ধ্রুব এষ পাবে সামান্যে কি তার দেখা

By Published On: August 28, 2021
শনিবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী।
ষাটের দশকে আবির্ভূত সৃজনশীল কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী কথাসাহিত্যে একেবারে নতুন আদলের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রবেশ করেন বাউল স্বভাবী বলে পরিচিত গুণী কথাকার বুলবুল চৌধুরী। তার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘টুকা কাহিনী’।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জসীমউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ব্র্যাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। সর্বশেষ ভাষা ও সাহিত্যে ২০২১ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।
শিল্পী ধ্রুব এষ ত্রিশ বছরের অধি বুলবুল চৌধুরীর সাথে ভালোবাসায় লেপ্টে আছেন। বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে শিল্পী ধ্রুব এষের লেখাটি দিয়েই নান্দিকের পক্ষ থেকে স্মরণ করছি তাঁকে।

ধ্রুব এষ
পাবে সামান্যে কি তার দেখা

জ্যোতিষ শাস্ত্র জানিনা তাতে কী,
আয়ুরেখা চিনি না তাতে কী, বুলবুল ভাইয়ের
হাত দেখে আমি ভবিষ্যতৎবাণী করে দিয়েছি,

আপনি ৯৮ বছর বাঁচবেন।’

বলবুল ভাই কোন ভূবনের বাসিন্দা?
নির্ণয় মুশকিল।
ধোঁয়ার অন্তর্গত তাঁর ভুবন?
হয়ত।
ধোঁয়ার ভেতর থেকে দেখেন যা কিছু দেখার এবং লেখক হিসাবে তার স্বত্ত্ব ভােগ করেন।

কিছুদিন হলাে আমরা সাতিবাকে পেয়েছি। হ্যামপ্রেস সাতিবা । জ্যামাইকান একটিভিস্ট, লিরিসিস্ট এবং সিঙ্গার । রবিবারে আমি আর মিথুন বুলবুল ভাই সকাশে গিয়েছিলাম। মিথুনের কারিগরি সহায়তায় বুলবুল ভাইকে ‘উ লালালা দেখানাে গেছে। সাতিবার গান ।
‘কেমন বুলবুল ভাই?’
‘কই পান মিয়া এগােরে? ভারি সুন্দর।’
‘এর নাম হ্যামপ্রেস সাতিবা। সরলসিধা একটা বাংলা শুনবেন নামটার? গাইনজার ফুল।’
‘কন কি মিয়া!’

‘আপনের শরীর একটু ভালো হইলেই আমরা আটদিনের জন্য জ্যামাইকা চলে যাব। সাতিবার সঙ্গে বসে জয়েন্ট টানব। ‘
‘হইল।’
বুলবুল ভাইয়ের ভুবনের শব্দ, ‘হইল।’ সব তাতেই ‘হইল।’
‘বুলবুল ভাই নদীতে ঘুরব।’
‘হইল মিয়া।’
‘বুলবুল ভাই লাঙ্গলবন্ধ চলেন।’
‘হইল মিয়া।’
‘বুলবুল ভাই শ্মশানে যাব।’
‘হইল মিয়া।’
বিশ্বকর্মাও সন্ধ্যায় দু-দণ্ড জিরান দেন। সন্ধ্যা দেখেন। বুলবুল ভাইয়ের অত নাই। ঘড়ি পরেন না। মানে আমি পরতে দেখি নাই। আগে কি পরতেন? কখনও জিজ্ঞাস করি নাই। অথচ সময় নিয়েই কারবার মানুষটার। সময় ছাড়া শিল্প সাহিত্য হয়? কবি কথাকাররা কী লিখে রেখে যান? তাদের নিজস্ব ধারনার সময়কে ।
হিমু ভাইয়ের বাসা আটতলা। লিফট আছে। লিফট নষ্ট ছিল একদিন। হেঁটে আটতলায় উঠে বুলবুল ভাই হিমু ভাইকে দর্শন দিলেন।
‘কী বুলবুল ভাই? হাঁপান ক্যান?’
‘হাঁপাই না হিমু ভাই । কথা কওনেরও টাইম নাই মিয়া, আপনেরে এই কথাটা কইতেই উঠলাম। আইচ্ছা রে মিয়া যাই অহন, যাই।’
বলে হিমু ভাইকে হতভম্ব রেখে বুলবুল ভাই আবার নিচে নেমে গেলেন। সময় এত কম।

বুলবুল ভাই এখন কেমন আছেন?
কেমন থাকবেন আবার। যেমন থাকার কথা তেমন আছেন । জগতে বন্ধুর অভাব নাই তার। শত্রু একজন। ভাবি। বিগত দুই-আড়াই মাসে প্রমােশন হয়েছে ভাবির। মহাশক্র হয়েছেন বুলবুল চৌধুরীর।
এইম ইন লাইফ ছিল সিনেমা বানাবেন, বুলবুল ভাই হয়ে গেছেন লেখক। সিনেমার পরিচালক হলে এখন ‘মহাশত্রু নাসরিন’ নাম দিয়ে সিনেমা বানাতেন।
বাসনা মাথা থেকে যায় নাই। সিনেমা বানাবেন। গল্প ভেবে রেখেছেন, চিত্রনাট্য লিখবেন, নায়িকা ঠিক করে রেখেছেন। তন্বী শ্যামা শিখরদশনা নায়িকা। ফোনে কথ হয় এবেলা ওবেলা।
“তােমাকে নিয়ে আমি হাওড়ে ঘুরতে যাৰ মেয়ে।’
‘যাবেন।’
‘আমরা সারারাত থাকব বজরায়।’
‘থাকবেন।’
‘আমি তােমাকে স্পর্শ করে দেখব।’
‘দেখবেন।’ এই হলাে অবস্থা।

রূপসজ্জা ধীরেন চলচ্চিত্র। বহুকাল ধরে বন্ধু বুলবুল ভাইয়ের । বিপদে থাকেন। আপদে থাকেন। আছেন, থাকবেন। এখন কী করেন?
বন্ধুকৃত্য। সঙ্গে থাকেন, সেবাযত্ন করেন, রেকর্ড করে গানও শােনান বন্ধুকে। তার মোবাইল ফোনে মিউজিক স্টেশন আছে। রেডিও থেকে পছন্দের বাংলা, উর্দু ও হিন্দি গান রেকর্ড করে রাখেন।

বুলবুল ভাইকে একটা বাংলা গান শােনান।
বারে বারে আর আসা হবে না।
এমন মানব জনম আর পাবে না— ||
আফসােস, বুলবুল ভাইয়ের গানে মন নাই। বিরাট আফসােস।
‘কোনদিন উনারে একটা গান শুনতে দেখছেন?’
‘বাদ দেন ধীরেন দা—।’’
‘না, এই বয়সে মানুষ আল্লাহ খােদার নাম নেয়, হজ্ব করে আসে, উনি এইসব কিছুর মধ্যে নাই। বুঝি না। এত বড় লেখক।’
‘আল্লাহ খােদার নাম উনি নেয় ধীরেন দা। উনার মুশকিল একমাত্র ভাবিরে নিয়া— বাবারে বাবা! দুই চোখে দেখতে পারে না ভাবিরে। সারাজীবন এই মহিলা তার ত্যাড়া ত্যাড়া কথাই শুধু শুনল। এই রকম মানুষ দেখি নাই! আরে বাবা কৃতজ্ঞ থাকো—।’
‘উনার মাথায় কাজ করে না এইসব।’

সহানুভূতি এবং ক্রিটিসিজম। নয়া বাস্তবতা না, বাস্তবতা। ধীরেন দা, ধীরেন কর্মকার। রূপসজ্জা ধীরেন চলচ্চিত্র-সিনেমার মেকআপ আর্টিস্ট ধীরেনদা। টেলিভিশন নাটকের কাজও করেন। কাজকর্ম লকডাউনে বন্ধ। যথেষ্ট সময় এজন্য বরাদ্দ করতে পারেন বুলবুল ভাইকে। বুলবুল ভাই না শুনলেও নিজেই দায়িত্ব মনে করে শােনান, এমন মানব জনম আর পাবে না— |

তা কেউই মনে হয় পাবে না। ‘আবার আসিব ফিরে’ মনে করি। বুলবুল ভাই কী হয়ে ফিরবেন?

ভীষণ রঙিন এক কাঠঠোকরা হয়ে।
আমার মনে হয়।
তবে সে বহুকাল পরের কাহিনি।
জ্যোতিষ শাস্ত্র জানিনা তাতে কী, আয়ুরেখা চিনি না তাতে কী, বুলবুল ভাইয়ের হাত দেখে আমি ভবিষ্যতৎবাণী করে দিয়েছি, ‘আপনি ৯৮ বছর বাঁচবেন।’

এখন বয়স কত বুলবুল ভাইয়ের?
সাত-আট বছর আগে নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ি মােড়ের সোহেল হােটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের সজ্জন ম্যানেজার সাহেব আন্দাজ করে বলেছিলেন, ‘একশ পনরাের কম তাে হইব না।’
বুলবুল ভাইয়ের বয়স একশ পনেরাের কম হবে না। সাত-আট বছর আগে একজন পুরানঢাকাবাসীর আন্দাজের বহর। বুলবুল ভাই রেগে কাই হয়ে গিয়েছিলেন, ‘আপনের আন্দাজের কোনও আগা মাথা নাই মিয়া! আমার বয়েস একশ পনরাে মনে হয় আপনের? গত আগস্টে মােটে ছেষট্টি হইছে মিয়া!’

