মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের রামজয় তর্কভূষণের পুত্র ঠাকুরদাসের সন্তান হয়েছে।রামজয় কোমরগঞ্জ হাটে যেয়ে পুত্র ঠাকুরদাসকে খবর দিলেন -পরিবারের সদস্য সংখ্যায় একটি এঁড়ে বাছুর সংযুক্ত হয়েছে। ঠাকুরদাস বাড়ি এসে এঁড়ে বাছুর দেখার জন্য গোয়াল ঘরের দিকে যেতে চাইলে রামজয় -‘ ওদিকে নয়, এদিকে’ বলে আতু্ড়ঘর দেখিয়ে দিলেন। ঠাকুরদাস দেখলেন স্ত্রী ভগবতী দেবী জন্ম দিয়েছেন এক পুত্র সন্তানের। ঠাকুরদাস তার পিতা রামজয়ের উপর কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলে রামজয় বললেন-‘ এই ছেলে খুব একগুঁয়ে এড়ে বাছুরের মতো হবে। জন্মের দিনটি ছিল ১৮২০ সালের ২৬ সেপেটম্বর। পিতামহ রামজয় নাম রাখলেন – ‘ ঈশ্বর চন্দ্র ‘। একগুঁয়ে স্বভাবের ঈশ্বরচন্দ্র ব্যাকরণ, কাব্যশাস্ত্র, অলংকারশাস্ত্র, বেদান্তশাস্ত্র, ন্যায়শাস্ত্র – এই বিষয়গুলোতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য সংস্কৃত কলেজের পন্ডিতেরা ১৮৪১ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘ বিদ্যাসাগর’ আখ্যা দিয়ে প্রশংসাপত্র তুলে দেন। একগুঁয়ে স্বভাবের বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । মতের মিল না হওয়ায় আত্নাভিমানে আঘাত লাগায় সংস্কৃত কলেজের আ্যসিসট্যান্ট সেক্রেটারী পদের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বেকারত্বের জীবন গ্রহণ করতেও দ্বিধা করেন নাই।তাঁর একগুঁয়ে, জিদ এবং লক্ষ্যে অবিচল থাকার সবচাইতে বড় ফল বিধবা বিবাহ চালু হওয়া। ১৮৫৬ সালের ১৯ জুলাই হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়। কিন্তুু আশ্চর্যের বিষয় এই বিধবা বিবাহ প্রচলনে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতার সাথে সাথে তথাকথিত আলোকিত মানুষদেরও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসের সূর্যমুখী একটি চিঠিতে লিখেছিল-‘ ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পন্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয়,সে যদি পন্ডিত, তবে মূর্খ কে?’বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে অনুবাদক ছাড়া কিছু মনে না করলেও রবীন্দ্রনাথ বাংলা গদ্যসাহিত্যে সহজতা,সরসতার প্রবর্তক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ‘যর্থাথ শিল্পী’ রূপে আখ্যা দেন। তাঁর রচিত বেতাল পঞ্চবিংশতি বাংলা গদ্যে নবযুগ এনে দিয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধু বিদ্যায় সাগর হয়েছেন তা নয়,তিনি দীনের বন্ধু হয়ে করুনার সাগরও হয়েছেন।তাঁকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেন-‘ বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে। করুনার সিন্ধু তুমি,সেই জানে মনে,দীন যে দীনের বন্ধু ‘।নিজের জীবন বিপন্ন করেও বিদ্যাসাগর অনেককেই অর্থ সহায়তা দিতেন যেমন দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত যে গল্পটি আলোচিত তা হলো তিনি মাতৃ আজ্ঞা পালনে ঝড়ের রাতে সাতার কেটে দামোদর নদী পার হয়েছেন।তিনি শুধু মাতৃ আজ্ঞা নয়,এ দেশের নারী শিক্ষার বিস্তারে একজন আলোকদূত। তার স্ত্রীজাতির প্রতি পক্ষপাত নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হলে তিনি এর প্রত্যুত্তরে আত্নচরিতে লিখেন-‘ আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতি বলিয়া, অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন।আমার বোধ হয় সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমনির স্নেহ,দয়া,সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং ওই সমস্ত সদগুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতি না হয়,তাহা হইলে,তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমন্ডলে নাই’। রাইমনি কলকাতায় তার সবটুকু স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলেন ভিটেছাড়া বালকটির ওপর।ভিটেছাড়া বালকটি আমাদের উপহার দিয়েছেন ‘ বর্ণ পরিচয়’ এর মতো বিখ্যাত শিশুতোষ গ্রন্থ। এই শিশুতোষ গ্রন্থছাড়াও বড়দের জন্য বিদ্যাসাগর যে রচনাগুলো লিখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ ভ্রান্তিবিলাস’, ‘রঘুবংশম’, ‘ কুমারসম্ভব ” মেঘদূতম’ ‘ অভিজ্ঞান,শকুন্তলম, অতি অল্প হইল এবং ‘ আবার অতি অল্প হইল’ ইত্যাদি।তাঁর জন্মের দুইশত বছরে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে জানাই। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ‘যর্থাথ মানুষ’ বিদ্যাসাগরেরা যুগে যুগে আসুক মনুষ্যত্বের বিবেকবর্জিত পৃথিবীতে।
তথ্য সূত্রঃ
(১) আত্মচরিত- ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।
(২) দ্বি- শতবর্ষের প্রণাম- অভিজিৎ বিশ্বাস।
(৩) স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের অবদানঃ একটি মূল্যায়ন- তানিয়া তহমিনা সরকার।
(৪) রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর মূল্যায়নঃ পুনর্বিবেচনা- সরওয়ার মুরশেদ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামেও স্বাক্ষর করতেন; ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১) উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার।[২] সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তার। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন।[৩] বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। তাকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রচনা করেছেন যুগান্তকারী শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয়-সহ একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা। নারীমুক্তির আন্দোলনেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।