“আজ ১৬ এপ্রিল, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৬ তম প্রয়াণ দিবস, এই জনহিতৈষী, ঋষিপ্রতিম মানুষটিকে স্মরণ করি”
রেজা আরিফ
‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার কর আমারে’
–সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাচালি’ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও মূল উপন্যাস বা চিত্রনাট্যে গানের প্রসঙ্গ ছিল না। কিন্তু সত্যজিৎ চাইলেন ‘ইন্দির ঠাকুরণ’ চরিত্রে একটি গান যোজনা করতে। সে মোতাবেক ‘ইন্দির ঠাকুরণ’ চরিত্রে অভিনয় করা চুনিবালা দেবীকে দিয়ে রেকর্ড করলেন, ‘মন আমার হরি হরি বল…হরি হরি বল…ভবসিন্ধু পার চল’। কিন্তু শুটিংয়ে এসে চুনিবালা দেবী জানালেন তাঁর আরও একটি গান মনে পড়ছে। বৃদ্ধা চুনিবালা কাঁপা কাঁপা গলায় গাইলেন, ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যে হলো…।’ মুগ্ধ সত্যজিৎ আগের রেকর্ড করা গানটি বাতিল করলেন। নতুন গানটি ‘ইন্দির ঠাকুরণ’ চরিত্রের সাথে, দৃশ্যের সাথে, সিনেমার সামগ্রিকতার সাথে, কী সাবলীলভাবে মিলেমিশে গেল! পরবর্তীতে ‘পথের পাচালি’র সৌরভ বহন করে গানটি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। গানটির রচয়িতা ও সুরকার কাঙাল হরিনাথ মজুমদার।
কাঙাল হরিনাথ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীন নদীয়া জেলা) কুমারখালিতে। তৎসময়ে কুমারখালি একটি সমৃদ্ধ জনপদ। মীর মশাররফ হোসেন, ফকির লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাঙাল হরিনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগন হরকরাসহ প্রমুখ গুনীজনেরা প্রায় একই সময়ে এই ছোট্ট জনপদটিতে সমাবেত হয়েছিলেন। ১৮৮০ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবার পর, ‘কাঙাল ফকির চাঁদের দল’ নামে কাঙাল হরিনাথ একটি বাউল গানের দল প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি অসংখ্য গানের জন্ম দেন। কাঙাল হরিনাথের গানগুলো আধ্যাত্মিকায় পূর্ণ। সাধক লালন সাঁই ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু। তাই তাঁর গানে সাঁইজির প্রভাব স্পষ্ট। জীবনের শেষাবধি সদলবলে বিভিন্ন স্থানে স্বরচিত গানগুলো গেয়ে বেড়াতেন।
জনহিতৈষী ও সমাজ সংস্কারক
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার বঙ্গদেশের স্থানীয় সাংবাদিকতার পথিকৃত। অর্থাভাবে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। সে বেদনা থেকে বিত্তবান বন্ধুদের সহায়তায় ১৮৫৫ সালে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন, ‘ভার্নাকুলার স্কুল’। বিনা বেতনে সে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁরই সহায়তায় ১৮৫৬ সালে নিজ গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববঙ্গের কৃষকের উপর নীলকর, ইংরেজ, জমিদার, মহাজন, কুঠিয়ালের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। শুরু করেন সাংবাদিকতা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সংবাদ প্রভাকরে’ নিয়মিত লিখতে থাকেন। পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে কুমারখালি থেকে প্রকাশ করেন মাসিক পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’। তখন অত্র অঞ্চলে কোনো ছাপাখানা ছিল না। তাই পত্রিকা ছাপা হয়ে আসতো কোলকাতা থেকে। পরবর্তীতে পত্রিকাটি পাক্ষিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। নিয়মিত সংবাদ ছাড়াও পত্রিকাটিতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়–ভিত্তিক প্রবন্ধ ছাপা হতো।
১৮৭৩ সালে কুমারখালির নিজ বসতভিটায় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ র জন্য ছাপাখানা স্থাপন করেন। নাম দেন এম. এন. প্রেস। শুধু পত্রিকা নয়, এই প্রেস থেকে ছাপা হয়েছে লালন সাঁইজির অসংখ্য গান, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র মতো বহু সুবর্ণকৃতি। ১৮৮০ সালে অর্থাভাবে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে যায়।
কুমারখালির কুণ্ডুপাড়ায় ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক স্থাপত্যকলা অনুসরণে নির্মিত জাদুঘরটি দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু সেখানে উনবিংশ শতকের কুমারখালি অনুপস্থিত। সেখানে কাঙাল হরিনাথের সংগ্রামমুখর জীবন, আধ্যাত্মিক চেতনা, মানব-হিতৈষী মনটার খোঁজ মেলে না। জাদুঘরের ঝাঁ চকচকে কাঠামোর ভারে সেসব চাপা পড়ে গিয়েছে বলে অনুভূত হয়। কিছু দূরেই কাঙাল হরিনাথের বাস্তুভিটা। নাম ‘কাঙাল কুটির।’ অবহেলায় অযত্নে দেয়াল থেকে খসে পড়ছে ইট, বালু। এখানেই স্থাপিত হয়েছিল এম. এন. প্রেস। এই ভগ্নস্তূপের পাশেই বাস করেন কাঙাল হরিনাথের বংশধরেরা। প্রেসটাকে তাঁরা এখনও সযত্নে আগলে রেখেছেন। জাদুঘরে অর্পণ করেননি। প্রেসটা এখনও সচল। কথা হলো দেবাশীষ ও তাঁর মায়ের সাথে। তাঁরা কাঙালের পঞ্চম প্রজন্ম। কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে দেবাশীষের চাকরি হয়েছে। তাঁরা চেয়েছিলেন কাঙালের বাস্তুভিটায় জাদুঘরটি স্থাপিত হোক। তাঁদের অনুরোধ কেউ রাখেননি। রাষ্ট্রের কাছে তাঁদের সামান্য কিছু চাওয়া আছে। একাধিকবার আবেদনও করেছেন।
দেবাশীষদের আবেদন মঞ্জুর হবে কী না, জানিনা। এই বিস্মৃতপ্রবণ জাতি, কাঙাল হরিনাথকে কতটুকু স্মরণে রাখবে, জানিনা। এই প্রজন্ম কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম জানে কী না, তাও জানিনা। তবে বাঙালির মানস গঠনে, আত্মপরিচয়ের নির্মাণে কাঙাল হরিনাথের আবেদন বোধকরি শেষ হবার নয়।