গত আগস্টে বুলবুল ভাইয়ের মােটে চুয়াত্তর বছর বয়স হয়েছে। আমরা কয়েকজন আছি, তার জন্মদিন উদযাপন করি। জন্মদিন না জন্মসন্ধ্যা। জল ঘাসের সন্ধ্যা, কেউ ঝিম কেউ মাতাল হয়ে যায়। পােস্টার হয়। মিথুন বুলবুল ভাইয়ের ছবি তোলে, বিপ্লব কম্পিউটারে পােস্টার বানায়। পােস্টারে ছবির সঙ্গে কিছু একটা লাইন লেখা থাকে।
২০২০ জন্মসন্ধ্যার পােস্টারে ছিল, ‘ধোয়ার অন্তর্গত মানুষ।’ ২০২১ এ ‘ডিজাইন ফ্রি ‘৭৪।’ ২০২২ এ কী? ভেবে রেখেছি। ‘জলকাদার প্রতিপালক’। বুলবুল ভাইয়ের একটা নিরুদ্দেশ ছােট গল্পের নাম এটা। রােববার বা বিচিত্রা ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল।

লিখেন কম আবার গল্প হারান। ‘চন্দ্রদাদীর পাঁচালি’ বলে একটা গল্পের কথা খুব বলেন। ‘জোনাকি সন্নিকট’ ফিরে পেয়েছেন তাঁর বন্ধু গাজী ভাইয়ের সংগ্রহে ছিল বলে। ফটোকপি দেখেছি। সাইক্লোস্টাইলে ছাপা এক লিটল ম্যাগের পৃষ্ঠা । লিটল ম্যাগ ‘সবাক’ | সম্পাদক : সুজীবিত বুলবুল। মানে বুলবুল ভাই।

‘সুজীবিত বুলবুল নাম নিছিলেন কেন?’
‘মনে নাই মিয়া।’
‘মনে নাই! আপনি একটা ঘুঘু, বুলবুল ভাই। ঘুঘু না বাস্তুঘুঘু।’
‘যা মনে লয় কন রে মিয়া।’
‘হ্যা, নাম নিছেন সুজীবিত বুলবুল, বাস্তুঘুঘু না আপনি! আজ পত্রিকায় এক কবির নাম দেখলাম গ্রামসি।’
‘গ্রামসি! এইটা কী মিয়া? চাঁদসীর মতাে নি?”
“আমসির মতােও হইতে পারে।’
‘বুঝি না মিয়া।
‘আপনের এইসব বােঝার দরকার নাই। আপনি ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ। আপনার মতাে থাকেন।’

বুলবুল ভাই তাঁর মতােই থাকেন। ডিজাইন ফ্রি।
‘তারে নিয়ে আমরা গান বানাইছি একটা। ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ। সৌর সুর দিয়া গাইছে। মিউজিক ভিডিও বানাইছে মিথুন । মডেল বুলবুল ভাই।’

Bulbul chowdhury & Dhruba esh

ইউটিউব লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=A14b4QzOwEQ

লিরিক উল্লেখ করে রাখি এখানে।

দাঁড়িয়ে আছেন অথবা হাঁটছেন
পুরনাে গল্পের শব্দ কাটছেন
ধােঁয়ার অন্তর্গত মানুষ
ধোঁয়ার অন্তর্গত
তাঁর মাথার ভেতর ওড়ে বিষয়
দলিলপত্র যত
পৃথিবী ঘুরছে তিনিও ঘুরছেন
চরকি ঘুরছে তিনিও ঘুরছেন
লাটিম ঘুরছে তিনিও ঘুরছেন
বসে বসে দেখি ঘুরছেন অবিরত
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ….

কাছের দূরের নিকট পরের
আউ-পাতালি ঘরের দোরে
আগন্তুকের মতাে
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ…
ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ
আপনি মানুষ না ঘুড়ি
উড়তে থাকুন ঘুরতে থাকুন
বুলবুল চৌধুরী।

এই হয়ত বুলবুল ভাইয়ের ভুবন আংশিক।
সম্পূর্ণ নির্ণয় মুশকিল না, অসাধ্য।
কে কারে চিনতে পারে
ঘাটপাড়ের সংসারে,
চিনি চিনি তাও অচেনা
চেনার উপায় থাকে না রে…।।
ঘাটপাড়ের সংসারের মানুষ। সব মানুষ।

বুলবুল ভাই ঘাটপাড়ের এবং ঢেউয়ের ।

পাখির চোখ দিয়ে এক পাথার দেখা যাক। ছােট ছোট ঢেউয়ের, ঝিলমিল ঢেউয়ের। ঢেউয়ের সেই পাথারে এক মানুষ ভাসছেন, মন্দ্র কোরাস শুনি তার রক্তকণিকার, ‘ঢেউগুলাে যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা…।

মানুষটা বুলবুল ভাই। আমাদের চেনা বুলবুল ভাই। অথবা একদম অচেনা। ভাই। আরেক ভুবনের বাসিন্দা একজন। সেই ভুবন টুকা কাহিনির, তিয়াসের লেখনের পাপপুণ্যির। পাবে সামান্যে কি তার দেখা? কেউ?

ব্যক্তি পরিচিতি :
গাজী ভাই : গাজী আজিজুর রহমান, প্রাবন্ধিক
 হিমু ভাই : হুমায়ুন কবীর হিমু, নাট্যকর্মী 
মিথুন : কামরুল মিথুন, ছবি কারিগর 
বিপ্লব : বিপ্লব দেব , গ্রাফিক্স কারিগর
Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop