বন্দীশিবিরের কবি মজলুম আদিব
শেখ ফিরোজ আহমদ
কবি শামসুর রাহমান অত্যন্ত নম্র, কোমল ও ভদ্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতার বরপুত্র নাকি তিনি কবিতার পয়গাম্বর- কী বলব তাঁকে? অনেক বিশেষণেই তাঁকে ভূষিত করা যায় কিন্তু কোনো বিশেষণই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবতে থাকি তিনি সময়ের একজন মহৎ কবি, আমার মনে পড়ে ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের জননন্দিত দুটি কবিতার কথা, একটি হলো ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং অন্যটি ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’। এই দুটি কবিতা তাঁকে যে রকম ঈর্ষণীয় খ্যাতি এনে দিয়েছে তার তুলনা বিরল। বাংলাদেশের আনাচেকানাচের প্রতিটি মানুষ অন্তত একবার হলেও কবিতাদুটির আবৃত্তি শুনেছে। ভবিষ্যতেও শুনবে। নাকউঁচু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ভালো কবিতার মানের প্রসঙ্গটি সামনে এনে, এ নিয়ে নিন্দামন্দ করতে পারেন। ওটা তাদের স্বভাবের ব্যাপার।
ভালো কবিতা এবং জননন্দিত কবিতার পার্থক্য আমি বুঝি। এই পয়েন্টের ওপর জ্ঞানসিদ্ধ উচ্চ তাপের যাঁরা ঝাঁঝালো বিতর্ক জমাতে ভালোবাসেন- আমি তাঁদের কথাগুলোও জানি। তাঁরা যতটুকু ভালো বলতে পারেন, লিখতে পারেন তারও চাইতে নিম্নমানের। কাজেই ওইদিকে কান না দিই। বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেখা শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের দুঃসাহসিক কবিতাগুলোর প্রতি তাকাতে চাই।
কবি শামসুর রাহমান কবি-আত্মার নিঃসঙ্গ ভ্রমণে যেমন নিমগ্ন ছিলেন, তেমন ছিলেন সমকালীন প্রতিটি রাজনৈতিক ঘাত-অভিঘাত দ্বারা আন্দোলিত। যে কারণে তিনি সময় সংলগ্ন রুখে দাঁড়ানোর শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন।
বুদ্ধদেব বসু যখন তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় শামসুর রাহমানের ‘রূপালী স্নান’ প্রথম ছাপালেন, শামসুর রাহমান তখনো ছাত্র। পরে কবিতাটি তাঁর ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ নামক কাব্যগ্রন্থে ঠাঁই পায়। বুদ্ধদেব বসু যখন ‘রূপালী স্নান’ ছাপালেন, সেই লেখাটিই সুধীজনদের চমকে দিল। কবি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অনার্সে পড়লেও ফাইনাল পরীক্ষা দিলেন না। পরে বিএ পাশ করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি অনবরত কবিতা লিখেছেন। অনেকগুলো বই তাঁর। তার মধ্যে কয়েকটি হলো- প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এক ধরনের অহংকার, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, আমি অনাহারী, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো, হরিণের হাড় ইত্যাদি।
শামসুর রাহমানের কাব্যপ্রতিভাকে সমগ্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বলা হয় ‘নাগরিক কবি’ বা ‘নাগরিক মননের কবি’। শামসুর রাহমানের কাব্যকৃতী কি শুধু এইটুকু সস্তা চিহ্নায়নের মধ্যে সীমায়িত? মিথ, প্রতীক ও অন্যান্য উপাদানে সমৃদ্ধ যে বিশাল কাব্যসম্ভার রেখে গেলেন, তাঁকে ‘নাগরিক কবি’ বানিয়ে সেগুলি কি পরিত্যায্য করছি আমরা? তাঁর কবিতার কিয়দংশে মধ্যবিত্ত জীবন ও নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ এবং আধুনিক মনষ্কতার ঠাঁই পাওয়াই কি শামসুর রাহমানের ‘নাগরিক কবি’ হবার প্রধান কারণ? হয়তো বা।
