ্রবণ গল্প
সৈয়দ শামসুল হক ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’, নামের গল্পটি উত্তম পুরুষে লিখেছেন। অনুমান হয়, মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টার দৃশ্যায়তনের সংঘটন গল্পটিতে। আখ্যান নির্মাণ যতটা না মূল লক্ষ্য ছিল, তারও অধিক ছিল চরিত্রগুলোর আচরণগত ব্যঞ্জনা বা লিভিং ভিডিওপ্রাফি। গল্প পাঠকালে যে কারোরই আগাগোড়া একটা উৎকণ্ঠা বা টেনশনের মধ্য দিয়ে মনস্তত্বের পরিভ্রমণ ঘটে যায়। যিনি পাঠ করেন তিনি নিজে যে পাঠক, এটা ভুলে গিয়ে লেখকের রূপায়ণকৃত চরিত্রগুলোর প্রতি বিচিত্র ও পরস্পরবিরোধী মিশ্র প্রতিক্রিয়ার একটা জোয়ারভাটায় তাকে ভাসতে হয়। সেই ভেসে যাওয়ার সময় নিজের ওপর কোনো কন্ট্রোল থাকে না, পুরোটাই থাকে লেখকের একচ্ছত্র দখলে। সংশ্লিষ্ট কোনো চরিত্রের ওপর যখন ক্ষোভ বা উত্তেজনায় রাগ-ঝাল মেটানোর জন্য কোনো নিন্দাসূচক মন্তব্য বা গালি পাঠকের মুখের ডগায় চলে আসে ঠিক সেই মুহূর্তেই লেখক গল্পের মধ্যে চরিত্রটির প্রতি সহানুভূতি উদ্রেককারী একটা প্রলেপমাখা বাক্য বা বাক্যাংশ নির্বিকারভাবে সরবরাহ করেন, যা ঘোরতর উত্তেজনাকে নিউট্রাল বা স্তিমিত করে দেয়। এভাবেই গল্পটি পরিণতির দিকে এগোয়। ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’-এক অদ্ভুত গল্প। যত না আখ্যান নির্ভর তার চেয়ে বেশি আঙ্গিক, রীতি, কলাকৌশল নির্ভর এবং নিরীক্ষাপ্রবণতার উদাহরণ হিসেবে বিশিষ্ট। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ছোট-বড়ো লঞ্চ, স্টিমার- যে জলযানই হোক কোম্পানির লোকজনেরা সেগুলোকে জাহাজ বলে। সৈয়দ শামসুল হকও তাই বলেছেন ‘ফেরি জাহাজ’।
উত্তেজনায় জল ঢালার কৌশল
ছোটগল্প ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ এবং জনপ্রিয় বিতর্কিত উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’, এই দুটো লেখার অন্তিমেই চমৎকৃত হওয়ার মতো এবং বক্তব্যগত একটা কনফেশনাল রিলেশনশীপ প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রসঙ্গটি এসেছে, কারণ সৈয়দ শামসুল হকের সৃজন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘কার্যকারণ’ সূত্র ব্যবহারের এটা একটা বিশিষ্ট কৌশল। ওই গল্প এবং উপন্যাস দুটিতে পাঠ-ভ্রমণকালের অভিজ্ঞতায় দেখি মন্দ মানুষের ভিতর থেকে শেষাবধি বেরিয়ে আসে একটা করে ভালো মানুষ। ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ ছোটগল্পের মূল চরিত্র রাহেলার স্বামী ভদ্রলোক বা ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটির মূলচরিত্র টিভি উপস্থাপক বাবর আলীর আখ্যান সৃষ্টির প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দুর্বৃত্ত টাইপ আচরণের অন্তিমে মানবিক অনুভবের পুনর্জন্ম ঘটানো হয়, মানুষকে মানবিক চেহারায় পুনর্নির্মাণ করা হয়। লেখকের মুনসিয়ানার বদৌলতে গল্প বা উপন্যাসটিতে পরিভ্রমণের সময়টাতে আমাদের ভেতর জন্ম নেওয়া সব রাগ ও ক্ষোভের যেন মুহূর্তমাত্র অবসান ঘটে। আমরা বোধ হয় সৈয়দ হকের অঙ্কিত চরিত্রগুলোর প্রতি একধরনের ক্ষমাশীল অনুভবে সাড়া দিতে থাকি। দিই কি? লেখনীর মায়াজালে আমাদেরকে আটকে ফেলেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ এবং ‘খেলারাম খেলে যা’-এর মধ্যেকার বক্তব্যগত কনফেশনাল রিলেশনশীপটা পরে আলোচনা করব।
এখন দেখতে থাকি ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ নামক ছোটগল্পের বাসযাত্রী লোকটির পাল্লায় পরে রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কীভাবে তিনজন মহিলার বুক দর্শন করেছে। তারা কেন আব্রু সংরক্ষণে মনোযোগী হতে পারল না, এ নিয়ে যখন সমালোচনায় বাণবিদ্ধ করা যেত তাদের। তখনই দেখা গেল লেখকের সৃজন-কৌশলের কারণে চরিত্রগুলোর প্রতি একধরনের ক্ষমাশীল দার্শনিক অনুভবে আমরা সাড়া দিই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থাৎ চরিত্র তিনটির প্রতি লেখকের সহানুভূতি উদ্রেককারী প্রলেপমাখা বাক্য বা বাক্যাংশ ব্যবহার কারণ হিসেবে কাজ করেছে। যেখানে ক্রিয়াশীল ছিল মানবিক আচরণের ‘কার্যকারণ সূত্র’-র ঐক্য গ্রন্থনা। উদাহরণ দিই? যেমন-
উদাহরণ -১: জিনসের ট্রাউজার পর তরুণী
পাটুরিয়া ঘাটে বাস, গাড়ি, প্যাসেঞ্জার ও নানা কিসিমের মানুষ ফেরি জাহাজের জন্য অপেক্ষা করছে। ফেরি এলে তারা দৌলতদিয়া ঘাটে যাবে। কেউ কেউ গাড়ি থেকে চা-নাস্তা খাচ্ছে, হাঁটছে। এইসব। দৃশ্যের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে এল-জিনসের ট্রাউজার পরা সানগ্লাস চোখে একজন তরুণী। সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে কোক খাচ্ছিল। তার বুক ফুটে উঠছিল, কিন্তু সে ছিল বেখেয়ালি বা নির্বিকার। এ নিয়ে নানা প্রকার উত্তেজক বর্ণনা গল্পে দেওয়া হয়েছে। স্রেফ অশ্লীল বর্ণনা নয়, যেরকমটা ঘটে থাকে সেরকমই। গল্পের মূল চরিত্র প্রয়াত রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটি, তিনিও দেখলেন। একপর্যায়ে কনফিউজড হোন। তরুণীকে নিয়ে নিজের ভেতরই প্রশ্ন তৈরি হয়- ‘‘নাকি কি এতোই সে সরল যে, নিজের শরীরটা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই!‘‘ এতক্ষণ দৃশ্যের মধ্যে বক্ষপ্রদর্শন নিয়ন্ত্রণ না করা বা উদাসীনতার জন্য আমাদের অভ্যস্ত সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় মেয়েটির প্রতি যে মনোভাব তৈরি হচ্ছিল, তা কিন্তু ‘‘নাকি এতোই সে সরল’’ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভাবনা অন্যদিকে মোড় নেয়। এই অংশটির নির্মাণ এরকম-
‘‘আমি মেয়েটিকে আবার দেখি। বাতাস এখনো বদমাস। মেয়েটি কী সর্বনাশা। এতগুলো মানুষের সমুখে বুকের কোনো ভাবনাই নেই তার। নাকি এতোই সে সরল যে, নিজের শরীরটা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই! একবারও কি তার চোখে পড়ছে না লোকটি তাকে অসভ্য চোখে দেখছে?’’
