পারস্য থেকে বর্তমান ইরাণ – সুরঞ্জন দত্ত চৌধুরী

By Published On: October 2, 2022Views: 291

পারস্য থেকে বর্তমান ইরাণ
সুরঞ্জন দত্ত চৌধুরী

পারস্য সভ্যতার ইতিহাস পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রাচীণ এবং অত্যন্ত উন্নত এক সৃষ্টিশীল মানব সভ্যতা । প্রায় ৮ লক্ষ বছর আগে লোয়ার প্যালিওলিথিক অথবা প্রাথমিক প্রস্তরযুগে মানব সভ্যতার নিদর্শন আবিস্কার করেছেন প্রত্নতাত্বিকগন উত্তর ইরানের কাশাফ্রুদ এলাকায় খনন কাজ চালিয়ে । অনেক প্রমান উপকরণ পেয়েছেন । এসকলের নিদর্শণ সংরক্ষিত রয়েছে পশ্চিম ইরানের জাগ্রোস শহরের মিউজিয়ামে ।

এই দেশের সভ্যতা সংস্কৃতির ইতিহাসও গৌরবময় । জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য দর্শন ভাষা ইত্যাদি সভ্যতার অন্যতম উপাদানে পারস্যের অবদান প্রাচীন ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় । অতীতের বর্ণময় ঐতিহ্যের নিদর্শণ দেখা যায় পার্সিপোলিস, বাআম, বিসোতুন জাদুঘরে । নান্দনিকতায় তাদের সাহিত্য ছিল পরিপূর্ণ , ঠিক যেন শিল্পময় ইরানী গালিচার মত ।

মধ্য ইরান পর পর বহিরাক্রমনের লক্ষ্যস্থল ছিল । তার ফসল, সম্পদ আর ঐশ্বর্য লুণ্ঠণের লোভে বার বার আক্রমণ করেছে অর্ধসভ্য বুভুক্ষু বহিঃশত্রুর দল । সপ্তম শতকে আরব, একাদশ শতকে তুর্কী, ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গল দস্যুরা ছুটে এসেছে , হত্যা লুণ্ঠণ চালিয়েছে । শেষে এলো অটোমান সম্রাটের সৈন্যদল । সেই কাল চলেছে মাৎস্যন্যায়ের যুগ, পেশীশক্তির বলে অন্য দেশ লুঠ করাই ছিল খাদ্যাভাব পীড়িত অঞ্চলের আধা সভ্য মানুষের চরিত্র । আর একই উপায়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে প্রভুত্ব কায়েম করা অন্য অঞ্চলের উপর । তাই উন্নত দেশগুলিকে ভুগতে হয়েছে এই সব আক্রমণকারীর উৎপাতে ।

আরব আক্রমণের আগে পারস্যের প্রায় সকলেই জোরোষ্ট্রিয়ান ধর্মবিশ্বাসে জীবনযাপন করত। প্রায় শতাধিক বৎসর কাল ধরে এই বিশ্বাসের প্রভাব পড়েছিল তাদের দর্শণ , শিল্প সংস্কৃতির উপর । তারপর সুরু হয় ধর্মান্তকরণ । ( অনেক পরে খৃষ্টান যাজকরাও কিছু কিছু ধর্মান্তকরণ করে ) । খৃষ্টিয় নবম ও দশম শতাব্দিতে ‘সামানিদ’ সুন্নী রাজবংশের আমলে ইসলাম প্রচার আর প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা ছিল । ১৫০১ খৃষ্টাব্দে ‘সাফাবিদ’ রাজবংশ ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম “শিয়া ইসলাম “ জাতীয় ধর্ম বলে ঘোষিত হল ( ইসলামের ইতিহাসে একটি লক্ষ্যনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ) । এখন প্রায় ৯০% শিয়া , বাকিরা সুন্নী , খৃষ্টান , বাহাই, ইত্যাদি ।
আঠারো শতকে পারস্য ইওরোপের কয়েকটি দেশের সাথে সংস্পর্শে আসে , রাশিয়া বৃটেন তাদের মধ্যে অন্যতম । শিল্প বাণিজ্যের আদান প্রদান শুরু হয় । পূর্ব ও পশ্চিম ইওরোপ, মধ্য ও দক্ষিন এশিয়া এবং দক্ষিনে আরব্য উপদ্বীপ অঞ্চল সহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে পারসিক শিল্প সাহিত্য, স্থাপত্য, কাব্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কৌশল , চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদির প্রভূত প্রভাব ফেলেছিল ।

বিংশ শতকে তেলের খনি খুঁজে পাওয়া যায় , বৃটিশ ও ইরানের যৌথ উদ্যোগ করে একটি কোম্পানী তেল উত্তোলন শুরু করে । তখনই চোখ পড়ে আমেরিকার । ১৯২১ সালে রেজা খান সেনা উত্থানে শাসনভার হাতে নিয়ে ইরানের উপরিকাঠামো, সমাজ , শিক্ষা ও জীবন যাপনে আধুনিকায়ন শুরু করেন । পশ্চিমা সভ্যতার সাথে মেলবন্ধন আরম্ভ হয়, , ইরান নবযুগের সভ্যতায় আলোকিত হতে আরম্ভ করে । ইতোমধ্যেই তেলের খনি সরকারি নিয়ন্ত্রনে আনা হয় ।
তেলসমৃদ্ধ ইরানের উপর সাম্রাজ্যবাদের শ্যেণ চক্ষু পড়ে । রেজা শাহ পহল্ভীকে উৎখাত না করলে তেলের ভাগ পাওয়া যাবেনা , শুরু হয় ধর্মীয় জিগীর তোলা । “ ইসলাম বিপন্ন” । বিশ্বের যেখানে যেখানে সম্পদ , সাম্রাজ্যবাদ সেখানেই করায়ত্ত করার চেষ্টা । আর ইতিহাসে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্য বাদই তার স্বার্থে ধর্মীয় মৌলবাদকে পরিপুষ্ট করে কাজে লাগায় । আফগানিস্তান তার সাম্প্রতিকতম উদাহরন । ইরানেও আয়াতোল্লা খোমেইনিকে পরোক্ষে মদত দিয়ে এক “ধর্মীয় বিপ্লব”শুরু হল । খোমেইনিকে কিছুকাল তুরস্ক, ইরাক, ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হল । অনেকেই বলতেন!”ইনকগনিটো” বৃটেন তাকে আশ্রয় দিয়েছিল।