আমার কাছে শামসুর রাহমানকে ‘নাগরিক কবি’ বা দেশের ‘প্রধান কবি’ অভিধায়- চিহ্নিত করার এই প্রয়াসটাকেই হাস্যকর লাগে। এতে কবিকে সমগ্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, এই বোধ যদি তাঁরা আমলে নিয়ে সচেতন হতেন, ভালো লাগত। শামসুর রাহমানকে অনায়াসেই একজন মহৎ কবি বা গ্রেট পোয়েট বলা যায়, সেটাই বেশি শোভন হত। কারণ ‘প্রধান কবি’ বাক্যবন্ধটির মধ্যে একধরনের কৃত্রিম মুগ্ধতা ও লেজুড়বৃত্তির ঘুণপোকা ঢুকিয়ে দেওয়া আছে যা শামসুর রাহমানকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তাঁর সমগ্রতাকে কেটে দুর্বল করেছে। আর সব জায়গার মতো শিল্পসাহিত্যের জগতেও গ্রুপিং আছে। এইগুলি সেই গ্রুপিংয়েরই অংশ। সবাই সুন্দরের কথা বলে, বলে মানবমুক্তির কথা, মানবিকতার কথা- অথচ নিজ গ্রুপের বাইরে কেউ কাউকে সহ্য করতেই পারে না। কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর, এতগুলো বছর কেটে গেল। কিন্তু ‘কথিত’ প্রধান কবিকে নিয়ে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল না। না রাষ্ট্র কিছু করেছে, না তাঁর স্তাবকবৃন্দ করেছেন। তিনি শুধু বছরে দু’বার তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর দিনে পত্রিকাগুলোর স্মরণপাতায় ঠাঁই পান বা টিভি চ্যানেলগুলিতে কয়েক সেকেন্ডের সংবাদ হয়ে ওঠেন। তখন মনে বড় কষ্ট পাই।
আজকাল অনেকের কবিতাই এদেশ-ওদেশের কবিরা অনুবাদ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এই লেনদেন বাড়ছে। এটা খারাপ নয়, কিন্তু খটকা লাগে যখন দেখি তাঁদেরকে বলা হয় আন্তর্জাতিক কবি ব্যক্তিত্ব। আমি বিমূঢ় হয়ে ভাবি- শামসুর রাহমান তাহলে কী? সবাই বলছেন তিনি দেশের ‘প্রধান কবি’- তারপরও কি তাঁর কবিতার আন্তর্জাতিক মান থাকা না থাকা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে কোথাও! সেজন্যই কি তাঁকে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বকবিতার আসরে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা আমরা কেউ-ই নিতে পারিনি? শুধু অপর বিখ্যাত কবি আল মাহমুদের সঙ্গে কে বড় কবি, কে ছোট কবি বলে তুলনায় রেখে তর্কালাপ চালিয়ে গেছি বছরের পর বছর। কবিতার কী লাভ হলো তাতে? আমরা তো শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরী- তিনজনকেই হারালাম। তিনজনই তাঁদের কাব্যধারায় রাজনৈতিক উপাদানকে সংযুক্ত করেছেন যে যার মতোন।
আমি কবি শামসুর রাহমানকে প্রথম সামনাসামনি দেখি ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়। ১৯৭৯ হবে সেটা-জিয়াউর রহমানের মার্শাল’র ভিতর তিনি বগুড়ায় গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সেউজগাড়ী নামের জায়গায় একটা মতবিনিময় হয়। একই মিটিংয়ে আমি এবং আমার আব্বাও উপস্থিত ছিলাম। আব্বা প্রফেসর শেখ সালেহ আহমদ তখন বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান। অনুষ্ঠানে তিনি কিছু কথা বললেন, স্মৃতিচারণ করলেন- বিশেষ করে বললেন, ‘রূপালী স্নান’ কবিতার কথা। আব্বা যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তরুণ কবি শামসুর রাহমানকে তখন থেকেই চিনতেন। অনুষ্ঠানে আমিও একটি কবিতা পড়েছিলাম, নিজের লেখা না রাহমান ভাইয়ের তা ঠিক মনে নেই। সে-ই আমার প্রথম ঢাকার একজন বড় কবিকে সামনাসামনি দেখতে পাওয়া। দু-তিন মাস পর আমি ঢাকায় এসে দৈনিক বাংলা অফিসে গিয়েছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- উনি আমাকে চিনলেন। আমি কবি শামসুর রাহমানের ভক্ত হলাম। এরপর আরো কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়েছে। এরশাদ জমানায় যখন তাঁকে বিচিত্রার চাকরি ছাড়তে হলো, তখন তাঁকে সম্পাদক করে ইস্কাটন থেকে ‘মূলধারা’ নামের পত্রিকা বের হতে শুরু করেছিল। সেখানেও দেখা হয়েছে।