উদাহরণ-২: ঘামে বগল জবজবে ভদ্রমহিলা
পাটুরিয়া ঘাটে গাড়ি, বাসের অপেক্ষায় সবাই। এখানে ওখানে মানুষের খণ্ড খণ্ড জটলার মধ্যে সাদা একটি গাড়ি থেকে পঁচিশ কি সাতাশ বয়সী একজন মহিলা তার বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি ‘একটুকু একটা বাচ্চা’কে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। তার ঘাম জবজবে ব্লাউজের বগল বা খোলাবুক ব্লাউজের দিকে খুব একটা কেয়ার করছিলেন না। উপরন্তু স্বামীর সঙ্গে পরের খণ্ড-দৃশ্যে তর্ক করে বলছিলেন যে জার্নিতে এরকম হয়। দৃশ্যায়নের পূর্বাপর গল্পকার তাঁর মতো করে বর্ণনা করলেন। এবং এক পর্যায়ে পাঠকের জন্য কনফিউশনটা তৈরি করলেন- ‘‘যেন একটা গরব। গরবটা নতুন মা হবার কি নিজের যৌবন এখনো উপচে পড়া বোধেই কিনা কে জানে!’’ এতক্ষণ গল্পটা পড়তে গিয়ে যে লোভ বা লালসা উঁকি দিচ্ছিল মনে; সেখানে যেন কেউ এক বালতি পানি ঢেলে দিল। আদিম প্রবৃত্তির উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে ভাবনা তখন অন্য দিকে মোড় নেয়, ভাবখানা এরকম- আরে, তাইতো! হতেও পারে এরকম। পুরো বর্ণনাংশটি পড়া যাক-
‘‘ভদ্রমহিলা নীচু হয়ে ধরে আছে শিশুটিকে। শিশুটি বারবার বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর ভদ্রমহিলারও বুকের কাপড় পড়ে পড়ে যাচ্ছে। বাচ্চার দুধে পুষ্ট স্তনজোড়া বিশাল ফলের মতো গড়িয়ে পড়ছে নীচু হতেই। কিন্তু আঁচল তোলা তেমন বিশেষ তাড়া নেই ভদ্রমহিলার। আর হাসছে। আর বারবার গড়ানো আঁচলের কোণ ধরে চারদিকে তাকিয়ে হাসছে। খোলা বুক ব্লাউজের দিকে খেয়াল নেই, ঠোঁট মচকাচ্ছে। যেন একটা গরব। গরবটা নতুন মা হবার কি নিজের যৌবন এখনো উপচে পড়া বোধেই কিনা কে জানে!’’
উদাহরণ-৩ : কবেকার মায়ের স্তন
পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি জাহাজের জন্য অপেক্ষায় থাকার সময় রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটি ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল চোখের যে লোকটিকে অনুসরণ করতে গিয়ে ‘নষ্ট নজর মানুষ’ হিসেবে ঘটনার আবর্তে জড়িয়ে যায়। এই দৃশ্যে সেই লোকটি এবং তার বুড়ি মায়ের মধ্যে পানের পিক ফেলা ও জর্দা চাওয়াকে কেন্দ্র করে বাদানুবাদ ঘটে। বুড়ি মা পৃথিবীর মা হিসেবে প্রতীকায়িত হয়েছেন বলে ভাবতে ইচ্ছে হয়। মা-ছেলের তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে কী ঘটলো? গল্পের মধ্যে বর্ণনা তৈরি হলো- ‘‘এই বলে বুড়ি জানালা ঠেলে মাথা খাড়া করে দাঁড়ায়। তারপর বুক থেকে চাদর ফেলে দিয়ে জগৎকে দেখায়। আমিও দেখি মরা স্তন। শীর্ণ স্তন কবেকার মায়ের স্তন। কোন কতকাল শত বছরের সেই দুধেল স্তন।’’ যৌনোত্তেজনা, লোভ ও লালসার বাইরে তখন জগৎমাতার বন্দনা ও প্রীতিসিক্ত অনুভূতি মনকে দার্শনিক ভাবনায় উদাসীন ও দ্রবীভূত করে। দৃশ্যটি বুঝবার জন্য সংশ্লিষ্ট এপিসোডটি পড়া যাক-
‘‘লোকটি বিদ্রুপ করে বলে, দুধের খোটা আর কত দিবা? শুকায়া গেছে!
বুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাসের জানালা দিয়ে শীর্ণ শরীরের প্রায় সবটা বের করে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে আভাগির পুত, এই বুকে অখনো দুধ আছে। জগৎ খায়া শেষ করতে পারবো না এত দুধ। তুই তো তুই। নাদানের বাচ্চা নাদান। তর মতো হাজারটা পোলারে অখনো আমি দুধ দিবার পারি।’’
কনফেশনাল রিলেশনশীপ
সৈয়দ শামসুল হকের প্রতিটি সৃজনেই নতুনত্বের অভিপ্রায় প্রস্ফুটিত থাকে। আগের লেখা একরকম লিখলে পরের লেখাটি অন্যরকম লিখতেন- কী বিষয়বস্তুতে, কী আঙ্গিকে, কী নিরীক্ষাপ্রবণতায়। তাঁর সৃজিত সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট। যে জন্য এই কথাগুলো আসছে, তা হলো ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ এবং ‘খলারাম খেলে যা’র বিষয়বস্তু নির্বাচন, আখ্যান নির্মাণ ও কৌশলের ক্ষেত্রে তিনি অতিমাত্রায় দুঃসাহস করেছেন। মানুষের মনের গড়ন- নানা রঙ ও রেখায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ওই দুটি লেখায় যবনিকা টানবার বেলায় এই রঙ পরিবর্তনের খেলা দেখতে পাই। শেষ বেলায় দারুণ চমক ও মানবিক স্বীকারোক্তির সামঞ্জস্যতা পুরো ব্যাপারকেই মোচড় দিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যায়। পাঠ-ভ্রমণকালে যে মন্দ মানুষটিকে দেখা যাচ্ছিল শেষটায় বেরিয়ে আসে একটা অন্যরকম ভালো মানুষের চেহারা- কার্যকারণ সূত্রে সৃষ্ট চরিত্রের বিচিত্র আচরণের ব্যাখ্যা উন্মোচিত হয়। রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটির বা টিভি উপস্থাপক বাবর আলীর আখ্যান সৃষ্টির প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত দুর্বৃত্ত টাইপ আচরণের অন্তিম পরিণতিতে যে মানবিক উপলদ্ধি- তাও সেই মোচড়েরই টেকনিক। গল্প ও উপন্যাসের পাঠান্তে অনুভবে শুধু থেকে যায় সৃষ্ট দোটানার অমীমাংসা।
যেমন- ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটি অন্য বাসযাত্রীটিকে অনুসরণ করতে গিয়ে লম্পটের মতো তিনজন মহিলার স্তন দেখলেন। শেষেরজন অর্থাৎ বুড়ি ম ‘র শীর্ণ দুধ দেখবার আগে তার ভেতরে কনফেস তৈরি হলো। উত্তম পুরুষে গল্পাংশ থেকে তার স্বীকারোক্তির ধরনটা দেখা যেতে পারে-
‘‘এতক্ষণে আমি হদিস পাই কেন আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। কেন ওই লোকটিকে আমার পছন্দ হচ্ছিলো না। ওই লোকটির জন্যেই তো যা কখনো দেখি নাই তাই-ই আজ আমাকে দেখতে হলো।
আমি কি তবে নজর নষ্ট মানুষ হয়ে যাচ্ছি এতদিন পরে আজ এই নদীর পারে, ফেরি- জাহাজের অপেক্ষায় ভিড়ের ভেতরে? জিনসের ট্রাউজার পরা ওই মেয়েটি, ঘামে বগল জবজবে ওই ভদ্রমহিলাটিকে আমিও যে লোকটির মতো লম্পটের চোখে দেখছি।
দেখছি তো বটেই! দেখে ফেলেছি। চোখ ফেলে দেখেছি। ঘুরে ঘুরে দেখেছি।’’
অন্যদিকে ‘খেলারাম খেলে যা’ প্রসঙ্গে সৈয়দ হকের নিজের ভাষ্য ছিল ‘‘…এর জন্যে আমাকে আমার অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়। ‘খেলারাম খেলে যা’ এদেশের সবচেয়ে ভুল-বোঝা উপন্যাস। না, এ উপন্যাসের জন্যে আমি লজ্জিত নই, বরং আমি লজ্জিত তাদের জন্যে যারা উপন্যাসের নেপথ্য একটি চরিত্র বাবর আলীর বোনকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে কেবল বাবলি বা জাহেদার কথা মনে রাখে।’’ [ভূমিকা : শ্রেষ্ঠ উপন্যাস : ১৯৯০]।
‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে রংপুর থেকে ঢাকায় ফিরবার সময়কার একটা দৃশ্যপট। জাহেদাকে ঘন কাঁঠাল বনে ধর্ষণের জন্য গ্রামের তিন যুবক আক্রমণ করে। তারা বাবর আলীকে বেঁধে ফেলে। তখন বাবর আলীর মনে পড়ে যায় দাঙ্গায় দুর্বৃত্তদের হাতে ধর্ষিত তার ছোটবোন হাসনুর কথা। বাবর আলী প্রবল শক্তিতে জেগে ওঠে। সে জাহেদার মধ্যে ছোটবোন হাসুকে দেখতে পায়। সে জীবিতাবস্থায় এই একবারই পৌরুষের পরিচয় দেয় এবং জাহেদাকে উদ্ধার করে। নিজে ছুরিকাহত রক্তাক্ত অবস্থায় জাহেদাকে উদ্ধার করে গাড়িতে নিয়ে আসে। পরে গাড়িসহ নদীতে পড়ে যায়। এই যে একটা প্লেবয় ক্যারেকটার, আস্ত একটা শয়তানের ভিতর থেকে একটা ভালো মানুষ বেরিয়ে এলো অতীত স্মৃতিকে সঙ্গে করে। ফলে উপন্যাসটা অন্যরকম হয়ে গেল। সময়ের সেরা আধুনিক উপন্যাস। জাহেদাকে উদ্ধারের দৃশটির খণ্ডাংশ, যেমন-
‘‘কোথা থেকে দানবের মত শক্তি এলো বাবরের। এক ধাক্কায় বুকে চেপে বসে লোকটাকে ফেলে দিয়ে সেই আর্তচিৎকারের দিকে দৌডুল সে। চিৎকার করতে করতে দৌড়ল, হাসুন, হা-স-নু-উ।
খুঁজে পায় বাবর। একজন জাহেদার মুখ চেপে ধরে আছে, আরেকজন উলংগ হয়ে জাহেদার শরীরের মধ্যে ঢুকতে চাইছে। বাবর লাফিয়ে পড়ে তাদের ওপর। দু কনুয়ে সরিয়ে দেয় দুজনকে। আর জাহেদার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, হা-সু, হা-সু, আয়।
কিন্তু ততক্ষণে পালটা আক্রমণ করে তাকে দুজন। আর ছুটে এসে যোগ দেয় তৃতীয় জন। বাবর চিৎকার করে বলতে থাকে, সরে যা, হাসু, পালিয়ে যা, পালা, পালা! হাসু, তোকে আমি বাঁচাব। ভয় নেই হাসু।
হঠাৎ মনে হয়। পিঠের ভেতর গরম আগুনের হালকা বয়ে গেল। বাবরের শরীর একমুহূর্তের জন্য শিথিল হয়ে আসে। অনেকটা মদ এক ঢোকে খেলে যেমন গা ঘুলিয়ে ওঠে ঝাঁকিয়ে ওঠে, তেমনি করে ওঠে শরীর।
জাহেদা বিস্ফারিত চোখে দেখে, বাবরের পিঠে ওরা ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। সে চিৎকার করে পিছিয়ে যায় একবার, তারপর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বাবরকে। ছুরিটা টেনে বের করে। আর লোক তিনটে দাঁড়িয়ে থাকে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে।
বাবর জাহেদার হাত ধরে টানতে টানতে দৌডুতে দৌড়ুতে বলে, চল হাসু, চল, চল চলে আয়।’’
বাবর আলীর অতীতে দাঙ্গার বিষাক্ত ইতিহাস, দেশান্তরীর ক্ষত। মেলায় নিয়ে যাওয়া নিজের ছোটবোন হাসনুকে দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে না পারার সেই অনুতাপ ও অপরাধবোধ, সাম্প্রদায়িকতার গ্লানি, রক্তপাতও ছিল সেই স্মৃতির অন্তর্গত। যে কারণে ঘন কাঁঠাল বনে গ্রামের ধর্ষক যুবকদের হাত থেকে জাহেদাকে বাঁচাতে মরিয়া চেষ্টা করেছেন। জাহেদা তখন হাসনুর মধ্যে একাকার হয়ে যায়।
বাবর আলী বা রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটি -দুজনেই আপাতদৃষ্টিতে দুর্বৃত্তসুলভ আচরণ করেছেন। দুটি আখ্যানের অন্তিমে দেখা গেল তাদের ভিতর ভালো মানুষের সত্তাগত রূপান্তর। সমাপ্তি চলে আসলেও ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে মোড় নেয়। একবারে ইউটার্ন। প্রশ্ন ওঠে, গল্প এবং উপন্যাসের যবনিকায় তাদের প্রতি মানবিক মহিমার স্বীকারোক্তি বা ইমেজ নির্মাণ কি লেখকের পক্ষ থেকে সৃষ্ট কোনো চমক নয়? নাকি সেই আপ্তদর্শন ফুটিয়ে তোলা যে- ভালো মন্দ মিলিয়েই মানুষ। পরিবেশ এবং পরিপ্রেক্ষিত কেবল তাদের ব্যক্তিত্বের, আচরণের গড়ন তৈরি করে। অনুকূল পরিবেশ পেলে তা আবার ভালো মানুষের স্বরূপ ফিরে পায়। মানুষ শেষ পর্যন্ত মানবিক মানুষই হয়। শোনা যায়, মৃত্যুর আগে মানুষের অন্তর পবিত্র হয়ে যায়। বাবর আলীর ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটেছে?
‘গল্পের কলকব্জা’য় সৈয়দ হকের থিতুকাল
সৈয়দ শামসুল হক মূলত কবি। ১৯৫৩ -তে ‘একদা এক রাজ্যে’ দিয়ে কাব্যযাত্রা। কিন্তু ১৯৫৪-তে সাতটি গল্প নিয়ে প্রথম গ্রন্থ ‘তাস’ প্রকাশিত হয়। এই শুরু থেকে, ৬২ বছরের লেখক জীবন। লিখেছেন তিন শতাধিক গ্রন্থ। ‘সব্যসাচী’ লেখক। সোনার কলম দিয়ে দুহাতে লিখেছেন- কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক ও কাব্যনাট্য, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য, চিত্রনাট্য ও সিনেমার গানসহ অনেক কিছু। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘অশেষ তাঁর সৃষ্টিসত্তা’ নামের স্মৃতিচারণে সৈয়দ হকের দীর্ঘকবিতা ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘সম্ভবত এটিই বাংলাদেশের কবিতায় কনফেশনাল পয়েট্রির এক আদি সফল নমুনা।’ কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরুল দীনের সারাজীবন’ নিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, আর কিছু না লিখলেও এ দুটি লেখায় তিনি বেঁচে থাকতেন। ‘খেলারাম খেলে যা’ এদেশে তাঁর সবচেয়ে ‘বেশি ভুল-বোঝা’ দুঃসাহসিক উপন্যাস। কলাম গ্রন্থ ‘হৃৎকলমের টানে’ অসাধারণ সৃষ্টি। কথাসাহিত্য, বিশেষ করে ছোটগল্প যা-ই লিখেছেন, তাতেও পাওয়া যায় অভিনব নিরীক্ষার ছাপ। ‘গল্পের কলকব্জা’ তরুণ লেখকদের জন্য ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ’ তুল্য অনন্য রচনা। কবি পিয়াস মজিদ তাঁর ‘অপ্রতিম সৈয়দ শামসুল হক’ লেখায় বলেছেন- ‘‘গল্পকে তিনি গল্প বলেন না। বলেন গল্পপ্রবন্ধ। কারণ তিনি সবল সাহসী হাতে ভেঙে দিয়েছেন ফিকশন-ননফিকশন বিভাজন।’’ ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধ ও আধুনিক মনস্তত্ত্বের কারুকাজপূর্ণ একটি প্রকৃত ছোটগল্প।
