আমার ডেল্টা প্রেম
(রোগশয্যার পাঁচালি)
লুকোচুরির ছোঁয়াছুঁয়ির কাহিনী – ৫ম পর্ব
(যা আগেই উল্লেখ করা উচিত ছিল ধারাবাহিকতার জন্য, ভুলে বাদ ছিল। এখানে দিলাম সুজন পাঠকদের জন্য।)
হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে আই সি ইউ তে নিয়ে যাবার পথে চলমান শয্যায় শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম গলিপথে, লিফট এ কোথায় অজানা নির্জন ঠিকানায় নিয়ে চলেছে শয্যার সামনে যুবক পিছনে যুবতী ঠেলে- টেনে নিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সমগ্র অঞ্চল, আমি শীতার্ত দুইখানা কম্বলে ঢাকা পুরনো শরীর। বাহকদের তাড়া দেখে মনে হল যেন তারা বিড় বিড় করছে,
” চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে “।
সাথে আমিও যেন শুণতে পেলাম,
” চল তোরে দিয়ে আসি ঈশ্বরের কোলে। “
কি জ্বালা! যখনই ঈশ্বরচিন্তা করার চেষ্টা করেছি পরিণত বয়েসে, এক ব্যাটা প্রশস্ত-কপালের “এঁড়ে বাছুর” উড়ুনী গায়ে, হাতে একখানা “বর্ণপরিচয়” নিয়ে বড় বড় চোখ তুলে হাজির ; এই আমার লৌকিক অতিলৌকিক ঈশ্বর! এরা তবে কোথায় নিয়ে চলেছে আমার শরীরটাকে! ঠেলে নিয়ে বিশাল দোপাল্লা দুয়ার ঠেলে শয্যাশুদ্ধ নিয়ে থামল এক প্রশস্ত ঘরে একটা লম্বা টেবিলে আমার দেহখানি আলতো করে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল কোন কথা না বলেই। আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি পুরো কাঁচের দেয়ালের ওপিঠে দুজন বসে আমাকে দেখছে ! কানে ভেসে এল, “হাত মাথার দুপাশে উপরে রাখুন, যখন বলবো শ্বাস বন্ধ করে রাখবেন “- অনেকটা দৈববানীর মতো শুণতে পেলাম।
চিৎ, লম্বমান, চোখ সিলিংটাকে দেখছে। কোথায় সিলিং? এ তো আকাশ? ঘননীল উদার নিঃসীম। আমার মন শরীর থেকে মুহূর্তে ছিটকে বেরিয়ে হয়ে গেল এক উড়ন্ত নীলকণ্ঠ পাখি। আমি যেন হাটখোলার দত্ত বাড়ির জমিদারদের শারদীয়ার প্রাক্কালে অনন্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়া এক নীলকন্ঠ, মহাবিশ্বে উড়ে চলেছি শারদ উৎসবের আনন্দবার্তা ছড়িয়ে চলেছি।
ভেসে যাই উঁচু, আরো উঁচু অসীম নীল শূণ্যপুরে । ভাসতে ভাসতে হয়ত দেখা হয়ে যেতেও পারে কোন আরেক উড়ন্ত নিঃসঙ্গ শ্বেত পারাবতের সাথে যে পাঁচ বছর আগে তার নীলকণ্ঠকে রেখে গেছে এই গ্রহের গাছগাছালি পাখ পাখালিদের কুজনে গুঞ্জনের প্রবল স্রোতে। তার সাথে, আরো উঁচুতে। তাকিয়ে দেখি অনেক অনেক অনেক নীচে পড়ে আছে আমার অসুস্থ জরাগ্রস্ত শীর্ণ দেহ এক টেবিলে।
পরক্ষনেই একটা চাপা গুম গুম শব্দ এই আবদ্ধ ঘরটিকে যেন মৃদু কাঁপাতে লাগল। আমার শয্যা ধীরে ধীরে ঢুকতে শুরু করেছে এক আলো আঁধারী সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গটি পাক খাচ্ছে, আর গোঁ৷ গোঁ করে এক গম্ভীর শব্দ তুলে ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। আমি তার গহ্বরে ক্রমাগত গভীরে গড়িয়ে চলেছি।
একি!! আমি ত “ছার্ণ ” এর লার্জ হেড্রন কোলাইডারের ভিতর ঈশ্বরকণার সন্ধানে এসেছি ! কি কান্ড! এরা দেখছি আমার এতকালের দীর্ঘ কৌতুহলের কোনটাই বাকি রাখবেনা, সব আশা পূরণ করে দেবে? সেই কবে থেকে আমি ঈশ্বরের খোঁজে তন্ন তন্ন করে চার্বাক থেকে হাঁটাহাটি শুরু করে কার্ল মার্ক্সে এসে থমকে আছি, ধরতে পারিনি, আজ এরা এই সুযোগ করে দিল?
বোস সাহেব, ও, বোসন-যুগল, শোণ, আজ আমিই শেষ করব তোমাদের সেই বহু আকাঙখিত গড-পার্টিকল, বা আদুরে নামের ঈশ্বরকণার খোঁজ, সেই কণা ধরে মূঠোয় করে তুলে দেবো তোমাদের হাতে৷ আজ আর আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবেনা “ঈশ্বর”।