কবি শামসুর রাহমান কবি-আত্মার নিঃসঙ্গ ভ্রমণে যেমন নিমগ্ন ছিলেন, তেমন ছিলেন সমকালীন প্রতিটি রাজনৈতিক ঘাত-অভিঘাত দ্বারা আন্দোলিত। যে কারণে তিনি সময় সংলগ্ন রুখে দাঁড়ানোর শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন। সময় তাঁর কবিতায় প্রবলভাবে উপস্থিত। কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা, যেমন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ‘আসাদের শার্ট, সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ‘ইলেক্ট্রার গান’, নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। এভাবেই এল ১৯৭১- মুক্তিযুদ্ধের বছর।
শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো নিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং তাঁর সহধর্মিণী গৌরী আইয়ুব ‘বন্দী শিবির থেকে’ নামে বইটি যুদ্ধের মধ্যেই বের করতে চেয়েছিলেন।
কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ তাঁর একটি লেখায় বললেন- ‘‘মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সেদিনের সেই অগ্নিগর্ভ, রক্তাক্ত বাংলাদেশে—কখনো অবরুদ্ধ ঢাকা, কখনো নরসিংদীর এক গণ্ডগ্রামে বসে একজন কবি তখন সক্রিয় ভিন্ন অভিযাত্রায়। খুব সন্তর্পণে একের পর এক তিনি আগরতলা বা কলকাতায় পাঠাচ্ছেন অন্য রকম অস্ত্র। শব্দ, বাক্য আর পঙ্ক্তিতে প্রস্তুত করা ঝাঁঝালো সেই অস্ত্রের নাম—কবিতা। আর ওই অজর কবিতাগুচ্ছের একটি ‘স্বাধীনতা তুমি’।’’
কবি নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে বসে অশান্ত মনের বোঝাপড়ার কবিতা লিখছেন। গেরিলাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তারা গোপনে সেসব কলকাতায় রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে পাঠাচ্ছেন। পদে পদে বিপদের আশঙ্কা। আবু সয়ীদ আইয়ুব সেসব ছাপানোর ব্যবস্থা করছেন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। তাও শামসুর রাহমানের নামে নয়, একটি ছদ্মনামে। শামসুর রাহমান তখন দেশের ভিতর- স্বনামে কবিতা ছাপা হলে হয়তো বা বিপন্ন হবে তাঁর জীবন। এসব ভেবেই আবু সয়ীদ আইয়ুব শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো ছাপালেন ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে। এই নামের অর্থ ‘নির্যাতিত লেখক’। একাত্তরের ২১ জুলাই সাপ্তাহিক দেশ-এ ছাপা হয় ‘স্বাধীনতা তুমি’।
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
শামসুর রাহমান কিছু কবিতা লিখলেন ঢাকায় বসে, কিছু লিখলেন নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে ঢাকা ছেড়ে সপরিবারে তিনি নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলীতে, নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। একদিন এপ্রিলের প্রথমার্ধের এক সন্ধ্যায় কবির গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হলেন একজন তরুণ। ‘কালের ধুলোয় লেখা’ নামের আত্মজীবনীতে শামসুর রাহমান বলছেন- ‘‘সন্ধ্যেবেলা চাদরে মাথা-ঢাকা একজন যুবক এসে হাজির হলেন আমাদের বাড়ির সামনে। যুবকের মুখটি আবিষ্কার করতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টির মতিউর রহমান। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ পশ্চিমবঙ্গে যাচ্ছেন আরও ক’জনের সঙ্গে। আমিও যাব কিনা, তিনি জিজ্ঞেস করলেন আন্তরিকভাবে।’ এই মতিউর রহমান আর কেউ নন, বর্তমানের প্রথম আলোর সম্পাদক তিনি।
