বাউলদের উৎপত্তি ও আক্বীদা-বিশ্বাস

By Published On: June 10, 2025Views: 47
Image

বাউলদের উৎপত্তি ও আক্বীদা-বিশ্বাস
সুমন সালাহউদ্দিন

বাউল একটি লোকধর্মভিত্তিক আধ্যাত্মিক সম্প্রদায়, যার রয়েছে স্বতন্ত্র তত্ত্ব, দর্শন ও সাধন-পদ্ধতি। তাদের ধর্মবিশ্বাস সংগীতনির্ভর, দেহতত্ত্বকেন্দ্রিক এবং সহজিয়া ও সুফিবাদের মিশ্রণে গঠিত হলেও সুফিজম থেকে আলাদা।

বাউলরা কোনো প্রচলিত ধর্মের অনুগামী নন—তারা নিজস্ব মানবধর্মে বিশ্বাসী। এ কারণে তারা মসজিদ বা মন্দিরে উপাসনা করেন না, ধর্মগ্রন্থ মানেন না এবং প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনেও আগ্রহী নন। এমনকি বাউলদের মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতিতে দাফন বা দাহ কার্য সম্পন্ন হয় না। 

সামাজিক বিবাহবন্ধনকেও তারা অস্বীকার করেন। নারী-পুরুষের অবাধ সহাবস্থান ও জীবনযাপন তাদের সাধনার একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত।

তাঁর দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—”মনের মানুষ”। লালনের মতে, এই “মনের মানুষ” অদৃশ্য, ধর্ম – জাতি – লিঙ্গনিরপেক্ষ, এক রহস্যময় সত্তা —যার অন্বেষণই মানবজীবনের চরম সাধনা।

বাউলদের উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। ধারণা করা হয়, প্রাচীন ফিলিস্তিনের রাস-সামারা অঞ্চলে ‘বা‘আল’ নামের প্রজনন দেবতার পূজা হতো, যার উপাসনায় যৌনাচার একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে পারস্যে ৮ম-৯ম শতকে সুফিবাদের বিকাশ ঘটে, যেখানে ‘বা‘আল’ নামে একটি সুফী ধারারও উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব সুফী সাধকগণ গান গেয়ে মরুপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াতেন এবং পরে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তাদের ভাবধারার মিল ঘটেছিল হিন্দু-বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদ ও বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে। ধীরে ধীরে বাংলায় গড়ে ওঠে বাউল সম্প্রদায়। কেউ কেউ মনে করেন, “বাউল” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “বাতুল” (পাগল) অথবা ফারসি “বা‘আল” (বন্ধু/উন্মাদ) শব্দ থেকে। এদের বৈশিষ্ট্যই হলো প্রেমমগ্নতা ও সংসারত্যাগী উদাসীনতা।

বাউল সাধনায় গান একটি মৌলিক উপাদান। বিভিন্ন খানকা, মাজার ও আখড়ায় তাদের গান ও সাধনার চর্চা হয়। ড. আহমদ শরীফের মতে, ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া ধারার সংমিশ্রণে যে নতুন ধারাটি তৈরি হয়, পরবর্তীতে তা ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব গ্রহণ করলেও মূল বিশ্বাসগত কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে। ফলে বাউল মত একটি স্বতন্ত্র জীবনদর্শনে পরিণত হয়, যা প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার বাইরে অবস্থান করে। তারা বলেন, “কালী, কৃষ্ণ, গড, খোদা/ কোন নামে নাহি বাধা/ মন কৃষ্ণ গড খোদা বল রে” — অর্থাৎ তাদের কাছে সৃষ্টিকর্তার নাম নয়, অন্তর্নিহিত বোধই মুখ্য।

বাউলদের দার্শনিক ভিত্তি সর্বেশ্বরবাদী (pantheistic)। তারা বিশ্বাস করেন, দেহের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিহিত। দেহতত্ত্ব তাদের সাধনার মূল ভিত্তি, যেখানে কামাচারকে একপ্রকার ঈশ্বরোপলব্ধির উপায় হিসেবে দেখা হয়। তাদের মতে, দেহের বাইরে আলাদা কোনো পরমসত্তা নেই; বরং দেহের মধ্যেই আল্লাহ, কৃষ্ণ, ব্রহ্মা, পরমাত্মা—সব সত্তার মিলন ঘটে। এভাবেই ‘আনাল হক’ বা নিজেকে ঈশ্বরতুল্য ভাবার চিন্তাধারার জন্ম হয়। যদিও তারা আরবি ও ইসলামি পরিভাষা ব্যবহার করেন, জীবনাচরণে তারা মূলত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।

বাউল সাধনার আরেকটি মুখ্য দিক হল গুরুবাদ। গুরু বা সাঁইকে তারা পরম সত্যের অবতার মনে করে এবং বিশ্বাস করে গুরু অসন্তুষ্ট হলে তার ইহ-পরকাল বিপন্ন হতে পারে। এদের গুরুশ্রেষ্ঠ হলেন লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০), যিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বসবাস করতেন। তার ধর্মীয় পরিচয় অস্পষ্ট, কারণ তিনি কোনো ধর্মীয় নিয়ম মানতেন না। তাঁর দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—”মনের মানুষ”। লালনের মতে, এই “মনের মানুষ” অদৃশ্য, ধর্ম – জাতি – লিঙ্গনিরপেক্ষ, এক রহস্যময় সত্তা —যার অন্বেষণই মানবজীবনের চরম সাধনা।

বাউল সাধনায় যৌনাচার ও গাঁজা সেবনকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখা হয়। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে, যাদের সঙ্গে সহবাস ছাড়া সাধনা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। তারা মদ্যপানকে উশৃঙ্খলতার কারণ মনে করলেও গাঁজা ও তামাক সেবনকে ধ্যানের সহায়ক বলে গ্রহণ করে। বৈরাগ্যবাদী জীবনযাপনের অংশ হিসেবে তারা সাধারণত অগোছালো, জটাধারী ও সাদাসিধে পোশাকে চলাফেরা করে। এমনকি কিছু বাউল রোগমুক্তির জন্য নিজ মূত্র পান করে এবং এক ধরনের ‘প্রেমভাজা’ নামক পদার্থ (যা মানবদেহের নিষ্কাশিত পদার্থ দ্বারা প্রস্তুত) সেবন করে থাকে।  সুতরাং, বাউলরা একটি স্বতন্ত্র ও জটিল তত্ত্বভিত্তিক সম্প্রদায়, যাদের বিশ্বাস ও আচরণ প্রচলিত ইসলামি আক্বীদা ও আমল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের জীবনাচরণ, উপাসনাপদ্ধতি ও দর্শন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যদিও অনেকে তাদের আরবি শব্দচয়ন ও মুসলিম নাম দেখে বিভ্রান্ত হন। এ কারণে বাউলদের গানে ব্যবহৃত ধর্মীয় পরিভাষা, আচার-আচরণ ও বিশ্বাসকে সবসময় বিচার-বিশ্লেষণ করে আলাদা বিবেচনায় দেখা উচিত।

4.5 2 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments