নাট্যকর্মীদের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনটি তুলে দেয় এবং সেই সাথে আমাদের প্রধান দাবী ছিল আধুনিক মঞ্চ নির্মাণ করে নাটকের অবকাঠামো নির্মাণ করার। বিষয়টি সামনে চলে আসে যার ফলে ঢাকায় দুটি মঞ্চ নির্মিত হয়। মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজ থেকে নাটক শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নাট্যকলা বিভাগ খোলা হয় এখনও সে প্রক্রিয়া চলছে।
সিঙ্গাপুরে তিনদশক ধরে প্রধানমন্ত্রী থাকা লী কুয়ান সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে দ্রম্নততম উন্নতি সাধন করেছিলেন। মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেশটিকে তৃতীয় বিশ্বের জায়গা থেকে প্রথম বিশ্বের স্থানে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। দুই দশক পরে তাঁর হঠাৎ করে বােধ হলাে যে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন অবকাঠামমো নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে বটে, কিন্তু সিঙ্গাপুর হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি সাংস্কৃতিক মরম্নভূমি। চীনা, মালয়া, ভারতীয়, ইন্দোনেশিয়ানসহ বহু জাতির বসবাস এই ছােট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে। তিনি ভাবলেন যদি সংস্কৃতিক্ষেত্রে তেমন কিছু না হয়, তবে মূল্যবােধ সৃষ্টি হবে না, রাষ্ট্রটি হয়ে দাঁড়াবে এক অমানবিক এবং দানবের রাষ্ট্র। তাই তিনি শুরম্ন করলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সব জাতিসত্তাদের ডেকে তিনি বললেন, আমি তােমাদের জীবন যাপনের জন্যে একটি আদর্শ ব্যবস্থা করেছি বটে, কিন্তু এখন সাংস্কৃতিক মরম্নভূমিকে মরম্নদ্যান সৃষ্টি করতে হবে। তার জন্যে যার যা প্রয়ােজন তা করতে আমি প্রস্তুত। থিয়েটার, নৃত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সাহিত্য এসব ক্ষেত্রে আধুনিক এবং উচ্চাঙ্গের চর্চা দরকার। সেই শুরম্ন হয়ে গেল অবকাঠামাে নির্মাণ, গবেষণা ও সৃজনশীলতার চর্চা। রাষ্ট্রীয় অর্থের একটা উলেস্নখযােগ্য অংশ তিনি ব্যয় করলেন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। আমি যখন সিঙ্গাপুরে একটি নাট্যদলের অফিসে যাই সেখানে দেখতে পাই মহড়াকক্ষ ওয়ার্ডোব, লাইব্রেরি, সেট রাখার গুদাম এবং সেই সঙ্গে একটি স্টুডিও থিয়েটার। আমি জানতে পারলাম এই থিয়েটার দলের সমগ্র ব্যয়ভার গ্রহণ করে থাকেন সিঙ্গাপুর সরকার। কলাকুশলীরা সবাই বেতন পান এবং সার্বক্ষণিক নাটকের কাজ করে থাকেন। এই সব থিয়েটারের দলে কর্তৃত্ব করার জন্য নয় দেখভালের জন্যে সরকারের একটি বিভাগ রয়েছে। প্রথম থেকেই এইসব কর্মকান্ডের জন্য সরকারী অনুদান একটি অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়, করম্নণা হিসেবে নয়। একই সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে যেখানে নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, নৃত্যকলা এসবে সেদেশের সরকার বিপুল অর্থ বিনিয়ােগ করে থাকে। কোন বড় স্থাপনা নির্মিত হলে তার বাজেটের সতের পার্সেট ব্যয় করতে হয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। জাপানে বহু বছর থেকে একেবারে মেইজি রিফরমেশনের থেকে শিল্প-সাহিত্যকে শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবং সেজন্যই কাবুকি, নােও, বুকুর মতাে নাট্য আঙ্গিককে বিপুল পরিমাণ অনুদান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলােতে প্রথম থেকেই শিল্প-সাহিত্যকে পৃষ্ঠপােষকতা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য মনে করা হয়েছে। স্তালিনের সময় থেকে নাটক-চলচ্চিত্র, ব্যালে, অপেরা, সঙ্গীতকে রাষ্ট্রের একটি গুরম্নত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখনও রম্নশ ফেডারেশনে সাড়ে চার হাজার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব থিয়েটার রয়েছে, যারা সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত হয়। চলচ্চিত্রের মতাে একটি ব্যয়বহুল শিল্পকে রাষ্ট্রের অর্থে পরিচালনা করে বিশ্বের অন্যতম ধ্রম্নপদী চলচ্চিত্র নির্মাতা দেশ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে । ইউরােপ আমেরিকাতেও সৃজনশীল কাজ প্রায় সম্পূর্ণভাবে সরকারি অনুদান নির্ভর। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানি চলচ্চিত্র এবং নাটক সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। সেখানেও সম্পূর্র্ণভব রাষ্ট্র উপস্থিত। বর্তমানে চীন দেশে শিল্পসাহিত্যের জন্য নানাধরনের ব্যয়বহুল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং প্রতিদিন হচ্ছে। সবাই অনুভব করেছে উচ্চাঙ্গ শিল্পকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে, যা রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে আর যেসব শিল্প বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়ে থাকে সেসব নিজস্ব অর্থায়নেই চলতে পারে।
এদিক দিয়ে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ আমাদের উপমহাদেশ। যদিও ভারতে গত কয়েকদশক ধরে সীমিত হারে বিভিন্ন। ক্ষেত্রে অনুদানের ব্যবস্থা হয়েছে তবুও রাষ্ট্রের বাজেটের তুলনায় তা অতি গুরম্নত্বহীন এবং অনিয়মিত। রাষ্ট্রের স্থায়ী কোন অনুদান ব্যবস্থা থাকে না বরং শাসকগােষ্ঠীর আনুকূল্য প্রত্যাশে পাকি¯ত্মানে এসবের বালাইই নেই। এবার বাংলাদেশের বিষয়টি ভিন্ন। একেবারেই প্রথম দিকে রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই পৃষ্ঠপােষকতাহীণ। এক দিকে নাটককে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল ফসল আর অন্যদিকে এই শিল্পের পৃষ্ঠপােষকতা গুরম্নতরভাবে কম। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বার্ষিক বাজেটের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এই স্বল্প বাজেটের মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৭০টি শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে । কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার পর বিভিন্ন কাজের জন্য সামান্যই অর্থ উদ্বৃত্ত হয় । কিন্তু বাংলাদেশে নাট্যচর্চা দেখলে মনে হয় এর পেছনে প্রচুর পৃষ্ঠপােষকতা আছে। না হলে কি করে সম্ভব নিয়মিত নাট্যচর্চা, উৎসব, সেমিনার ইত্যাদি তাে লেগেই আছে। কারণ সবটাই শিল্পীদের নিজস্ব অর্থায়নে। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আমাদের শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করা যেতে পারে। একবার সংস্কৃতি সচিবের সাথে একটি বৈঠকের আয়ােজন হয়েছিলসে প্রায় উনচলিস্নশ বছর আগে। আমরা নাটকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতার কথা তুলতেই সচিব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, সংস্কৃতির প্রায়ােরিটি কোথায় আপনারা বােঝেন? যেখানে আমাদের প্রধান প্রায়ােরিটি হচ্ছে ফুড, সেখানে কালচার কোথায় দাঁড়ায়? আমিও কিঞ্চিত উত্তেজিত হয়ে বললাম, মানুষ কি শুধু ভাত খেয়ে বাঁচে? শুধু খেয়ে বাঁচে প্রাণী জগৎ ! আপনি কি বাংলাদেশের মানুষকে প্রাণী বলে মনে করেন? তখন দেশে ফুড ফর ওয়ার্কস চলছিল। প্রথম থেকেই আমরা এর বিরােধীতা করেছিলাম। কাজের বিনিময়ে খাদ্য মানুষকে প্রাণীজগতের কাতারে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আরো একটি শিল্পের ব্যাপক চর্চা হয়েছে তা হলাে আবৃত্তি শিল্প। বড় বড় শহর থেকে কোথাও একেবারে তৃণমূল পর্যšত্ম তার বি¯ত্মার। এই শিল্পের চর্চা পাকি¯ত্মান আমলে খুব ছোট আকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পরে তা বেশ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে এই শিল্পের বি¯ত্মার উলেস্নখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে। একেবারেই পৃষ্ঠপোষকতাহীন এই শিল্প ও শিল্পীদের নিজস্ব অর্থায়নেই চলে আসছে। নৃত্য ও সঙ্গীত একেবারেই সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে।