ইরানে এক ধর্মীয় গণ অভ্যুত্থানের ফলে রেজা শাহ পহল্ভীর শাসণের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭৯ সালে নির্বাসিত কট্টর ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি রাষ্ট্র প্রধান হলেন । সংবিধান সংশোধন করে ইরানের নাম হল “ ইস্লামিক রিপাব্লিক অব ইরান” আর “সুপ্রীম লীডার” ঘোষিত হল আয়াতোল্লা খোমেইনি । তিনি আধুনিকায়নের কর্মসূচী এবং অন্যান্য নাগরিক সমানাধিকার বাতিল করে শরীয়া আইন বলবৎ করেন । রেজা শাহের আমলে ইরান শিক্ষা , সাহিত্য , খেলাধুলা , বিজ্ঞান প্রযুক্তির , নারী পুরুষের সমানাধিকার , স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষায় বিশ্বের সুসভ্য জগতের যোগ্য প্রতিবেশী হয়ে উঠেছিল। ইসলামিক রিপাব্লিক হবার পর সব থেকে বেশী আঘাত আসে নারী স্বাধীনতা , নারী মর্যাদা , সমাজে নারী সম্ভ্রম সব কিছু ধ্বংস করে তাদের হিজাব নেকাব বোরখা বন্দী করার কঠোর ব্যবস্থা । স্বাধীনতা মর্যাদা ও পুরুষতন্ত্রের দাসীত্ব থেকে মুক্তির স্বাদ পাওয়া নারী অবরুদ্ধ হল । ইস্লামিক রিপাব্লিকের আসল চেহারা দেখল ইরানী নারীরা । এখন যেমন আফগান নারীদের অবস্থা । এই বন্দীদশা , ক্রীতদাসীত্বের জীবন , মর্যাদাহীন গৃহপালিত প্রাণীর মত জীবন যাপন উপহার দিল তথাকথিত বিপ্লব ।

ধিকি ধিকি তূষের আগুন জ্বলছিলই । গত কয়েকদিন আগে অন্য শহর থেকে পরিবারের সাথে তেহরানে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে আসা তরুণী মাহআশা তামিনীকে রাস্তায় ধরে নীতি পুলিশ। তার নাকি হিজাব ছিলনা । থানায় নিয়ে এমন অত্যাচার আর দৈহিক নির্যাতন করলো, তাতে মাআশা মারা গেল । নীতি পুলিশকে ইরানী সরকার ধর্মের নামে হিংস্র পশুতে পরিণত করে ফেলেছে ।

অত্যাচারে , নির্যাতনে , অমর্যাদায় অপমানিত হতে হতে বিদ্রোহের বারুদ উত্তপ্ত হয়েই ছিল । শিক্ষা ছিলতো উন্মুক্ত জীবনের স্বাদের অভিজ্ঞতাও ছিল সমাজে । মাহআশা র হত্যা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কাজ করল ।
আজকের ছবি , ইরান জ্বলছে , রাস্তায় জনস্রোত , পুলিশ পিছুহটে যাচ্ছে , জনপ্লাবনের স্রোত এগিয়ে যাচ্ছে । বিদ্রোহিনীরা নগ্ন হয়ে সারা গায়ে মাহআসার নাম লিখে , লম্বা চুল কেটে তা দিয়ে পতাকার মত দন্ডের মাথায় বেঁধে , রাস্তায় হিজাব বোরখাইয় আগুন ধরিয়ে আকাশের দিকে তুলে ধরে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন । এ এক অভুতপূর্ব নারী অভ্যুত্থান । আজ দেখলাম নারী পুরুষ একসাথে ঢল নামিয়েছে রাস্তায় রাস্তায় ।
এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে কিছু দেখতে-মানুষ নানা প্রশ্নে ইরানী মা বোনেদের প্রতি বাঁকা, কেউবা অশ্লীল , কূটবুদ্ধির তথাকথিত কোট প্যান্ট টাই পরা লোক এই বিষয়টিকে নানা কূট তর্ক তুলে গুলিয়ে দিতে চাইছে । এই মুখোশ পরা নারীবিদ্বেষী ধর্ষকামী লোকগুলির ঘৃণাই প্রাপ্য ।

মানুষ , সভ্য দেশ ইরানের মা-বোনেদের সাথে আছে । ইরানের স্বৈরতান্ত্রিক বর্বর শাসনের অবসান হোক, ইরানে নারীমর্যাদার পুনঃপ্রবর্তন হোক । অসভ্য বর্বরতার কুশিক্ষা , অপসংস্কৃতির অন্ধকার যুগের অবসান হয়ে সভ্যতার আলোর পথযাত্রী হোক । ইরানের মানুষ তার অতীত সুবর্নযুগ আবার ফিরিয়ে আনুক ।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop