বিদ্যাসাগরের মানবিক শিক্ষাদ্যুতি – ড. সন্দীপক মল্লিক

By Published On: October 2, 2022

বিদ্যাসাগরের মানবিক শিক্ষাদ্যুতি
ড. সন্দীপক মল্লিক

মহাকবি মাইকেল মদুসূদন দত্ত(১৮২৪ খ্রি.- ১৮৭৩ খ্রি.)-এর সত্যায়ন :

ক.
বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু ! – উজ্জ্বল জগতে..(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনাসমগ্র ; ঢাকা : সালমা বুক ডিপো, ২০১০ খ্রি., ১৫৫)

খ.
হে ঈশ্বরচন্দ্র ! বঙ্গে বিধাতার বরে
বিদ্যার সাগর তুমি ; তব সম মণি..
বঙ্গের সুচূড়ামণি করে হে তোমারে
সৃজিলা বিধাতা, তোমা জানে বঙ্গজনে..
.. হে বঙ্গরত্ন..(নানা কবিতা, ঐ, পৃ.১৬৯)

গ.
You are the greatest Bengali that ever lived and people speak of you with glowing hearts and faithful eyes..(Letter to Vidyasagar, Letters, H, ঐ, পৃ. ৫৪০)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(১৮২০ খ্রি.Ñ ১৮৯১ খ্রি.) শৈশবে ছিলেন বাধাবন্ধনহীন।‘প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই তাঁর বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়।’[বিদ্যাসাগর চরিত(স্বরচিত), বিদ্যাসাগর রচনাবলী, তীর্থপতি দত্ত-সম্পাদিত, পরিমার্জিত ৩য় সংস্করণ ; কলকাতা : তুলি-কলম, ২০০২ খ্রি., পৃ. ৬] মাঝে মাঝে তিনি হয়ে পড়তেন ‘অতিশয় অবাধ্য’।(ঐ, পৃ. ৩১১) তিনি ছিলেন ‘বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী’, ‘পুরুষানুক্রমে সংস্কৃতব্যবসায়ী’(চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করার জন্যে উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত-অর্থে ব্যবহৃত) পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়(ঐ,পৃ. ৩২৩) এবং ‘অমায়িক, পরোপকারী ও ক্ষমতাবান’(ঐ, পৃ. ৩১৭) পরিবারের কন্যা মাতা ভগবতীদেবীর শ্রীমণ্ডিত সন্তান।

১.
ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব ও তারুণ্য-সংবর্ধিত সত্যময় জীবন-আবহ-সঞ্চয়নে শুদ্ধ-বিদ্যার্জনের ভূমিকা লক্ষ্যযোগ্য। তিনি তাঁর জন্মস্থান মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি হন পাঁচ বছর বয়সে। ১৮২৮ খ্রি.-এ তাঁর পিতা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে। এ শ্রেণিতে তিনি শিক্ষাবৃত্তি ও পারিতোষিক অর্জন করেছিলেন। এ কলেজে তিনি ইংরেজি শ্রেণিতে ভর্তি হন ১৮৩০ খ্রি.-এ। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিনি পুরস্কৃত হন। তিনি সাহিত্য শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন ১৮৩৩ খ্রি থেকে ১৮৩৫ খ্রি, পর্যন্ত। বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে লাভ করেন শিক্ষাবৃত্তি। উল্লেখ্য, এ কলেজে তিনি শিক্ষাগুরুরূপে পেয়েছিলেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কারকে। অলঙ্কার শ্রেণিতে যশস্বী পণ্ডিত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের শিষ্য ছিলেন তিনি। ১৮৩৬ খ্রি.-এর বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি পারিতোষিকসহ সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেন। ১৮৩৯ খ্রি. পর্যন্ত তিনি বেদান্ত শ্রেণি ও স্মৃতি শ্রেণির পরীক্ষাতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পারিতোষিক লাভ করেন। শিক্ষকরূপে পেয়েছিলেন শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি ও হরনাথ তর্কভূষণসহ আরো অনেক পণ্ডিতকে। বহুবার শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত প্রতিভাসমুজ্জ্বল ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৩৯ খ্রি.-এ কলকাতার ‘হিন্দু ল কমিটি’র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে প্রদান করা হয় ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি। পরবর্তীতে তিনি ন্যায় শ্রেণি ও জ্যোতিষ শ্রেণির শিক্ষার্থীরূপেও কৃতিত্ব অর্জন করেন।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উপর্যুক্ত বিদ্যায়তনিক শিক্ষা ঈশ্বরচন্দ্রের মননে মূলতঃ প্রাচ্যবিদ্যার মূল প্রস্রবণরূপেই সঞ্চারিত হয়েছিলো। সে-কারণেই বঙ্গভারতবর্ষীয় জন-আত্মার ইহকালিক সত্তা-সংকট-বিদূরণ-বাসনা তথা অশন-বসন-তৃষ্ণা-পূরণ-কল্পনার বিয়োগান্তক স্থিতিকে প্রগতিপন্ন করার যৌক্তিক পরিকল্পনায় তিনি ছিলেন সন্দীপ্ত। সার্বভৌম সর্বজনীন মানবিক মঙ্গলই ছিলো ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনের মূলপ্রভা। ‘দীনের বন্ধু’, ‘বিদ্যার সাগর’, ‘করুণার সিন্ধু’, ‘বঙ্গরত্ন’ ইত্যাদি গুণ-উজ্জ্বল শব্দ-ঐশ্বর্যের রূপান্বিত ধারক ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে কবি মধুসূদনের মতো অনেকেই তাঁর প্রত্যক্ষ সহায়তায় জীবন-সম্বুদ্ধ হয়েছিলেন। আর্ত-পীড়িত জনের তিনি ছিলেন অন্তরতর সুহৃদ। তাঁর সর্বগুণাত্মক পরিব্যাপ্তির কারণেই তিনি ‘Greatest Bengali’-রূপে কীর্তিত হয়েছেন ‘Glowing hearts’ ‘Faithful eyes’’-ধারণকারী বাঙালি সারস্বত সমাজে।