ছোটগল্পের প্রচলিত সংজ্ঞার বিবর্তন ও সৈয়দ হকের ‘গল্পের কলকব্জা’য় থিতু হওয়া, আমাদের কথাসাহিত্যেরই ঋদ্ধ রূপান্তর। কালে কালে এই যাত্রাপথের সংক্ষিপ্ত স্কেচটা কী রকম? এটা সত্য যে, ভাষা বা লেখ্যরীতি আবিষ্কারের পূর্বেও নানা প্রয়োজনে মানুষ ছবি এঁকে, ইশারা বা অঙ্গভঙ্গির দ্বারা অনেক কিছুই বর্ণনা করত। প্যাপিরাসে লিপিবদ্ধ নিদর্শনে পাওয়া গেছে, সাড়ে তিন হাজার বছর আগের প্রাচীন মিশরের গল্প সঙ্কলন ÔThe Shipwrecked SailorÕ বা ‘জাহাজ ডোবা নাবিক’। এটা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালে রচিত বলে অনুমিত। চর্যাপদ যেমন বাংলা কবিতার; তেমনি মিশরীয় গল্প সংকলনটিও গল্পের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত আদি নিদর্শন রূপে গণ্য। ঈশপের গল্প বা জাতকের গল্প খ্রিষ্টের জন্মেরও অনেক আগের। রামায়ন, মহাভারত, জাতক কাহিনি (বুদ্ধের পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত), পঞ্চতন্ত্র, কথা সরিৎসাগর, বৃহৎকথা, উদয়নকথা, দশকুমার চরিত, হিতোপদেশ, গ্রিক পুরাণ, ইলিয়াড, ওডিসী, ডিভাইন কমেডি, পারস্য উপন্যাস ও তুতিনামা, ইউরোপে বাইবেলের ধর্মীয় কাহিনি ও মিথলজি, আব্বাসীয় যুগের আরব্য রজনীর গল্প, ঠাকুর মা’র ঝুলি সহ আরো অসংখ্য আখ্যান-কাহিনি মানবসভ্যতার এক বিশাল গল্প ভান্ডার। এখানে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিতে চাই, বাংলা চলিত ভাষার প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী দাবি করেছেন- ‘আরব্য উপন্যাসের জন্মভূমিও হচ্ছে ভারতবর্ষ।’ (সবুজপত্র, দশম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা পৌষ, ১৩৩৩)। এ নিয়ে বিশেষ গবেষণা হতে পারে।
‘ছোটগল্প’ আসলে যুগ সৃষ্ট সমস্ত কিছুর মিলিত উত্তরাধিকার। ছোটগল্পের পূর্বপুরুষ ধরা হয় চতুর্দশ শতকের দুজন লেখককে। তারা হলেন- ইংরেজ লেখক জিওফ্রে চসার এবং রোমান লেখক বোকাচ্চিও। চসার লিখেছেন ‘কেন্টারবারী টেলস’ এবং বোকাচ্চিও- ‘ডেকামেরন’। দুটোই ছোটগল্পের সঙ্কলন। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝিতে ফরাসি সাহিত্যে ছোট আকৃতির উপন্যাস লেখা হতো, তাকে বলা হতো-‘নভেলা’। ইউরোপে ‘আরব্য রজনী’র অনুবাদ একধরনের আশীর্বাদ হয়ে আসে। মনে করা হয়, এখান থেকেই ছোটগল্পের বর্তমান ধারণার সূত্রপাত। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয়দের লেখায় ‘আরব্য রজনী’র প্রভাব দেখা যায়। অবশ্যই ছোটগল্পের প্রকৃত প্রকাশ ঘটে ইউরোপের শিল্প ও ফরাসি বিপ্লবের পরে।
ছোটগল্প কাকে এল, কী তার ফর্ম বা বৈশিষ্ট? এ নিয়ে দেশবিদেশে নানা কথা হয়েছে। লিখবার সর্বজন মান্য নিয়মও নেই। এর-ওর কথা মিলিয়ে যে যার মতোন ভেবে নিয়ে পথ চলছেন। ছোটগল্পের আকার কী হবে? কেউ বলছেন- পাঁচশ থেকে দু’হাজার শব্দের মধ্যে লেখা ভালো। কেউ জানিয়েছেন- বাংলা সাহিত্যে এক-দুই পৃষ্ঠার ছোটগল্প আছে, আবার ত্রিশ-চল্লিশ পৃষ্ঠারও আছে। বনফুলের ছোটগল্প গুলো ছোট-ছোট। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’, ‘অতিথি’- বড় আকৃতির ছোটগল্প। এরকম নানা মুনির নানা মত। সমস্তটা মিলিয়েই কেবল ছোটগল্পের অনবরত পথানুসন্ধান। এই পথেই ছোটগল্প সৃষ্টি হয় লেখকের নিজস্ব শক্তির দ্বারা।
প্রমথ চৌধুরী অবশ্য একটি কথা বলেছেন-
‘‘যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে,‘গল্প’ কাকে বলে, তার উত্তর লোকে যা শুনতে ভালোবাসে। আর যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন ‘ছোট’ কাকে বলে, তার উত্তর ‘যা বড়ো নয়’। এই উত্তরে পাঠক আপত্তি করতে পারেন যে, ডেফিনিশনটি তেমন পরিষ্কার হলো না। এ স্থলে আমি ছোটগল্পের তত্ত্ব নির্ণয় করবার চেষ্টা করছি। এবং আশা করি সকলে মনে রাখবেন যে, তত্ত্বকথা এর চাইতে আর পরিষ্কার হয় না। এর জন্য দুঃখ করবারও কোনো কারণ নেই; কেননা, সাহিত্যের তত্ত্বজ্ঞানের সাহায্যে সাহিত্য রচনা করা যায় না। আগে আসে বস্তু, তার পরে তার তত্ত্ব। শেষটি না থাকলেও চলে, কিন্তু প্রথমটি না থাকলে সাহিত্যজগৎ শূন্য হয়ে যায়।’’ – (পৃ. ১৫৯, টিকা ও টিপ্পনি, বীরবলের হালখাতা)।
বাংলা ছোটগল্পের জন্ম মাত্র উনিশ শতকে। রবীন্দ্রনাথই বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ স্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথ মোপাসাঁ বা অন্য বিদেশিদের মতো পূর্বসূরীদের কাছ থেকে তৈরি গদ্যভাষা পাননি। গল্পপ্রবাহের সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁকে গদ্যভাষা বানিয়ে নিতে হয়েছে। যদিও বলা হয় রবীন্দ্রনাথের আগে বঙ্কমিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছোটগল্প লিখতে চেষ্টা করেছেন এবং বঙ্কিমের অনুজ পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতী’ গল্পটি প্রথম বাংলা ছোটগল্প। যাই বলা হোক, রবীন্দ্রনাথই বাংলা ছোটগল্পের জনক। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’ ১৮৭৪ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত। তবে ‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯০) বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্পের স্বীকৃতি পায়, মতান্তরে কেউ কেউ বলেন ‘ঘাটের কথা’। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় ৯৫, মতান্তরে ১১২টি। আর সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন প্রায় ১০০টি।
ছোটগল্পের সংজ্ঞা প্রকরণিক বিষয়আশয় স্বতন্ত্রভাবে বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। এখানে সেই চেষ্টা না করে বরং কয়েকটি পপুলার সংজ্ঞা দেখে নিতে চাই-
- প্রমথ চৌধুরী : ‘ছোটগল্প প্রথমে গল্প হওয়া চাই, তার পরে ছোট হওয়া চাই; এ ছাড়া আর কছিুই হওয়া চাই নে।’ অন্যত্র বলেছেন- ‘ছেটগল্প বলবারও একটা আর্ট আছে এবং আমার বিশ্বাস এ আর্ট নভেল লেখার আর্টের চাইতেও কঠিন… আর্টে কনটেন্টের চেয়ে ফর্ম-এর মূল্য ঢের বেশি।’
- এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : Ôbrief fictional prose narrative that is shorter than a noveland that usually deals with only a few characters.Õ
- এডগার অ্যালান পো’ : `a narrativethat could be read at one sitting, from a half an hour up to two hours.’ অর্থাৎ ‘যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দু’ঘন্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে।’
- এইচ জি ওয়েলস : ‘ছোটগল্প ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্চনীয়।’
- রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় যে ধারণা ব্যক্ত করেছেন, তা বেশি পপুলার। বিশেষ করে- ‘শেষ হয়েও হইলো না শেষ’ অনেকের কাছেই স্পন্দিত।
- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় : ‘..আধুনিক ছোটগল্প হল যন্ত্রণার ফসল। ..লেখকের ব্যক্তিত্ত্বেরই এক একটি অভিব্যক্তি।’ তিনি আবার অন্যত্র বলেছেন- ‘ছোটগল্প হচ্ছে প্রতীতি জাত একটি সংক্ষপ্তি গদ্য-কাহিনী, যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা কোনো পরবিশে বা কোনো মানসকিতাকে অবলম্বন করে ঐক্য-সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।’ (সাহিত্যে ছোটগল্প/দ্বিতীয় খণ্ড, রূপতত্ত্ব)।
- সৈয়দ শামসুল হক : ‘‘আমার একটা বিশ্বাস আছে যে, মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে গল্প বানিয়ে আসছে, নাটকীয় যত রকম পরিস্থিতি হতে পারে তার সবই এতদিনে নিঃশেষিত হয়ে গেছে, কারো আর সম্ভব নয় নতুন করে বা নতুন কোনো গল্প বানানো, আমরা কেবল যা করতে পারি, পুরনো গল্পকেই সমকালের পরিস্থিতিতে ফেলতে পারি, অথবা, বর্তমান সামাজিত-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি এবং বলাবাহুল্য, এ দুয়ের জন্যেই দরকার, এবং একমাত্র দরকার, লেখার ক্ষমতার কথা বলছি না, সেতো থাকতেই হবে, দরকার-একটি বিশ্বাস, একটি দর্শন, একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এই বিশ্বাস, এই দর্শন, এই দৃষ্টিভঙ্গি যাঁর থাকে, গল্প তাঁকে খুঁজতে হয় না, তাঁকে বরং বেশি করে ভাবতে হয়, কোন গল্প লিখবো আর কোন গল্প লিখবো না।
গল্প লেখকের মাথার ভেতরে গল্প জন্ম নেয় না, মাথার ভেতরে থাকে না, গল্প পড়ে আছে লেখকের চারপাশে, এত গল্প যে একজীবনে সব লিখে ফেলার আশা করাও মূর্খতা। গল্প খোঁজা নয়, করং কীভাবে গল্পে আমার বিশ্বাসটি পোক্ত কাঠামো হয়ে আসতে পারে, সেই গল্পে আমার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হতে পারবে কিনা, আমার জীবন দর্শনকে সে-গল্প দক্ষতার সংগে বহন করতে পারবে কিনা, এটা খুঁজে দেখাই গল্প লেখকের প্রাথমিক কাজ, এই হচ্ছে তার প্রস্তুতির সম্পূর্ণ আয়োজন।’’ -গল্পের কলকব্জা।
সৈয়দ শামসুল হকের গল্পভাবনার কেমিস্ট্রি নিজের যুগের ভাষাভঙ্গিতে রচিত। আখ্যান নির্মাণ, চরিত্র সৃষ্টি, আঙ্গিক গঠন ও ম্যাসেজ নির্ধারণ সবকিছু মিলিয়েই নিজের মতোন করে গল্প বানিয়েছেন। ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ সেরকম একটি নমুনা মাত্র। ছোটগল্প নিয়ে দেশবিদেশের লেখকদের বক্তব্য বা ভাবনার সম্প্রসারণ তাঁর লেখালেখিতেও। বাংলা ছোটগল্পের দু’শ কুড়ি বছরের ইতিহাসে অনেক প্রতিভাবান কথাশিল্পী জন্মেছেন। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু, আরো কয়েকজন আছেন। তাঁরা সবাই বিশ্বমানের গল্প লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হকও তাদের একজন। এমন কী তাঁর ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’, আধুনিক মনস্তত্ত্ব ও দার্শনিক ব্যাখার জায়গা, নাটকীয়তাসহ সবকিছু মিলিয়ে অনবদ্য সৃষ্টি। উপরে বলা সংজ্ঞা ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ছোটগল্পের অবয়বের যে সর্বোত্তম পৌনঃপুনিক নির্মাণ ঘটে- ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ তার প্রায় সমস্ত শর্ত ও আকাঙ্খা পূরণ করেছে।
‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’- খুঁটিনাটি সমুদয়
গল্পটি যতবার পড়া যায় বোরিং লাগে না। শুরু থেকেই অমোঘ আকর্ষণ। শেষে চুম্বকের মতো আটকায়। কেন এমন হয়? কী আছে এর মধ্যে? আখ্যান যখন সিম্পল, পাঠান্তেও কেন মাথা থেকে নামে না? কেন নানা ভাবনার ঘূর্ণি ওঠে? প্রশ্ন তো অনেক। উত্তরটাও সহজ। গল্পের মেকিং; একজন দক্ষ গল্প বলিয়ের জাদুকরী নির্মাণ শক্তি।
ফেরিঘাটের পরিপার্শ্ব থেকে খুবই সাধারণ এবং নিত্যচেনা কিছু উপাদান নিয়ে গল্পটি বানানো। পাঁচটি মাত্র চরিত্র, যেমন- কথক ভদ্রলোক, টাউট কিসিমের একজন বাসযাত্রী, জিনস ট্রাউজার পরা তরুণী, কন্যাশিশুর মা এবং বুড়ি মা- এদের নিয়েই আখ্যান নির্মিত। পরিবেশ নির্মাণের বিশ্বসযোগ্যতার জন্য ফিলার হিসেবে কয়েকটি উহ্য বা নিষ্ক্রিয় চরিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সময়ের হিসেবে বড়জোর এক থেকে দেড় ঘণ্টার গল্প। রূপদক্ষ নির্মাতার হাতে তৈরি- ছোটগল্প লেখার কিছু টেকনিকের দুর্দান্ত ব্যবহারের ফসল অবিশ্বাস্যমানের এই গল্প। আঁটোসাটো গাঁথুনি, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সঙ্গতিপূর্ণ ডায়ালগ, পরিবেশের নির্খুঁত বর্ণনা, মনস্ত¡ত্ত্বের টানাপড়েন, দার্শনিক অভিপ্রায় ও উদ্দিষ্ট বক্তব্য নির্ধারণ- সবকিছু মিলিয়েই গল্প বুননের বিশেষ কিছু দ্যোতনা বিদ্যমান, যার আবেশ থেকে বেরতে পারা কঠিন। একটা জেনুইন ছোটগল্প যা কিছু নিয়ে হতে পারে, তার সমস্তটাই এই গল্পে পাওয়া যায়।
উত্তম পুরুষে বর্ণনার টেকনিকে অর্থাৎ ‘আমি’ শব্দবন্ধ দিয়ে গল্পের শুরু। একজন ভদ্রলোকের জবানিতে গল্পের জার্নি। কেউ কাউকে আগে দেখেনি, চেনে না। ভিড়ের মধ্যে প্রথম দেখাতেই এরকম একটা টাউট কিসিমের বাসযাত্রীকে কথক ভদ্রলোকের অপছন্দ হয়। এই ইন্ট্রো দিয়েই গল্পের শুরু। যেমন-
‘‘আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি। লোকটিকে আমি ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। এরকম হয়। অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায় পথে। এই দেখা হলো, আর কখনো দেখা হবে না। ওইটুকুর ভেতরেই পছন্দ-অপছন্দ গড়ে ওঠে। কখনো এমন হয়, মানুষটির কথা বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে।’’
ইন্ট্রোর পর গল্পের ভিত মজবুত করা হলো আশপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতির কিছু ইন্টারেস্টিং বর্ণনায়। ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীরা কেউ নেমে হাঁটাহাঁটি করছে, কেউ হোটেলে ঢুকছে খাওয়ার জন্য। কাস্টমারদের তাড়া দেখে ‘‘দোকনিরা অভয় দিয়ে বলছে, আস্তে খান সায়েবেরা। টাইম অনেক পাবেন। আরেকখান মাছ দেই? পদ্মার ইলিশ!’’ ভদ্রলোক বাইরে দোকানে দাঁড়িয়ে চা খান। ঘাট সুপারভাইজার জানায়- ফেরি আসায় দেরি হবে। এই পরিস্থিতিতেই ভদ্রলোক সেই টাউট কিসিমের চেহারার অপছন্দের লোকটিকে দেখলেন। কীভাবে?
‘‘সেই ডিম-পরোটা, ইলিশভাজা, গরম ভাত আর মানুষজনের ভিড়ের মধ্যে লোকটি হঠাৎ আমার চোখে পড়ে যায়। লোকটির চোখ ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল। যে ফুলে মধু সেই ফুলেই ফড়িং গিয়ে বসে। লোকটির চোখ বাসযাত্রী-মোটরযাত্রী মহিলাদের ওপর ঘনঘন গিয়ে বসছে। এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার ওপরে তার চোখ নাচানাচি করছে। হয়তো এ-জন্যেই আমার চোখ পড়ে।’’
লোকটি তখনো অভ্যাস মতো বিভিন্ন মহিলাদের দেখছিল। যখন অনুভব করলো, কেউ তাকে দেখছে। তখন পিছন ফিরে তাকায়। ভদ্রলোকের সঙ্গে লোকটির চক্ষু সংযোগ ঘটে। এই লোকটার হাতেই গল্পের নাটাই ধরা। ভদ্রলোক সুতোয় বাঁধা পড়লেন। মূলত গল্প শুরুর টার্নিং পয়েন্টও এটাই।
‘‘তারপর এককাণ্ড ঘটে। এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার দিকে তার অনবরত চোখ ফেরবার মাঝখানে সে আমাকেও এবার একবার করে দেখে নিতে থাকে।’’
‘‘সে আর আমি যেন একটা বাঁধনের মধ্যে পড়ে যাই। অচিরে আমি দেখি আমার চোখও তারই মতো এক মহিলা থেকে আরেক মহিলার ওপরে গিয়ে বসছে। আর তারই মতো আমিও মাঝখানে একবার করে লোকটাকেও দেখে নিচ্ছি।’’
এক মহিলা থেকে আরেক মহিলাকে দেখা- এটাই ভদ্রলোকটির অস্বস্তির মূল কারণ। যা তিনি বের করতে পারছিলেন না। কিন্তু পরের দিকে স্পষ্ট হবে। অথচ এরকম মেয়ে দেখা তার স্বভাব নয়- ব্যাপারটাকে অসভ্যতা মনে করতেন। পাঁচ বছর আগে বিয়ের রাতেও তিনি স্ত্রীর দিকে ভালো করে তাকাতে পারেননি। এজন্য স্ত্রীর খোঁটা কম শোনেন নি। শেষদিকে জানা যাবে ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম রাহেলা। গল্পের মাঝামাঝিতে দুজন মহিলার স্তন দেখার পর স্পষ্টভাবে মনে পড়বে স্ত্রী খোঁটার কথা-‘সকলে তো আর তোমার মতো না! নিজের বউকেও দেখতে যার লজ্জা।’
লেখকের কুশলী নির্মাণে গল্পটার সিকোয়েন্স বদলাতে শুরু করে। এখান থেকেই পৃথক তিনটা খ-দৃশ্যের দিকে তা স্থানান্তরিত হতে থাকবে। ঘটনার মঞ্চও লেখক সেভাবে প্রস্তুত করছিলেন। এটা যে বাসযাত্রী বা ভদ্রলোকটি পরিকল্পনা করে করছে, তাও নয়। আসলে লোকটা হঠাৎ জায়গা বদল করে- অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে হাঁটতে শুরু করে। কথক ভদ্রলোকও পিছু নিয়ে অনুসরণ করতে শুরু করে। এই পর্যায়ের দৃশ্য ও ভাষায় যৌন উত্তেজক বর্ণনা টেনশন হয়ে আগাগোড়া জড়িয়ে যায়। এই সময়টায় সুনির্দিষ্টভাবে তিনজন নারী চরিত্রের স্তনদর্শনের ঘটনা ঘটে। উন্মোচিত হয় মূলগল্পের দৃশ্য কপাট।
সৈয়দ শামসুল হকের গল্প বা উপন্যাসে চা খাওয়ার ব্যাপারটি যদি থাকে, নারী চরিত্রটির জন্য সেটি হয় বেগড়বাই। তাদের জন্য হয় মন্দভাগ্যের ব্যাপার। যেমন ‘খেলারাম খেলে যা’-এর ‘আরিচার পর বাঘাবাড়ি’ পর্বে ঘটেছে। রংপুরে যাওয়ার পথে বগুড়ার সাতমাথায় বাবর আলী গাড়ি থামাল। জাহেদাকে বলল- ‘‘স্যান্ডউইচ তো ছুঁলেই না। আচ্ছা, একটু চা খাও। চা কিনে নিই। রংপুর এখনো অনেক দূরে। গাড়ি থামিয়ে চায়ের খোঁজ করল বাবর। চা পাওয়া গেল না। বগুড়ায় বিকেলে নাকি চা হয় না। পাঁচটা বাজবে, তখন চায়ের কেতলি বসবে উনুনে।’’ ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’- এই গল্পটায়ও জিনস ট্রাউজার পরা তরুণীকে নিয়ে চায়ের প্রসঙ্গ আছে। এখানেও সে নিজের ফ্লাস্ক থেকে ফুরিয়ে যাওয়ায় চা পেল না। এই ঘটনা বেলা এগারোটার চোখ ধাঁধানো রোদে আর ‘খেলারাম খেলে যা’য় বগুড়ার সাতমাথায় বিকেলে। সৈয়দ হক আখ্যান বিস্তারের প্রয়োজনেই হয়তো নারী চরিত্রের বেলায় এটা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটিয়ে থাকেন। যাতে আরেকটি পার্শ্বঘটনা প্রডিউস করা যায়। এই টেকনিক তাঁর গল্পলেখার কৌশল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেয়।
ঘটনার প্রথম কেন্দ্র
জিনস ট্রাউজার পরা তরুণীর সিকোয়েন্সের মাধ্যমেই তিনজন নারী চরিত্রের স্তন দর্শনের প্রথমটির সূচনা। দৃশ্যপটে তরুণীর আবির্ভাব ঘটল যেভাবে- ‘‘একজন ওই নেমে এলো গাড়ি থেকে। আহ্! মেয়েটির পরনে জিনস ট্রাউজার, ওপরে শাদা শার্ট। কাঁধে ক্যামেরা। হাতে চায়ের ফ্লাস্ক। ট্রাউজারের পেছনটা টানটান হয়ে আছে তানপুরার খোলের মতো।’’ তরুণীটি পারের একটা পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ‘নদীর বুকে পালতোলা ডিঙ্গি নৌকোর’ দিকে ক্যামেরা তাক করল। ফ্লাক্স টিপে চা খেতে গিয়ে কয়েক ফোঁটা পেল। রাগের সেই এক্সপ্রেশনে ফ্লাক্স টাইট করে বন্ধ করল। তারপর?
‘‘তারপর মেয়েটি একটা পান দোকানে হেঁটে গিয়ে কোকের বোতল কিনলো। বোতলটার ছিপি খুললো সে দাঁত দিয়ে কামড়ে। সেই কামড়টা বড় দুঃসাহসী দেখালো। আর সেটা দেখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে গেলো ঘাটের দুটি টোকাই।
মেয়েটি এবার আকাশের দিকে মাথা তুলে ঢকঢক করে কোক গিলতে লাগলো। আকাশের দিকে মুখ তোলার সময় হাতও উঠেছিলো বোতলসমেত। তখন বুকের শার্ট তরা উঁচু হয়ে উঠলো। কোমরের গোলাপি রঙের বেল্ট বেরিয়ে পড়লো। স্তন দুটো ঠেলে উঠলো, যেন প্রতিবাদে, যেন তারাও খাবে কোক। সবকিছু ঝকঝক করতে লাগলো বেলা এগারোটার চোখ ধাঁধানো রোদে।
লক্ষ্য করি, লোকটিও চোখ ফেলে আছে মেয়েটির বুকের দিকে। মেয়েটি গলা নামালো, তৎক্ষাৎ তার বুকের ওপর ঢিলে শার্ট ঝুলে পড়লো। স্তনের উচ্চতা মিলিয়ে গেলো শার্টের ভেতরে। ঠিক তক্ষুণি একটা জোরে বাতাস উঠলো। বাতাস যেন বললো, আরে আমি তো ভালো করে দেখতেই পাইনি। তাই সেই বাতাসের দাপটে মেয়েটির বুকের বল দুটো আবার উঁচু হয়ে দেখা দিলো। বাতাস এবার বড় অসভ্যতা করলো। শার্টেও চেপে ধরে বল দুটোকে ফুটিয়ে রাখলো।’’
এখানে পর্যবেক্ষণের কার্যকারিতা এবং ভাষা বর্ণনায় যৌনোত্তেজনার মিশ্রণ ঘটেছে। চটিভাষা ও সাহিত্যের ভাষার মধ্যেকার তফাৎ নিয়ন্ত্রণ যে লেখক করতে পারেন- তার সৃষ্টিশীলতাকে তখন অশ্লীল বলা যায় না। বাসযাত্রী লোকটি কতটুকু নেগেটিভ ক্যারেকটার বা গল্পটির সংশয়পূর্ণ মূল চরিত্র কিনা ধন্দ জাগে! তার বাহ্যিক অপরাধ মহিলাদের দিকে তাকানোর আগ্রহ, অ্যাগ্রেসিভ অ্যাটিচুডে লেখক তাকে সনাক্ত করেন নি। অপরদিকে, রাহেলার স্বামী ভদ্রলোকটি ফড়িংয়ের চোখের চঞ্চল স্বভাবের কারণে এবং মহিলাদের দিকে ঘনঘন তাকানোর জন্য নজরবন্দি করে ঘটনার আবর্তে জড়িয়ে পরেন। হতে পারে লোকটি আপন খেয়ালে যেখানে যেখানে যাচ্ছিল সেখানেই দৃশ্যমান ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছিল। আর তার চক্করে পরে অনুসরণ করতে গিয়ে ভদ্রলোকটিও সেসব দৃশ্য দেখতে বাধ্য হচ্ছিলেন। সৈয়দ হক গল্প নির্মাণের জন্য পরিস্থিতি উপযুক্ত যৌন উত্তেজক বর্ণনার যে ভাষা রীতি ব্যবহার করেছেন, এই পর্যায় থেকে তা পুরো গল্পকে টেনে নিয়ে গেছে। অন্তিমে মানবিক মহিমার দার্শনিক ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন, এটিও তার শিল্পশর্ত পূরণের বিশেষ একটি প্রিয় কৌশল।
ঘটনার দ্বিতীয় কেন্দ্র
গল্প এবার মোড় নিতে শুরু করে দ্বিতীয় নারী চরিত্রের স্তন দর্শনের সিকোয়েন্সের দিকে। বাসযাত্রী লোকটি নদীপারের তরুণীর অবস্থানের জায়গা থেকে সরে গিয়ে অন্যত্র যাওয়ায শুরু করে। পিছনে পিছনে যথারীতে সেই ভদ্রলোকও। লোকটি এবার একজন ভদ্রমহিলাকে ‘এতটুকু একটা’ মেয়ে বাচ্চকে সঙ্গে করে শাদা একটা গাড়ি থেকে বেরোতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাচ্চাটি মায়ের আঙুল ধরে মায়েরই চারপাশে টলমল করে ঘুরছে। পরের খণ্ডাংশটি এরকম-
‘‘ভদ্রমহিলা নীচু হয়ে ধরে আছে শিশুটিকে। শিশুটি বারবার বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর ভদ্রমহিলারও বুকের কাপড় পড়ে পড়ে যাচ্ছে। বাচ্চার দুধে পুষ্ট স্তনজোড়া বিশাল ফলের মতো গড়িয়ে পড়ছে নীচু হতেই।’’
লোকটি ভদ্রমহিলার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একবার মহিলাকে দেখছে, আরেকবার বাচ্চাটিকে। আর তা দেখে ভদ্রলোকটিও। গরমে মহিলার ব্লাউজের বগল ঘামে জবজবে। মুখে কাজল, পাউডার, লিপস্টিকের একটা লেপটালেপটি অবস্থা- মহিলার দিকে স্বামী ভদ্রলোকটি একধরনের ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। এ অবস্থায় রাহেলার স্বামী ভদ্রলোক ও টাউট কিসিমের বাসযাত্রী তফাতে যায়। রাহেলার স্বামী ভদ্রলোক ঘটনা দেখতে এদিকে চোখ ফেরালে বাসযাত্রী লোকটি চোখ ফাঁকি দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। এই দৃশ্যের মধ্যেই ভদ্রমহিলা ও তার স্বামীর মধ্যে একপশলা ঝগড়া হয়। ঝগড়ার ডায়ালগগুলো খুবই জীবন্ত। যেমন-
‘‘শুনি ভদ্রমহিলার স্বামী চাপা গলায় শাসন করছে স্ত্রীকে। তপ্ত গলায় বলছে, তোমার বড্ড ইয়ে দেখছি! কোনো হুঁশ নাই। গাড়িতে এসে বসো! স্ত্রীও কম যায় না। সে বলছে, তুমি বসো গিয়ে গাড়িতে। আমি নদীর হাওয়া খাবো।
খাই তোমার মেটে না।
চুপ।
তুমি চুপ। বুক সামলাও!
তুমি চোখ সামলাও! জার্নিতে এরকম হয়!’’
এই যে ‘জার্নি’ শব্দটা ভদ্রমহিলাটি বলল। এটাই ভদ্রলোকের চেতনায় সিগন্যালের মতো কাজ করতে শুরু করে। স্ত্রী রাহেলার সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি মাথায় চলে আসে। তার স্ত্রীর ধারণা ছিল পথের অজানা অচেনা মানুষের নজর নষ্ট- এজন্যে তিনি নিজেকে যথাসাধ্য আঁচল দিয়ে ঢেকেঢুকে চলতেন। ভদ্রলোক যদি বলতেন- ‘দেখলেই বা কি!’ স্ত্রী সেই খোঁটাটা শুনিয়ে দিতেন। বলতেন- ‘সকলে তো আর তোমার মতো না! নিজের বউকেও দেখতে যার লজ্জা।’ এর একটা শানে নুযুল ছিল- ভদ্রলোক বিয়ের রাতেও নিজের স্ত্রীর দিকে ভালো করে তাকাতে পারেন নি। কাজেই উপলক্ষ পেলেই রাহেলার তরফ থেকে ওই খোঁটা তার জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ওই যে জার্নি শব্দটা সিগন্যাল হয়ে এল, তিনি এতক্ষণে বুঝতে পারলেন কেন তার লোকটিকে পছন্দ হচ্ছিল না। কারণ- ‘ওই লোকটির জন্যেই তো যা কখনো দেখি না তাই-ই আমাকে আজ দেখতে হলো।’ নিজের সঙ্গে নিজের মুখোমুখি হয়ে যখন সওয়াল জবাব করছিলেন সেসময়েই ফেরিতে থাকা একটা দূরপাল্লার বাস থেকে লোকটাকে নামতে দেখেন তিনি। তার একটু আগের অনুশোচনা ও স্মৃতির আচ্ছন্নতা তখনই ভেঙে যায়।
ঘটনার তৃতীয় কেন্দ্র
ভদ্রলোক দেখেন হঠাৎ সেই লোকটি একটা বাসের জানালার কাছে এসে পানির পিক ফেলা এক বুড়িকে ধমক দেয়- ‘‘আম্মা, পানের পিক প্যাসেঞ্জারের গায়ে পড়বো। বাসের গাও বা কী করছে! সাবধানে ফালাও।’’ এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা শুরু হয়ে যায়, যা বিশ্রী তর্কে রূপ নেয়। পরে বুঝা যায় যে তারা দু’জন- মা ও ছেলে। বুড়ি মা ছেলেকে জর্দা আনবার জন্য বলে। ছেলে বিদ্রুপ করে বলে- ‘ওতের সময়ও তোমার জর্দার হাউস গেল না’। এ নিয়ে তর্কের শেষ পর্যায়ে ছেলে ক্ষেপে গিয়ে বুড়িকে বলে- কবরে জর্দা দিবে। ব্যাস, আগুন জ্বলে উঠলো। নতুন নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বুড়ি মা’র কথায় ও আচরণে যে দার্শনিকতা প্রকাশ পায় তা জগৎব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার আকাঙ্খা ও অসহায়তার মুহূর্তটা হাস্যকর ঠেকতে গিয়েও পুরো পরিস্থিতিতে গভীর বেদনার সঞ্চার ঘটায়। ছেলের সঙ্গে তর্কাতর্কির উত্তেজনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বুড়ি মা জানালা দিয়ে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ঠেলে দেয়- তাতেই এই গল্পের সর্বশেষ দফার স্তন দর্শন। যেভাবে তা ঘটল-
‘‘এই বলে বুড়ি জানালা ঠেলে মাথা খাড়া করে দাঁড়ায়। তারপর বুক থেকে চাদর ফেলে দিয়ে জগৎকে দেখায়। আমিও দেখি মরা স্তন। শীর্ণ স্তন কবেকার মায়ের স্তন। কোন কতকাল শত বছরের সেই দুধেল স্তন। এখন চুপসে আছে। স্তনের চিহ্নমাত্র এখন আর সে বুকে নেই। সস্তা সবুজ ব্লাউজ ঢলঢল করছে।’’
প্রথমে বোঝা না গেলেও পরবর্তীতে বথোপকথন থেকে স্পষ্ট হয় তারা মাতাপুত্র। আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, ফেরি-জাহাজের অপেক্ষায় থাকার পুরো সময়টুকুতে লোকটি, ভদ্রলোকের সঙ্গে এখানেই মাত্র একবার, একটিমাত্র কথা বলে। তাও বিনীত সংলাপ সেটা। ভদ্রলোকটি কিন্তু রেসপন্স করেন না, সরে যান। লোকটির কথা বলবার আগে- বুড়ি মা চিরায়ত মহামাতৃত্বের অহংকার নিয়ে জগৎকে উদ্ভাসিত করে। কথা কাটাকাটির অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বক্ষ উন্মোচন করে। এই মহান দৃশ্যটি তখন আর অশ্লীল মনে হয় না। তবে বেদনার ক্ষীণ অথচ তীক্ষè খোঁচা কোথাও যেন অনুভূত হতে থাকে। মহাকাল যেন সেই বেদনা ধারণ করে। লোকটি ভদ্রলোককে একটিমাত্র কথা বলে- ‘‘আম্মার মাথাটা বুঝলেন না, ঠিক নাই। অনেক দিনের ব্যারাম।’’
ভদ্রলোক কাতর হয়ে পেছনে সরে যান। তার কানে বাজতে থাকে লোকটির কণ্ঠস্বর-
‘‘আম্মা, বুক ঢাকো। বুক ঢাকো। বুড়া হয়া তোমার শরমভরম সব গেছে।
চাদরটা গায়ে দেও। দুনিয়া যে দ্যাখে।’’
অথচ, বাসযাত্রী এই লোকটিই এতক্ষণ নির্বিশেষে যখন যেখানে পেরেছে মহিলাদের দেখেছে। তখন নিজ অপকর্মের ক্ষেত্রে ‘দুনিয়া যে দ্যাখে’ তার মাথায় ছিল না। এখন বুড়ি মা’কে নিয়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই দর্শনবাক্য তার অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে। কেন আসে? কারণ মানুষের অন্তরে সাদা কালো ও নানা রঙের দাগ, যেগুলো তার ব্যক্তিত্বের অংশীদার। কেবলমাত্র পরিপ্রেক্ষিত পেলে স্বরূপে উন্মোচিত হয়। একজন মানুষ তাই ভালোমন্দের যোগফল, এই লোকটিও কি তাই?
ফেরি জাহাজ আসে। সবাই যে যার জায়গায়। ভদ্রলোকেরও সম্বিত ফেরে। স্তন ক্যান্সারে মৃত স্ত্রী রাহেলার কুলখানির জন্য শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। তারও সন্তান ছিল- কিন্তু স্তন্যদানের ভাগ্য স্ত্রীর হয়নি। বাসযাত্রী সেই টাউট কিসিমের চেহারার লোকটা- যার জন্য ভদ্রলোকের প্রত্যক্ষভাবে এই দৃশ্যায়তনিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিভ্রমণ। যে যত্রতত্র মহিলাদের দেখে বেড়াত, সে-ই কিনা বুড়িমাকে অনুনয় করছিল- ‘চাদরটা গায়ে দেও। দুনিয়া যে দ্যাখে।’ অথচ তাকেই এতক্ষণ চোখে চোখে রেখে আপন অভ্যাসের বাইরে নারীর বুক দেখতে তিনিও বাধ্য হয়েছেন। সেই লোকটিই কিনা তাকে একটি মাত্র বাক্যে বলল- ‘‘আম্মার মাথাটা বুঝলেন না, ঠিক নাই। অনেক দিনের ব্যারাম।’’
বুড়ি মার আপাতত অসংবৃত বা অসংযত আচরণের রহস্য কি হাজার বছরের বিশ্ব মাতৃত্বের প্রতীক? বুড়োকালেও বাচ্চাদের দুধ দিতে পারার গভীর অহংকার, সন্তান বাৎসল্যের চির বাসনা, বুড়িয়ে যাওয়ায় অনুতাপ, বিলাপ, হাহাকার, নাকি স্রেফ একজন আত্মমগ্ন মায়ের প্রতিকৃতি? সে কারণেই বাতাসে সংঘটিত মন্ত্রবৎ বিস্তার- ‘জগৎ প্রকাশিত হয়ে থাকে। জগৎ দেখতে থাকে।’ দৃশ্যমানতার আড়ালে প্রকৃতই কি অন্য কিছু- স্তন ক্যান্সারে মৃত কেউ? রাহেলা যার নাম? যিনি সন্তানকে স্তন্যদান করাতে পারেন নি? নাকি শীর্ণ ও শুষ্ক স্তনের বুড়ি মা-যিনি জগতের হাজার সন্তানের জননীরূপে আবির্ভূত? এ-কী স্তন দেখার উসিলায় ধ্রুপদী গল্পের আবরণে মাতৃত্বের চির প্রতীকায়ন?
‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’, এক দেড়ঘণ্টার ক্যানভাসে অসাধারণ একটা মনস্তাত্ত্বিক গল্প। তিন প্রজন্মের মহিলার বুক দেখাকে কেন্দ্র করে অবিশ্বাস্য কল্পনার বাতাবরণ। একে নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের একটি ভিডিও গল্প বা চলমান জীবন্ত গল্প বলতে বড় ইচ্ছে হয়। এটা বুঝি আনকাট বা আনএডিটেড ভিডিও ছবি। গল্পটা পরিধির একটা বিন্দু থেকে বারবার অভ্যন্তরের একাধিক ঘটনা কেন্দ্র ছুঁয়েছে- সেখান থেকে আবার বৃত্ত পরিধির ব্যাপকতায় দার্শনিক ভাবনাকে ছড়িয়েছে। গল্পে চরিত্রগুলোর কখনো সংকোচন কখনোবা সম্প্রসারণ ঘটেছে। সেগুলো ব্যক্তিগত আচরণের অঙ্গীভূত ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। মানুষের মনে সাদা কালোসহ নানা রঙের দাগ, নানা বৈশিষ্ট্য। কখন কোনটা কীভাবে প্রস্ফুটিত হয়- নিন্দায় মন্দে অভিনবত্বে, হিং¯্রতায় মহানুভবতায় প্রেমে রোমান্টিকতায়- পূর্বানুমান করা যায় না। ঘটনা সংঘটিত হলেই কেবল যা স্পষ্ট হতে থাকে। এই যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মনোজাগতিক বিলোড়ন, তা কেবল একজন গ্রেট লেখকের পক্ষেই তুলে আনা সম্ভব। সৈয়দ শামসুল হক হলেন আমাদের সেই লেখক। যিনি কাজটি করে দেখিয়েছেন। ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ নামের ছোটগল্প এবং ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসের বর্ণনার অ্যাপ্রোচগত দিক তাই একইরকম মনে হয়। পার্থক্য আয়তনের পরিধি- একটা ছোট ফর্মের কাজ, অন্যটা বড় ফমের্র। তবে ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ নামের ছোটগল্পটিতে অ্যাটিচুড ছিল অধিকতর সংযত ও নিয়ন্ত্রিত। গল্পের অন্তিমেও ‘খেলারাম খেলে যা’র মতো ভাষাগত যৌন উত্তেজনার ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকল না, বরং এক দার্শনিক মুহ্যমান আবেশের বিস্তৃতি দেখি। একটা হাহাকার যেন মানবিক নিঃসঙ্গতায় মহাকালের ভাষা হয়ে হিমালয়ের শৃঙ্গ উপস্থাপন করলো। মনে বহু ভাবনার বিস্তার- কী হতো যদি এমনটা না হতো।
বাংলা ছোটগল্পের প্রায় দু’শ বছরের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই বাংলা ছোটগল্পের বিশ্ব যাত্রা। সঙ্গে আরো কয়েকজন শক্তিশালী লেখক- সবাই মিলে বাংলা ছোটগল্পকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, চেখভ আর মোপাসাঁ- তিনজনই ছোটগল্পের আন্তর্জাতিক ‘গ্রেট মাস্টার্স’। আর ‘গল্পের কলকব্জা’র যুগস্রষ্টা সৈয়দ শামসুল হকও আধুনিক মননজাত একজন বিশ্বমানের গল্পকার। ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ তার একটি কুশলী নির্মাণ।