আমার ডেল্টা প্রেম
(রোগশয্যার পাঁচালি। শেষ পর্ব)
লুকোচুরির ছোঁয়াছুঁয়ির কাহিনী – ৬ষ্ঠ পর্ব
প্রতি মুহূর্তেই হারাজেতার খেলা চলছে বুঝতে পারলাম। একে আমার শরীর শীর্ণ, তায় মুক্ত পরিবেশে থাকায় দূষিত আবহাওয়ায় না থাকার ফলে আমার দেহে তেমন প্রতিরোধ শক্তি নেই, তাই আমার বিরহবিধুরা প্রেয়সীর আলিঙ্গনপাশ খুবই দৃঢ়বদ্ধ । তাকে বিচ্ছিন্ন করায় জীবন সৈনিকরা আমার কাছ থেকে খুব সহায়তা পাচ্ছেননা।
জীবনে প্রথম হাসপাতালে, বেড প্যান, ইউরিন পট এসকল আমার একেবারেই না পসন্দ-ই যে শুধু , তাই নয়, আমার দেহের সব ভালভ একেবারে সেঁটে থাকে। বিছানায় বর্জ্য ত্যাগ? শরীর বিদ্রোহী। অথচ সৈনিকরা বলছেন, তিন দিন বাওয়েলসে সব জমা, জটিল করে তুলছে। সবাই বলছে ‘বাবা’, শিশুর মত আমার দেহ নিয়ে নাড়াচাড়া, অক্সিজেন নল, ড্রিপের চ্যানেলে দুই বোতল থেকে অবিরত তরল ঢুকছে শিরায় আরো কত সব যন্ত্র মনিটর করছে আমার দেহ।
একেক সময় মনে হল, আমি রাজাধিরাজ। মানুষ যন্ত্র হাত ধরাধরি করে আমার দেহরক্ষীর দায়িত্ব নিয়েছে। শিশুর মত ছেড়ে দিলাম নিজেকে, লাজ লজ্জা চেনা অচেনার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সমর্পণ করলাম নিজেকে যোদ্ধাদের হেফাজতে। ঘন ঘন রক্ত নেয়া, নানারকম ওষুধ খাওয়ানো, পাশ ফিরিয়ে শোয়ানো, গা স্পঞ্জ করে শুকিয়ে পোশাক পরিবর্তন, খাইয়ে দেয়া, কি না করছে ওরা। কি অপরিসীম মমতায়, অভ্যস্ত দক্ষতায় এসবই হচ্ছে আমার শরীর শায়িত রেখে। ভাবতেও পারিনি, একটা মানুষ শুধু শুয়ে থেকেই তার প্রয়োজনীয় জীবন চর্যা চালিয়ে যেতে পারে।
আর আমার সব চলতি ধ্যান ধারণা ওলট পালট করে দিল একটি অভিজ্ঞতা। বর্তমানের যুবশক্তিকে আমরা বাচাল অলস খেলাপ্রিয় পরিশ্রম বিমুখ আয়েসী বলে দিন রাত অভিযোগ করি।
এখানে না এলে জানতামই না পূর্ব ভারতের সব প্রদেশের তরুণ তরুণীরা, বাঙ্গালীরাও এখানে নবযৌবনের উত্তুঙ্গ তরঙ্গমালায় নেচে বেড়াচ্ছে মৃত্যুর মুখ থেকে জীবন ছিনিয়ে আনার অসীম সাহসী এক এক যোদ্ধা। মুখে কথা নেই, যন্ত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে যন্ত্রের হাত ধরাধরি করে কি নিপুণ দক্ষতায় প্রতিটি কাজ করে চলেছে। দ্রুত এবং বিচক্ষণ বিবেচনায়। সব তরুণ তরুণীদের আমি চোখ ভরে দেখি। আমার সকল ভাবনা ভেঙেচূড়ে খান খান হয়ে গেল। মায়ায় শ্রদ্ধায় আবেগে ভালবাসায় আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি ভারতের যুবশক্তি আগ্নেয়গিরির মত সঞ্চিত তেজস্বী লাভা বুকে চেপে এক লড়াকু শক্তিতে যুদ্ধে রত। আমি ওদের প্রণাম জানাই।
প্রায় অচৈতন্য, আলোছায়ার মধ্যে প্রথম রাত সকাল হল, আমার সামনে এক মূর্তিমতী সহাস্যে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, গুড মর্ণিং! সহসা দেখি তিনি সাড়ে ছ ফুট লম্বা হয়ে গেলেন, বুকে কাঁধে অসংখ্য উজ্জ্বল ঝলমলে পদক ঝুলছে কমান্ডার ইন চীফএর পোষাকে, অনেক যুদ্ধজয়ের স্মারক দুলছে তার স্থির শরীরে। জেনারেল জে এন চৌধুরী অথবা জেনারেল মানেকশ-, অথবা জগজিৎ সিং অরোরা- ই হবেন। শুয়ে শুয়েই স্যাল্যুট করলাম।
স্মিত হাসিতে মাথা দুলিয়ে ছোট্ট মেয়েটির মত খুশীতে বললেন, এইতো ভালো হয়ে গেছেন, ষ্টেবল,। চারিদিকে ঘিরে থাকা নানা ইউনিফর্মের সঙ্গী সঙ্গীনীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, মোর টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স। বলে হাত নেড়ে চলে গেলেন। বুঝলাম এঁর সৈনাপত্যেই এরা সব লড়াই করে যাচ্ছে।
দুদিন পর আমাকে দশ তলার একটা আকাশঘরে সরিয়ে দেয়া হল। আলাদা সংরক্ষিত ওয়ার্ড। কেন? এই প্রথম জানলাম, আমার দেহে বাসর সাজিয়েছিলেন প্রেয়সী “ডেল্টা” রূপিনী করোণা ভাইরাস। তার ফুলের মালা শুকোয়নি, তাই এখানে তাকে সম্পূর্ণ বিদায় দেয়া হবে।
আহাগো, এসেছিল আমাকে নিয়ে অলকাপুরীতে গিয়ে ঘর বাঁধবে, শত্রু ডাক্তার নার্স গুলি বাদ সাধলে। দুদিন পর অভিমানে তিনি আমাকে তালাক দিলেন। তাই এই কোভিড ওয়ার্ডে অবশেষের চিকিৎসা আমার।
এঘর আমার আকাশঘর। সক্কাল বেলায় দেয়াল জোড়া বাতায়নের ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ডগুলি খুলে দেয়, রোদ্দুর পাগলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বিছানায়। এত উঁচু থেকে দেখি নীচে দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তর। মাঝে মাঝে বিশাল জলাশয়, বিলের মত। এটা পূর্ব কোলকাতা প্রকৃতি আর মানুষের জড়াজড়ি করে থাকা প্রতিবেশ। আমি যেন উড়ন্ত এক সোনালী চিল, উড়ে উড়ে দেখি আর বাতাসে ভাসি।
তিন দিন পরেই “স্বর্গ হইতে বিদায়”। আমি নাকি মুক্ত। এবং বিপন্মুক্তও। আমার চলমান শয্যা চললো আরেক ওয়ার্ডে, জেনারেল ওয়ার্ড। ধাপে ধাপে ওরা আমাকে বাড়ির পথে এগিয়ে দিচ্ছে।
ধর্মযুদ্ধে, ক্রুসেডে জেহাদে, বিশ্বযুদ্ধে, সকল যুদ্ধই মারণ যজ্ঞ, আর এসব প্রতিনিয়ত যে যুদ্ধ হয়ে চলেছে তা হল ক্ষমতা, শাসনের অধিকার আর রাজ্যবিস্তারের যুদ্ধ। ওগুলিতে সব জয় আসে মানুষের মৃত্যুর মূল্যে। আর এখানে যে যুদ্ধ, তার বিজয় আসে মৃত্যুকে পরাস্ত করে জীবনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া, জীবনের সীমানা বিস্তার করা। মুক্তি, আনন্দ আর মানুষের জয়ের কাহিনী রচিত হয় এখানেই। এই মরণজয়ী যুদ্ধে।
এখানে তিন দিন পর মোট চৌদ্দ দিনের যুদ্ধবাসের দিন যখন আমার ছুটি, যোদ্ধারা বিজয়ের হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে তাদের “বাবা” আর আরো অনেক বয়ঃকনিষ্ঠদের “দাদু” কে ঘিরে শুধু আশীর্বাদ আর ভালবাসা দাবী করল। দিলাম আমার যা আছে সঞ্চয়, সব উজাড় করে। এবার আত্মজনের ঘেরাটোপে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা আর স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হবার পালা।
ফেরার সময় গাড়িতে পুত্র কন্যা পুত্রবধু, আর পুত্রবৎ প্রতিবেশী নানা কথা বলেই চলেছে৷ আমার কানে শুধু দিগ্বলয়ের ভেসে আসা এক ধ্বনী অনুরণিত হচ্ছে, —
“And this same pallid moon tonight,
Which rides so quietly, clear and high,
The mirror of our pale and troubled gaze,
Raised to a cool Canadian sky.
Above the shattered mountain tops,
Last night, rose low and wild and red,
Reflecting back from her illumined shield,
The blood bespattered faces of the dead.
To that pale disc, we raise our clenched fists,
And to those nameless dead our vows renew,
” Comrades, who fought for Freedom and the future world,
Who died for us, we will remember you. “
— Norman Bethune.
(একটি মাত্র কবিতাই লিখেছিলেন , কানাডার পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিল।)