নাটক গণতান্ত্রিক। শিল্প-সাহিত্যের চর্চাও তাই। যারা নাটক করেন তারা প্রতিনিয়তই গণতন্ত্রের চর্চা করেন এবং দর্শককে. গণতান্ত্রিক হবার আহবান করে থাকেন। তাই নাটকের মঞ্চে কোন মিথ্যে ভাষণ চলে না, কারণ এই নাটকের গণতান্ত্রিক চর্চায় দর্শকের মনে নানা প্রশ্ন জাগে এবং সে প্রশ্নের সুরাহা করতে চায়। তাই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বাংলাদেশের নাটক মূলতঃ রাজনৈতিক নাটক হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরাচার বিরােধী আন্দোলনে মঞ্চে, পথনাটকের উন্মুক্ত মঞ্চে। রাজপথে নাটক । আবৃত্তি, সঙ্গীত, নৃত্য, চারম্নকলা ও সাংবাদিকদের এক বড় অংশের লােকরাই এক অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। নাট্যকর্মীদের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনটি তুলে দেয় এবং সেই সাথে আমাদের প্রধান দাবী ছিল আধুনিক মঞ্চ নির্মাণ করে নাটকের অবকাঠামাে নির্মাণ করার। বিষয়টি সামনে চলে আসে যার ফলে ঢাকায় দুটি মঞ্চ নির্মিত হয়। মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজ থেকে নাটক শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে চলে আসে। বিশ্ববিদালয়গুলিতে নাট্যকলা বিভাগ খােলা হয় এখনও সে প্রক্রিয়া চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর সাতক, স্নাতােকত্তর, এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে কিন্তু সৌখিন নাট্যচর্চায় ঐ ছাত্রদের পেশাগত কোন সুযােগ সৃষ্টি হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে জীবিকার প্রয়ােজনে তারা অন্যত্র কোন পেশা গ্রহণ করেছেন ।
স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যšত্ম নাট্যশিক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় সরাসরি অনার্স ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি হতে হচ্ছে। শিকড় ছাড়া গাছের মতাে লেখাপড়া করছে, যার ফলে পড়ালেখাটাও খুব আনন্দদায়ক হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা কিরী প্রত্যাশী। চাকরীর ব্যবস্থা না থাকলে বিষয়টা সার্টিফিকেট কেন্দ্রিক হয়ে যায়। স্কুল ও কলেজে যদি একটি বিষয় হিসেবে নাট্যকলা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতাে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় পাশ করা কারাে চাকরীর অভাব হতাে না। বার বার এসব কথা বলার পরেও কোন বন্দোবস্ত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি এক শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি। দেশ বিভাগের পর স্বাধীনতার ফাকিটা এদেশের সংস্কৃতি কর্মীরাই বুঝতে পারে । সেকারণেই ভাষার উপর আঘাত আসার সাথে সাথে শিল্পী-সাহিত্যিক এবং ছাত্রদের আন্দোলন একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। পরবর্তীকালে শিক্ষা আন্দোলন ও ষাট দশক জুড়ে বাঙালির যে সংগ্রামের ফলাফলে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় তার পেছনেও রয়েছে সংস্কৃতি কর্মীদের প্রেরণা। এ সময়ে আমাদের কাব্যে, গল্প, উপন্যাসে, চিত্রকলা ও নাটকে পূর্ব বাংলার মানুষের বঞ্চনা এবং জনজীবনে তার প্রতিফলন বিধৃত হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরে পরেই নাটক একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে আত¥প্রকাশ করে। এসময় কোন পৃষ্ঠপােষকতার প্রশ্নই ছিল না। একেবারেই নাট্যকর্মীদের নিজ উদ্যেগেই সংস্কৃতি মকা- পরিচালিত হয়েছে। গ্রম্নপ থিয়েটার ফেডারেশন বা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দেশব্যাপি কর্মকা-ও নিজস্ব অর্থ দিয়ে করা হয়েছে। স্বৈরাচার বিরােধী দীর্ঘ এক দশকের আন্দোলনেও কোন পৃষ্ঠপােষকতার কথা ভাবা হয়নি। পরবর্তী ত্রিশ বছরেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। অথচ তৈরী করা ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা পাওয়া যেত তাহলে এই সব ক্ষেত্রে গুণগত উৎকর্ষতা, পেশাভিত্তিক জীবিকা অর্জন করে আšত্মর্জাতিক মানের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হতাে। গত দশ বছর যাবত আমরা সাংস্কৃতিক দলগুলােকে নিয়মিত সম্মানজনক মাসােহারা দেবার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে আসছি। সেই সাথে উৎসব, অনুষ্ঠান, প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ, বিদেশ ভ্রমণ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্যও বলে এসেছি। শুধুমাত্র বছরে একবার একটা সামান্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় যা প্রয়ােজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অসংখ্য দল নামে-বেনামে এই অর্থ পেয়ে থাকে যা কোন কাজে লাগে না। এইভাবে অনুদান না দিয়ে যদি নতুন নাটকের প্রযােজনা বা কোন কর্মশালা অথবা কোন সঙ্গীত, আবৃত্তি, চিত্রকলার কাজে সুনির্দিষ্ট অনুদান দেয়া হতাে তাহলে তা কাজে লাগতাে। এতাে গেল আর্থিক পৃষ্ঠপােষকতা। এর বাইরে কিছু অবকাঠামােগত পৃষ্ঠপােষকতারও জরম্নরী প্রয়ােজন। নাটকের সেট রাখার জন্য একটি গােডাউন প্রতিটি মিলনায়তনের জন্যই অত্যšত্ম প্রয়ােজন। নাট্যদলগুলির সেট বা প্রপস রাখার জায়গার খুবই সংকট। এগুলি রক্ষণাবেক্ষণ খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। মহড়া কক্ষের স্বল্পতাও বড় সমস্যা। নাটক, আবৃত্তি, সঙ্গীত সব কিছুর চর্চার জন্যই মহড়া কক্ষ প্রয়ােজন। যাত্রার মতাে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ লােকনাট্য পৃষ্ঠপােষকতার অভাবে ধ্বংসই হয়ে গেলাে। সরকার ছাড়াও এদেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যেমন ব্যাংক, বীমা, লজিং কোম্পানী এসবের সিএসআর (Corporate Social Responsibility) আছে। সেই সিএসআর এর একটা অংশ এই খাতে ব্যয় হতে পারে। সিএসআর নীতিমালায় সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে অšত্মর্ভূক্ত করলেও এ সমস্যায় কিছুটা সমাধান হতে পারতাে। বর্তমানে গ্রাম-বাংলায় ওয় মাহফিল, তফসির ইত্যাদি নানাভাবে পৃষ্ঠপােষকতা পেয়ে আসছে। একদা শীতকালে গ্রাম-বাংলায় যাত্রা ছাড়াও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানুষের মনকে উষ্ণ ও সৃজনশীল করে রাখতাে, সেখানে ঐসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র প্রগতির চাকাকে উল্টোপথে পরিচালিত করবে যা পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদকে উৎসাহিত করবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আরাে একটি শিল্পের ব্যাপক চর্চা হয়েছে তা হলাে আবৃত্তি শিল্প। বড় বড় শহর থেকে কোথাও একেবারে তৃণমূল পর্যšত্ম তার বি¯ত্মার। এই শিল্পের চর্চা পাকি¯ত্মান আমলে খুব ছােট আকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পরে তা বেশ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচার বিরােধী সংগ্রামে এই শিল্পের বি¯ত্মার উলেস্নখযােগ্যভাবে বাড়তে থাকে। একেবারেই পৃষ্ঠপােষকতাহীন এই শিল্প ও শিল্পীদের নিজস্ব অর্থায়নেই চলে আসছে। নৃত্য ও সঙ্গীত একেবারেই সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে। ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়ার ফলে কেউ কেউ নতুন করে নৃত্যকলায় সুবাতাস নিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে তা একেবারেই অনিয়মিত। এক্ষেত্রে নৃত্য শিল্পীদের বিদেশ যাত্রার ব্যবস্থা থাকলেও দেশে চর্চার কোন নতুন দিগšত্ম শুরম্ন হয়নি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত এবং পলস্নীগীতি একেবারেই উপেক্ষিত। এই উপেক্ষার ফলে আগামী এক দশকের মধ্যে উচ্চাঙ্গ, কণ্ঠ সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত ও পলস্নীগীতি বালুচরে শুকিয়ে যাওয়ার মতাে ঘটনা ঘটতে পারে। এক্ষেত্রেও জরম্নরী পৃষ্ঠপােষকতা প্রয়ােজন ।
বাংলাদেশ গানের দেশ, কবিতার দেশ, নাটক যাত্রাপালাসহ নানা শিল্প আঙ্গিকের এক অপরূপ লীলাভূমি, আবার ঐক্যবদ্ধ কঠোর সংগ্রামেরও দেশ। এই দেশের সংস্কৃতিকে লালন করা রাষ্ট্রের জরম্নরী কর্তব্য। সেই কর্তব্যে অবহেলা শিল্প-সাহিত্যে এক বিপর্যয় ডেকে আনবে । আমরা কখনাে তা চাইবাে না।