কিন্তু মাস দেড়েক বাদে কবি ঢাকায় ফিরলেন। পরে আবার বাড়ি। শামসুর রাহমানের মাথায় ঘুরছিল, কেবলি একটি দৃশ্য। এটা কি কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে- নাকি কল্পনায় দেখা? কবি নিঃসন্দেহ ছিলেন না। দৃশ্যটি দেখছিলেন এরকম– রাস্তার ধারে একজন গুলিবিদ্ধ মানুষ নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছেন শ্লোগান, তাঁর দেশের সপক্ষে, দেশবাসীর সপক্ষে।
এই ছবি থেকে নাকি গ্রামের বাড়ির পুকুরপারের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শামসুর রাহমান একটানে, একবসাতেই আধঘণ্টা বা বেশিকিছু সময়ের মধ্যে লিখে ফেললেন – ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ নামের বিখ্যাত কবিতা দুটি। পরে লেখার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন কবি ‘কালের ধুলোয় লেখা’ নামের আত্মজীবনীতে। কী বলেছেন? বলেছেন- এপ্রিল মাসের সাত অথবা আট তারিখ দুপুরের কিছু সময় পূর্বে তাঁদের পুকুরের কিনারে গাছতলায় বসেছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল মৃদু-মন্দ বাতাস তাঁর শরীরে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। পুকুরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং কিশোর-কিশোরীরা মহানন্দে সাঁতার কাটছিল। হঠাৎ কবির মনের মাঝে বিদ্যুতের মতো একটা ঝিলিক খেলা করে উঠল। ‘সম্ভবত একেই বলে প্রেরণা। কবিতা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি চটজলদি আমার মেজ চাচার ঘরে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে একটি কাঠপেন্সিল এবং কিছু কাগজ চাইলাম। সে কাঠপেন্সিল এবং একটি রুলটানা খাতা দিল। এই খাতা পেন্সিল দিয়ে সে যেন নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করল। আমি সেই কাঠপেন্সিল এবং খাতাটি নিয়ে সাত তাড়াতাড়ি পুকুরের দিকে ছুটলাম। পুকুর মুন্সীবাড়ির একেবারে গা ঘেঁষে তার অবস্থান ঘোষণা করছে যেন সগর্বে। পুকুরের প্রতিবেশী সেই গাছতলায় আবার বসে পরে খাতায় কাঠপেন্সিল দিয়ে শব্দের চাষ শুরু করলাম।’
একসঙ্গে বেশ কিছু কবিতা লেখার পর ঢাকায় ফিরে শামসুর রাহমান সেই কবিতাগুলি তুলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক ও শাহাদাত চৌধুরীর (পরবর্তীতে বিচিত্রা সম্পাদক) হাতে। তাঁরা বিভিন্ন কায়দায় লুকিয়ে নিয়ে গেল কবিতাগুলো। পরে শাহাদাত চৌধুরী শিল্পী আবুল বারক আলভীর মাধ্যমে সেগুলো ওপারে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছেপাঠিয়ে দেন ।
শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো নিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং তাঁর সহধর্মিণী গৌরী আইয়ুব ‘বন্দী শিবির থেকে’ নামে বইটি যুদ্ধের মধ্যেই বের করতে চেয়েছিলেন। পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে বইটি কলকাতার অরুণা প্রকাশনী থেকে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বের হলো। ততদিনে অবশ্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে, এই দুটি কবিতাও ততদিন থাকবে।
শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৪শে অক্টোবর ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রাম। পেশা ছিল সাংবাদিকতা। কাব্য সাধনা করেছেন। কিছু অনুবাদ ও শিশুতোষ কবিতা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য শামসুর রাহমান আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, মিতশুবিশি পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি দান করে। তিনি ১৭ই আগস্ট ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।