২.
ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রথম পণ্ডিতের পদে নিযুক্তি লাভ করেন ১৮৪১ খ্রি-এর ২৯ ডিসেম্বর।(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : জীবনী ও কিছু তথ্য, ঐ, পৃ.৭) এই পর্যায়ে তিনি যথাযথভাবে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা আয়ত্ত করেন। তাতে তাঁর বিশ্ববীক্ষা-সঞ্জাত বোধ ও বোধির বিস্তারণ ঘটে। তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত হন ১৮৫১ খ্রি.-এ।(ঐ)

তিনি ১৮৬৪ খ্রি.-এ ইংলণ্ডের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৮৮০ খ্রি.-এ ভারত সরকার তাঁকে সি. আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন। সমাজ-সংস্কারমূলক আন্দোলনে তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী শক্তিমত্ত এক পুরুষ। ‘বিধবাবিবাহ আইন’ ‘পাশ’ করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তিনি বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধাচরণও করেছিলেন। জন-জীবন-ঔজ্জ্বল্যের লক্ষ্যে দক্ষিণ বাংলার বিদ্যালয়গুলোর ‘সহকারী ইনস্পেক্টর’ থাকাকালেই তিনি ১৮৫৬ খ্রি.-এর মধ্যেই প্রত্যেকটি জেলায় ৫টি করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চিরায়ত মানবিক ন্যায় ও কল্যাণ-দর্শন-সত্যায়ত পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেন তিনি। নিরলস চৈতন্য-সন্দীপনায় স্ত্রীশিক্ষার সমুন্নতিকল্পে তিনি ১৮৫৭ খ্রি. থেকে ১৮৫৮ খ্রি.-এর মধ্যেই বাংলার বিভিন্ন জেলায় ৩৫টি(ঐ, পৃ. ৮) বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, জীবনের অন্তিমপর্বে তিনি সাঁওতাল পরগণার কার্মাটারে বসবাস করেছিলেন নিরুপদ্রব সন্তুষ্টি নিয়ে। অনাড়ম্বর সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মুগ্ধ-সরল জীবনযাত্রার প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ-হেতু তিনি সম্পৃক্ত হন তাদের দৈনন্দিনতায়। একটি বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি ঐ অন্ত্যজ-সুন্দর মানবগোষ্ঠীর জীবন-সমুন্নতির লক্ষ্যে।(ঐ, পৃ. ৯)

৩.
বিদ্যাসাগরের মানবিক শিক্ষাচিন্তায় দ্যুতিমান হয়েছিলো প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সমন্বয়ী সদ্ভাবনা ও মাঙ্গলিক সমুদ্দীপ্তি, যা পূর্ণ মানবিক সত্তার প্রসূন-সম্বোধির চারু-আয়োজনরূপেই ছিলো সংজ্ঞাপিত। তাঁর ‘শিক্ষাচিন্তা‘-বিষয়ক ‘Notes’ on The Sanscrit College(পরিশিষ্ট, ঐ, পৃ. ৫০৯ খ্রি.) -এর মৌলিক কয়েকটি দিক :

a.
The creation of an enlightened Bengali literature should be the first object of
those who are entrusted with the superintendence of Education of Bengal.

b.
An elegant, expressive and idiomatic Bengali style cannot be at the command
of those who are not good Sanscrit scholars. Hence the necessity of making
Sanscrit scholars well versed in English language and literature.

c.
It is very clear then that if the students of the Sanscrit College be made familiar
with English Literature, they will prove the best and ablest contribution to an
enlightened Bengali Literature.

d.
The students of the Sanscrit College should be thoroughly instructed in Grammar
and literature – the latter including poems, dramas and prose works.

e.
In rhetoric, they should be instructed in two or three capital works, such as
Kavya Prakasha … and two or three chapters of Sahitya Darpana.

f.
In Law, they should study the following works : the institutes of Manu, Metakshara
Sec. II Vivada … Dayavagha, Dattaka-mimansa and Duttakachundrika. The study
of these is sufficient to make one conversant with the Hindu Laws current in
almost every part of India.

g.
Students come to the Darshana or Philosophy class, their acquirements in English
will enable them to study the modern Philosophy of Europe. Thus they shall have
ampler opportunity of comparing the system of philosophy of their own, with the
new Philosophy of Western World. Youngmen thus educated will be better able
to expose the errors of ancient Hindu Philosophy simply from Europian sources.

h.
Another advantage is that students so prepared, wishing to transfer the philosophy
of the of the West into a native dress will possess a stock of technical word,
already in some degree familiar to intelligent natives.

বিদ্যাসাগর উপর্যুক্ত ‘Notes’ সম্পাদন করেন মূলতঃ তারুণ্য-সমুজ্জ্বল `Native’ বাঙালি জন-আত্মার যথাযথ শিক্ষা তথা প্রকাশ-বিকাশ-সমন্বিত বাংলা সাহিত্য-সংরচনা-শক্তি-নৈপুণ্যকেই ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে। তিনি বিশ্বাস করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আলোকিত ইউরোপীয় তথা প্রতীচ্য-সাহিত্য, দর্শন বাঙালির জীবনায়তনকে সমৃদ্ধ করবে পূর্ণত্বের বিভূষণায়। তবে প্রাচ্য-দর্শনকে যুক্তি-সমন্বয়ী রূপাবয়বে গ্রহণ করতেও নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সমন্বয়বাদী প্রগতি-সম্বুদ্ধ এক মহাত্মা !

৪.
ঈশ্বরচন্দ্র ৩২ খানা গ্রন্থের প্রণেতা। কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনাও করেছিলেন তিনি। সকল গ্রন্থই ইহকাল-সম্বোধির ঔজ্জ্বল্য-ধারণকারী। সকল গ্রন্থই যুক্তিবাদী কল্যাণ-মনস্বিতার অলঙ্কৃত শোভা যেন ! সকল গ্রন্থের মূল-প্রতিপাদ্য সকল মানবিক গুণের সাধনা। উদ্দেশ্য পূর্ণ-মানবজীবনের প্রকাশ, বিকাশ এবং সকল উদ্ভিদ-প্রাণির সুসম জীবন-যাপনার সহায়ক শক্তিরূপে প্রতি ‘ব্যক্তি-আমি’র উজ্জীবন।

গ্রন্থগুলি হলো : বেতাল পঞ্চবিংশতি(১৮৪৭ খ্রি.), বাঙ্গালার ইতিহাস, ২য় ভাগ(১৮৪৮ খ্রি.), জীবনচরিত(১৮৪৯ খ্রি.), বোধোদয় – শিশুশিক্ষা(৪র্থ ভাগÑ১৮৫১ খ্রি.), সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা(১৯৫১ খ্রি.), ঋজুপাঠ [১ম ভাগ(১৮৫১ খ্রি.), ২য় ভাগ(১৮৫৩ খ্রি.), ৩য় ভাগ(১৮৫৪ খ্রি.), ৪র্থ ভাগ(১৮৬২ খ্রি.)], ব্যাকরণ কৌমুদি [১ম ভাগ(১৮৫৩ খ্রি.), ২য় ভাগ(১৮৫৩ খ্রি.), ৩য় ভাগ(১৮৫৪ খ্রি.), ৪র্থ ভাগ(১৮৬২ খ্রি.)], সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব(১৮৫৪ খ্রি.)(১৮৫৪ খ্রি.), শকুন্তলা(১৮৫৪ খ্রি.), বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব(১৮৫৫ খ্রি.), বর্ণপরিচয়[১ম ভাগ(১৮৫৫ খ্রি.), ২য় ভাগ(১৮৫৫ খ্রি.], বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – ২য় পুস্তক(১৮৫৫ খ্রি.), কথামালা(১৮৫৬ খ্রি.), চরিতাবলী(১৮৫৬ খ্রি.), মহাভারত – উপক্রমণিকা ভাগ(১৮৬০), সীতার বনবাস(১৮৬০ খ্রি.), আখ্যানমঞ্জরী(১৮৬৩ খ্রি.), শব্দমঞ্জরী(১৮৬৪ খ্রি.), ভ্রান্তিবিলাস(১৮৬৯ খ্রি.), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার(১৮৭১ খ্রি.), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার – ২য় পুস্তক(১৮৭৩ খ্রি.), পদ্যসংগ্রহ[১ম ভাগ(১৮৮৮ খ্রি.), ২য় ভাগ(১৮৯০ খ্রি.), নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস(১৮৮৮ খ্রি.), সংস্কৃত রচনা(১৮৮৯ খ্রি.), শ্লোকমঞ্জরী(১৮৯০ খ্রি.), বিদ্যাসাগর চরিত – স্বরচিত(১৮৯১ খ্রি.), ভূগোল খগোল বর্ণনম্(১৮৯২ খ্রি.)।

‘বেনামে প্রকাশিত’ রচনাসমূহ : অতি অল্প হইল(১৮৭৩ খ্রি.), আবার অতি অল্প হইল(১৮৭৩ খ্রি.), ব্রজবিলাস(১৮৮৪ খ্রি.), বিধবাবিাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা(১৮৮৪ খ্রি.), রত্নপরীক্ষা(১৮৮৬ খ্রি.)।

৫.
বিদ্যাসাগর মূলতঃ ছিলেন বোধি-দীপ্ত এক ন্যায়-ভাব-উদ্বর্ধক লোকশিক্ষক। তিনি ছিলেন অনুভব-সম্পূর্ণতার কারিগর। তাই তাঁর গদ্যায়নে পরিষ্ফুট বিভিন্ন পদ-সংযুক্তির নিরুপম পরিমাপণ-কৌশল। তাঁর বাক্যান্বয়ে Ñ সম্বেগী উচ্চারণ-আয়োজনে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস-ব্যবহৃত অনুভব-বৃত্তে সংবৃত হয়েছে সর্বজনীন উচ্চ-অনুচ্চ ঢেউদল-সম্পুষ্টি। তিনি শিক্ষায়োজনেও যেমন কৃতী ছিলেন, তেমনি শিক্ষা-প্রসারণার লৈখিক ব্যাপ্তিতেও ছিলেন বিশারদ।

তাঁর শব্দাহরণ-প্রক্রিয়ায় ছিলো ইহকাল-সন্দীপী শিক্ষা-প্রেষণাই সঞ্জীবিত। আর্থ-পূর্ণতা, কল্যাণ-দীপ্তিমান জীবন-ঐশ্বর্য – শরীরী-মানস-শুদ্ধতা-পরহিত-ব্রত-গুণ-প্রকাশক বাংলা তৎসম শব্দই সংবর্ধিত হয়েছে তাঁর আখ্যানমঞ্জরীর পট-আবহে। তিনি ছিলেন এক শাশ্বত অনুভব-শিল্পী। তাই এমনই ছিলো তাঁর সৃজিত বাক্যের গ্রন্থনা !

যৌক্তিক উচ্চারণ – ‘স্বকালে বিদ্যাসাগরকে যথার্থভাবে বুঝেছিলেন .. মধুসূদন। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন – `The man to whom I have applied has the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengali mother.’-এর চাইতে বিদ্যাসাগরের যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ পরিচয় আর কিছুই হতে পারে না।’[আহমদ শরীফ, ‘অনন্য ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, আহমদ শরীফ রচনাবলী-দশম খণ্ড(ড. পৃথ্বিলা নাজনীন নীলিমা-সম্পাদিত), প্রথম প্রকাশ ; ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ২০১৬ খ্রি., পৃ. ৪৭২]

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop