![Dhruba Esh-Birthday](https://nandik.org/asset/2025/01/Dhruba-Esh-Birthday-scaled.jpg)
অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ। ধ্রুব এষ বাংলাদেশের বইয়ের জগতের অলিখিত রাজাধিরাজ।
এদেশের যে কোন বইয়ের দোকানে যদি চোখ রাখি, দেখা যাবে সেখানে উপর্যুপরি উপস্থিতি রয়েছে ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ করা বই। এই চিত্র শুধু বইয়ের দোকানে নয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের যে কোনো বইয়ের স্টলে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ও সংগ্রহালাতেও ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদ করা বই রয়েছে নিশ্চিতভাবেই।
ধ্রুব এষ-এর প্রচ্ছদ করা বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ হাজার ছাড়িয়েছে। একজন শিল্পী কতোটা সাধক হল এতো সংখ্যক কাজ করতে পারে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হল নিমগ্নতা। এই নিমগ্নতা দিয়ে তিনি কেবল কৈশোরে দেখা স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে সত্যে পরিণত করেননি, নিজেকে নির্মাণ করেছেন শিল্পের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা হিসেবে। তিনি প্রচ্ছদশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, হয়েছেন। এবং ধ্যানমগ্নতায় নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন এই শিল্পের একজন ভরকেন্দ্র।
তিনি দেখিয়েছেন কাজকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, প্রেম ও মনোযোগে সাধনার স্তরে নিয়ে যেতে হয়। সাধনা থাকলে যে সব হয়, তার বড়ো উদাহরণ বাংলাদেশের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ শিল্পে ধ্রুব ছাড়া আর কে হতে পারেন? একথা মোটেই অতিশয়োক্তি নয় যে, বাংলা ভাষার প্রচ্ছদ শিল্পের অবিসংবাদিত এক শিল্পীর নাম ধ্রুব এষ।
নিভৃতচারী এই শিল্পী একা থাকতে পছন্দ করেন। সহসা পাওয়া যায় না তাঁকে । উনাকে মিসির আলী বলতেও কসুর করেন না কেউ কেউ। এ পক্ষের তরফে দাবি হল, হুমায়ূন আহমদ মিসির আলী চরিত্র তৈরি করেছেন ধ্রুবকে ঘিরেই। এসব সত্যি, না মিথ্যা সেটা বড়ো কথা নয়, ধর্তব্যের মধ্যেও পড়ে না। বড় কথা হল এরকমভাবে আলোচনার ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা। মানুষের মনোজগতে-আলাপে-আড্ডায়-প্রতিদিনের রোজনামচায় এভাবে ভাবনার খোরাক যোগানোর সক্ষমতা অর্জন করা।
কেউ বলেন, হিমু চরিত্র নাকি ধ্রুবকে দেখেই চিন্তায় আসে লেখক হুমায়ূন আহমেদের। আবার শুনি হুমায়ূন আহমেদ ধ্রুব এষকে ‘শুভ্র’ নামে ডাকতেন।
হুমায়ুন আহমদ একবার ধ্রুব সম্পর্কিত এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন অদ্ভুত কিছু প্রসঙ্গ। ধ্রুব এষ নাকি কথা বলতেও পছন্দ করেন না, সচরাচর কথাও বলেননি। যে প্রশ্নের উত্তর না বা হ্যাঁ দিয়ে শেষ করা যায়, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি কখনোই বাক্য ব্যয় করে বলেন না। এমনকি না বা হ্যাঁ বলাতেও নাকি প্রচণ্ড অনীহা-অনাগ্রহ। এ কারণে বেশীর ভাগ সময় ঘাড় সামনে-পেছনে, ডানে-বামে নাড়িয়েই আলাপ শেষ করেন। এসবের সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। তিনি যে ধ্রুব এষ। শিুর মতো, কখনো আবার তিনি ঋষির মতো।
এই শহর-এই দেশে, আমরা যারা বেঁচে আছি ধ্রুব এষ-এর সময়ে আমাদের কতোই না সৌভাগ্য যে আমরা এরকম একজন মানুষকে চোখের সম্মুখে কিংবা কিছুটা আড়ালে আবডালে, আমাদের গল্পে-হার্দিকতায় প্রতিনিয়ত হাজের-নাজেল হতে দেখছি। যে ধ্রুব এষকে আমরা মনে করছি একোংগুয়া পাখির মতো একক, নিংসঙ্গ ও লাজুক। তিনি কিন্তু প্রচ্ছদ শিল্পে একটা স্কুলের যাত্রা শুরু করেছেন। যা-এক বিপ্লবও বটে। এই সময়ের সকল প্রচ্ছদশিল্পী (দু-একজন বাদে) ‘ধ্রুব-সঙ্গ’ পছন্দ করেননা কেবল উনারা প্রত্যেকে মিলে প্রচ্ছদশিল্পের বিদ্যায়তনিক এক যাত্রাকে লালন করেন। যেখানে সকলেই শিক্ষক-সকলেই শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পের অগ্রগমন-উন্নয়ন-উৎকর্ষ নিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চটা দেয়ার ব্রতে এখানে সবাই সহযোগী ও স্বতান্ত্রিক। এই যে সবাইকে নিয়ে চলার কসরত ও কোশেশ তা যেন ধ্রুব-র প্রযত্নে অন্যরকম একমাত্রা পেয়েছে। শুধু কি প্রচ্ছদশিল্পী ও আঁকিয়েরা, ওঁর স্কুলে যেতে কে না ভালবাসে। লেখক-কবি-সাহিত্যিক- সাংবাদিক-ছড়াকার-শিশু সাহিত্যিক সকলেই ধ্রুব-র স্কুলে যেতে উদগ্রিব থাকেন-যানও নিয়মিত কিংবা অনিয়মিতভাবে। এবং সকলের কাছে ধ্রুব প্রিয় এক দাদা, সংক্ষেপে ধ্রুবদা। এই শহরে এরকম দাদার সংখ্যা নেই বললেই চলে-যিনি মহীরুহ হয়ে আশ্রয় দেন, সহমর্মী হন, বন্ধুতায় জড়িয়ে নেন সবাইকে। সাংবাদিক নির্মল সেন, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত-একসময় সকলের দাদা হয়ে উঠেছিলেন। দাদাই যেন উনাদের নাম। পিতা-পুত্র থেকে সকল প্রকার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে উনারা হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনীন এক দাদার প্রতিভূ। ধ্রুব এষও ঠিক তেমন-কিংবা এঁদেরকেও ছাড়িয়ে গেছেন। আমাদের সকলেরই আলাদা আলাদা পরিচয় আছে। আমারা কারও মামা হই, চাচা হই-ইত্যাকার সব পরিচয়। কিন্তু ধ্রুব এষ-এর পরিচয় একটাই তিনি ধ্রুবদা।
ধ্রুব এষ। জন্ম ১৯৬৭। সুনামগঞ্জের উকিলপাড়ায়। বাবা শ্রী ভূপতি এষ। মা শ্রীমতী লীলা এষ। দেশের অপরিহার্য প্রচ্ছদশিল্পী। রঙে, রেখায় কত কিছু যে আঁকেন! গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পের একচ্ছত্র অধিপতি।
এ যাবৎ প্রায় বিশ হাজার প্রচ্ছদ এঁকেছেন। প্রচ্ছদের পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। সব ধরনের লেখাতেই সিদ্ধহস্ত। কী ছোটদের কী বড়দের—সব বয়সি পাঠক তাঁর লেখায় আকৃষ্ট হন সমানভাবে। প্রকাশিত বই ৪০টি।
তাঁর লেখায় দেখা-না-দেখা জীবন আর মানুষের এক বিচিত্র সম্মিলন ঘটে যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় পাওয়াকে, না-পাওয়াকে। জীবনের বহুবর্ণিল বাস্তবতাকে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ধ্রুব এষ।
আমাদের বিশ্বাস, মানুষের ভালাবাসার শক্তি ওপরে কোনকিছু হয় না। ধ্রুবদাকে অগণন মানুষ ভালবাসেন। শিল্পের ভুবনে-নিজের কর্মময়তায় জন্ম দেবেন নতুন কোন মিথের।