কারও কারও জীবন যে মিথ হতে পারে তা আমাদের কবি জীবনানন্দ দাশ মাত্রই আমাদের প্রমাণ। বলছি এ কারণেই যে, তিনি কবি হিসেবে কেমন তার চেয়ে বেশি আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জীবনাচারণ। তার মৃত্যু ও বিষাদ নিয়েই আমরা পাঠকেরা বেশি কথা বলি! কবি মাত্রই খেয়ালি এবং বেখেয়ালি, বোধ করি জীবনানন্দের ব্যাপারে এশব্দগুলো বেশি প্রচলিত। অথচ তার কবিতার দিকে তাকালে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই। শেষ নেই দৃশ্যের পর দৃশ্যের বাক-বণিতা।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
–শঙ্খমালা
এমনকি উপমার ক্ষেত্রে যে তিনি অন্যন্য এখন আর এটাও বলতে আমাদের আর দ্বিধা নেই। না হলে আর তিনি কিভাবে লিখতে পাড়েন “দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা; পাখি আর মানুষ এবং তাদের মন কি রকমভাবে একাকার হতে পারে আর কিভাবে মিলেমিশে একাকার হয় এমন দৃশ্যের। যা পড়ার পর একজন সুস্থ হৃদয়ের পাঠককে হতে হয় অপ্রকৃতিস্থ! যেন পাঠক নিজেই হাঁটতে থাকেন তার দেখানো বা অদেখার পথে ধরে। ধীরে ধীরে পরিণত হন এক নিজেকে দেখার নেশায়।
আলো—অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,—কোন এক বোধ কাজ করে !
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
-বোধ
মানুষের বোধের ক্রিয়ার শেষ নেই। কখন কিভাবে সে নাড়া দিয়ে উঠে কেউই সঠিক বলতে পারে না। কবিও তাই, যখন যেখান থেকে যা কিছু কুঁড়িয়ে নেন তখন সেটা তার একান্ত নিজের হয়ে উঠে এবং সে তা দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো লেখা করতে থাকেন। তখন এই জগত বা আপনি—আমি তার কাছে কেউই না বা কিছুই না! কবির কাছে কেবলই থাকে শূন্য আর মহাশূন্যস্থান। যেখান থেকে তিনি শুরু করেন তার আনন্দ যাত্রা। যেতে যেতে হয়তো তিনি জাগতিক সবকিছু ভুলে গিয়ে শুনতে পান অন্য এক কণ্ঠস্বর, দেখতে পান এই মহাবিশ্বের সব সৃষ্টিই যেন তাকে ডেকে এনে কোলে বসাচ্ছে। তিনি শিশু। তিনি এক মহাশিশু।
আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলো: ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’
-সে
কিন্তু সে (কবি) তারে পায় বা না পায়, চিরকাল তাকে চিনে রাখে মনে, জ্ঞানে। ধ্যানের মতো করে রাখে নিজের কাছে, খুব গোপনে। কখনও কখনও ধরা দেয় কবির অদেখা পৃথিবীতে। যেখানে আমাদের (পাঠকের) খুব সহজে প্রবেশ করবার অধিকার থাকে না। কিন্তু কেউ কেউ পায় তাকে আবছা দেখার সুযোগ। সেটা হয়তো কবি নিজেই আমাদের করে দেন তার শব্দে, উপমায়, ছন্দে। মানুষ মূলত খুব সহজ। আর তাই কঠিনও বটে! “জীবনানন্দ দাশ” হলো আমাদের তেমনই এক কবি। যিনি তার ভেতরে প্রকৃতিকে করে তুলেছেন এক মহান নগরী। যার পথে যেতে যেতে তিনি দৃশ্যের পর দৃশ্যকে প্রাচর্যে ভরে তুলেছন তার বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে।
কেউ যাহা জানে নাই—কোনো এক বাণী—
আমি বহে আনি;
একদিন শুনেছ যে—সুর-
ফুরায়েছে,—পুরানো তা—কোনো এক নতুন—কিছুর
আছে প্রয়োজন,
তাই আমি আসিয়াছি,—আমার মতন
আর নাই কেউ!
-ধূসর পান্ডুলিপি
কে আর থাকে এমন মানুষের সাথে। যেখানে তিনি নিজেই নিজের আলো—নিজেই তুমুল অন্ধকার। আমাদের বাংলা সাহিত্যে ‘জীবনানন্দ দাশ’ বিরল এক প্রতিভা। যাকে আমার মাথায় তুলে নাচতে পারি আরও হাজার হাজার বছর ধরে। আমাদের চিন্তার জগতে তিনি প্রকৃতির মতোই শান্ত এবং রঙিন। কখনোবা এলোমেলো বিন্যাশে ধরা দেওয়া গভীর বন। তাই আমরা ‘জীবনানন্দ দাশ’-এর কাছে বারবার যাবো আমাদের গভীর কিছু শোনার জন্য। যাবো পাখিদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব করবার জন্য। আরও যাবো এ কারণেই যে, আমার মানুষ খুব সহজ কিন্তু কঠিন। কখনোবা ‘জীবনানন্দ দাশ’-এর মতো উদাসীন।