বাংলা সাহিত্যে এপর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক,লেখক এবং সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে আহমদ ছফা সবচেয়ে সাহসী, বুদ্ধিমান, কুশলী, বহুমুখী, সাধারণ এবং তেজময়।
আজ এই মনীষীর ৭৮তম জন্মদিন। সবথেকে বড় কথা আহমদ ছফা ছিলেন একজন বিখ্যাত গুণী চিন্তাবিদ। তিনি ৩০ জুন,১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার চন্দলাইশ উপজেলায় জন্ম গ্রহন করেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন লেখক ও কবি। তাছাড়া তিনি ছিলেন গণবুদ্ধিজীবী।
তিনি কাউকে কোনো কথা বলতে ভয় পেতেন না। তিনি যেইখানে অন্যায় দেখতেন সেই অন্যায় এর প্রতিবাদ করতেন। তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ইত্যাদি লিখতেন।
সেইসব লেখার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই বা রচিত গ্রন্থ হলো বাজ্ঞালী মুসলমানের মন, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, ইত্যাদি উপন্যাস ছাড়াও তিনি আরও অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি তাঁর চিন্তা ভাবনার ও তাঁর জগৎ বিখ্যাত লেখার কারনে ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। অবশেষে তিনি ২৮ জুলাই ২০০১ সালে ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।
নান্দিক এর আজেকের আয়োজনে থাকছে বিখ্যাত কবি ও গণবুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার একটি ঘটনা এবং জীবনবোধ নিয়ে বিখ্যাত উক্তি ও বাণী।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, আহমদ ছফাকে ফোন করে দাওয়াত করেছিলেন। ছফা, বেগম জিয়াকে বলেছিলেন; যেতে পারি এক শর্তে। আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে। শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে রান্না করে খাইয়েছিলেন! খালেদা জিয়ার রান্না করার সময়ও হয়নি, ছফাও যেতে পারেননি।
খালেদা জিয়ার সাথে আহমদ ছফার আরেকবার ফোনালাপ হয়েছিল। উপলক্ষ্য ছিল এনজিও ব্যুরো থেকে ‘বাংলা-জার্মান সম্পীতি’ র রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে। ছফা-ই বেগম জিয়াকে ফোন করেছিলেন। ফোনটি ধরেছিলেন তাঁর পিএস। ছফা বিনয়ের সঙ্গে পিএসকে বলেছিলেন, ম্যাডামকে কি একটু দেয়া যাবে? আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
পিএস সাহেব জানতে চাইলেন, আপনি কে?
ছফার জবাব, আমি আহমদ ছফা।
পিএস সাহেব ফের জানতে চাইলেন, কোন আহমদ ছফা?
পিএস-এর কথায় ছফা ভয়ানক রকম খেপে গিয়েছিলেন। তিনি রাগলে সচরাচর যে গালটি তাঁর মুখ দিয়ে বের হত সেটি বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি কোনো রকম ভূমিকা না করে বললেন, বাংলাদেশে আহমদ ছফা দু’জন আছে নাকি?
ছফা কথা না বাড়িয়ে রিসিভারটি ধপাস করে রেখে দিয়েছিলেন।
পিএস সাহেব, ছফার এ অশোভন আচরণের কথা বেগম জিয়াকে জানিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি। কিছুক্ষণ পরে বেগম জিয়া ফোন করেছিলেন। ছফার কথার ঝাল তখনও থেকে গিয়েছিল। ফোন পেয়ে তিনি বেগম জিয়াকে বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ম্যাডাম, কী সব অশিক্ষিত পিএস-টিএস রাখেন আহমদ ছফার নাম জানে না।
ছফার কথায় বেগম জিয়া হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আমি নিজে অশিক্ষিত; শিক্ষিত মানুষ পাব কোথায়। আপনারা কেউ তো এগিয়ে আসছেন না।
তখন, বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় কলকাতার বই আসত। আহমদ ছফা এর বিরোধীতায় নামেন। তার বিরোধীতার ফলে কলকাতার বই আসা বন্ধ হয়। ছফা কাজটা করেছিলেন দেশের লেখকদের কল্যানের জন্য। কিন্তু, এদেশেরই লেখক শওকত ওসমান তাকে বাজে লোক বলে মন্তব্য করেন। ছফা তাকে নিয়ে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে দোকানে নিয়ে যান; গিয়ে জিজ্ঞেস করেন শওকত ওসমানের কোন বই আছে কিনা। কেউ লেখক কেই চিনতে পারল না। তখন কলকাতার একজন সাধারণ মানের লেখকের নাম বলতেই অনেকগুলো বই বের করে দিল। আহমদ ছফা তখন শওকত ওসমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেশটা আমরা বাল ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি?’
শেখ মুজিবর রহমান একবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রদূত হওয়ার জন্য। কিন্ত তিনি যখন বললেন, শর্ত আছে। তখন ছফা বলেছিলেন, শর্ত ছফার জন্য নয়, আপনি অন্য কাউকে দেখুন। এতে শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত রুষ্ঠ হন।
হুমায়ূন আহমেদসহ কয়েকজন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কেউ বিয়ে করবেন না। সবাই বিয়ে করেছিলো এক আহমদ ছফা ছাড়া। তিনি চিরকুমারই ছিলেন।
জীবনবোধ নিয়ে উক্তি
বিখ্যাত চিন্তাবিদ আহমদ ছফা জীবনবোধ নিয়ে অনেক উক্তি রেখে গিয়েছেন যার মধ্যে বাছাইকৃত কিছু উক্তি এখানে আমরা এনেছি। যা আমাদের জীবন বদলাতে হয়তবা অনেক সাহায্যে করতে পারে। জীবনবোধ নিয়ে আহমদ ছফার উক্তি গুলো নিচে উপস্থাপন করা হলো।
“জীবন সম্ভবত এ রকমই! আঘাত যত মারাত্মক হোক, দু:খ যত মর্মান্তিক হোক,একসময় জীবন সবকিছু মেনে নেয়। দুনিয়াতে সবচাইতে আশ্চর্য মানুষের জীবন।”
-অলাতচক্র(পৃ:৭০)
“সমস্ত সাফল্য এবং প্রতিষ্ঠার পেছনে সব সময় এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আত্নগোপন করে থাকে!”
– মরণবিলাস (পৃষ্ঠা ৪৮)
“আমার নিজের কাজের মূল্য আছে, তার স্বীকৃতি অন্যেরা দিতে কুণ্ঠিত হয়,আমি বসে থাকবো কেনো? কেউ না দেখুক, আমি তো নিজে আমাকে দেখছি!”
-অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী(পৃষ্ঠা ১১৯)
“পৃথিবী থেকে সাপ এবং শকুনের বিশেষ প্রজাতি বিলুপ্ত হলে কোনো ক্ষতি -বৃদ্ধি হবেনা, একেক টাইপের মানুষের মধ্যে এই সাপ -শকুনেরা নতুন জীবনলাভ করে বেঁচে থাকবে!”
-অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী(পৃষ্ঠা ৮৯)
“আমার সম্বন্ধে সবচাইতে ট্রাজেডি হলো, আমি নিজের মধ্যে ডুবতে পারিনি।”
“মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবে কারণ সে দুর্বল, অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী।”
“লোকে যাই বলুক, যাই অনুভব করুক, নিজের কাছে আমি অনন্য।”
“আপাতদৃষ্টিতে পাগলেরাই অনেক বেশি তীক্ষ্ণদৃষ্টির অধিকারী।”
“আমার কাছে ঈশ্বর-চিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি কোন বিবাদের হেতু দেখতে পাইনে। আমার অভীষ্ট বিষয় মানুষ, শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস। ”
“মানুষ তো নিজের অজান্তে ও অনেক জঘন্য অপরাধ করে বসে। সমস্ত ধর্মতো পাপ বোধের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু মানুষ হিসাবে তোমাকে জন্ম নিতে হয়েছে তাই, তুমি পাপী !”
-অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী (পৃঃ৪০)