(প্রথম পর্ব)
আমার ছড়িদার আমায় বললে , তুমি কি শান্তি পেতে শুধু মাঠেই যাবে হাটে যাবে না ?
হাটে কেন ? আর মাঠ ?
ছড়িদার বলল , মাঠ দেখে হাট না দেখলে তোমার যাত্রা সম্পন্ন হবেনা । মাঠে দেখবে কর্তামশাই হাঁটছেন, গান গাইছেন, কবিতা লিখেছেন , ছবি আঁকছেন মানুষ কে মানুষ হওয়ার কথা বলছেন আর হাটে দেখবে মানুষের আনন্দের মেলা । ঝুরি ঝুরি সোনা লতা দুলছে , গাছের নীচে নীচে পাটি বিছিয়ে কত কি পসরা সাজিয়েছে , সেই সাথে সাঁওতাল যুবকদের মাদলের তালে তালে মাথায় ঘটের উপর ঘট সাজিয়ে সাঁওতাল মেয়েদের নাচ । ওখানেও তো কর্তা মশায় আছেনগো । তিনি এর নাম দিয়েছিলেন সোনাঝুরির হাট ।সে দেখা হলে তবেতো প্রানের আরাম, মনের আনন্দ আত্মার শান্তি হবে ।
যাবোইতো । তবে আমি শুরু করতে চাই যে ঘরে তিনি প্রথম মাটি আঁকড়ে ধরে ছিলেন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সদর ফটক দিয়ে ঢুকলে সবুজ গালিচার মতো ঘাসে ঢাকা খোলা চত্বর তার চারদিকে কেয়ারী করা। প্রশস্ত যায়গায় এসে দাঁড়ালাম । মূল বাড়ির দিকে তাকাতেই দেখি টানা ঝুল বারান্দা । উত্তরে দক্ষিণে লম্বা বাড়িটি যেন দুহাত প্রসারিত করে ভিতরে যাবার আহ্বান জানাচ্ছে। ঠিক মাঝামাঝি দরজা । বাড়ির ভেতরে ঢুকেই দেখি এক আয়তাকার বিরাট বাঁধানো উঠান। এক প্রান্তে তার উঁচু মঞ্চ। অন্য প্রান্তটি ঘোরানো বারান্দার সাথে যুক্ত হবার আগেই খোলা মঞ্চের মত উঁচু বর্গাকার জায়গা। .এটি আসলেই বাহিরমহল।
ভিতরে ঢুকে উঠানে মাঝখানে মঞ্চের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেই যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি এক গীতিময় সংলাপ.. এই কণ্ঠ আমাকে দখল করে নিল….
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।”
মনে হলো এখানে বসে চোখ বুজলেই দেখতে পাবো ‘ বাল্মীকির ‘ সেই মুগ্ধকরা মঞ্চায়ন ।আর সেই মুগ্ধতা মিশে যাচ্ছিল আমার রক্ত কণিকায় । সেই দীর্ঘ আলখাল্লায় আধঢাকা শ্মশ্রূগুম্ফ শোভিত গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় একটি মানুষ যেন আমার সামনেই মঞ্চে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, সংলাপ বলছেন। আমি দাঁড়িয়ে ” বাল্মীকি প্রতিভা” গীতিনাট্যের সেই দৃশ্য যেন দেখছি । আমরা এসেছি সপ্তাহের কর্মদিবসে তাই লোক সমাগম কম । স্মৃতিসম্ভার আর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পরিচালন দপ্তর এখন এই বাড়িটি। কিছু শিক্ষার্থীরা আছে এদিক সেদিক ছড়িয়ে । সিঁড়িতে পা ফেলে ফেলে যখন দোতলার লম্বা বারান্দায় পা রাখলাম….
মনে হলো রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে হাঁটছেন , আমি তাকে অনুভব করতে পারছিলাম । জোড়াসাঁকোর এ বাড়িটি দোতলা , বয়সের ছাপ স্পষ্ট । যেখান দিয়ে যাচ্ছি চমকে চমকে উঠছি । প্রায় একশ’ বাষট্টি বছর। এখানেই তিনি হামাগুড়ি দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে লুকোচুরি খেলতেন বড়দের সাথে, টলমল পায়ে হেঁটে বেড়াতেন। ছবি তোলা নিষেধ , খুঁটে খুঁটে দেখছি আর তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করে থমকে দাঁড়িয়েছি বহুবার । তার শেষ বিদায়ের ঘরটিতে থমকে ছিলাম কতক্ষণ কে জানে । সকল কিছু অচঞ্চল স্থির নিস্তব্ধ । কালের রথের চাকা যেন এখানেই এসে থেমে আছে ..। আমার প্রথম দিনের ঘোর কাটতেই দ্বিতীয় দিন রওনা হলাম ভূবনডাঙার মাঠে ।
২য় পর্ব
লিখতে বসেছি একটি দিন … সবেমাত্র আসি আসি শীতের ছোঁয়া প্রকৃতি তে ।খুব ভোরে রওয়ানা হলাম যখন পুরো আকাশ সবে মাত্র জীবিত হয়ে উঠছে রং ছড়িয়ে । লাল মাটির ধুলো মাখা পথ , আর একটু যেতে পড়ল ‘ভেদিয়া ‘ এ যেন সেই সূর্যের দুর্গে প্রবেশের সিংহদুয়ার । সেই যে ,–
“রুদ্র, তোমার দারুন দীপ্তি
এসেছে দুয়ার ভেদিয়া ;
বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎ বাণ
স্বপ্নের জাল ছেদিয়া ।“
রাস্তায় যেতে যেতে দলে দলে মেয়েদের শাড়ি পরে দুই বেনী দুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া দেখেই ঠাহর হচ্ছিল , প্রায় কাছেই এসে গেছি । অবশেষে এসে পৌছুলাম প্রশান্তির আলোয় ।খালি চোখে আটপৌরে একটি যায়গা ।সারা বিশ্ব থেকে গুণীমানুষ দের এনে জড়ো করে ছিলেন এখানে ।উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান ও সৌন্দর্যের চর্চা । শান্ত স্নিগ্ধ বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝে মাঝে এক একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । মাঝখান দিয়ে উত্তরে দক্ষিণে সোজা একখানা রাস্তা । গাড়ি আস্তে চালাতে বললাম , আড়াই ঘন্টার যাত্রায় পথে পড়েছে বেশ কিছু গ্রাম শহর , কিন্তু এ যেন অন্য কোন জায়গা । গ্রামের শান্ত স্নিগ্ধ মৌন গাছগাছালি আগলে রেখেছে মাঝে মাঝে বাড়িগুলিকে । পাখিদের ওড়া উড়ি, ডালে ডালে কাঠবিড়ালিদের নির্ভয়ে ছোটা ছুটি একেবারে অন্যরকম , যেন সবার এক অভিভাবক দৃষ্টি রাখছেন তাদের নিরাপত্তা আর মুক্তির আনন্দের ভোজে, উৎসবে ।
এই সেই জায়গা । কিছুদিন যাবতই মনটা খুঁতখুঁত করছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের । বাড়িতে সবই তো আছে । বিশাল বাড়ির নির্জন কক্ষ, উপাসনামন্দির , গৃহবাসীদের যত্ন । তবু যেন মনে হয় বাইরের রাস্তায় কেজো লোকের ব্যস্ত আনাগোনা , কথা বার্তা , কেনা বেচা এসবের অল্প শব্দ আর চিন্তা ঢুকে পড়ে । মন তেমন শান্ত থাকেনা । মাঝে মাঝে কিছুদিন নির্জনে কেবল প্রকৃতির স্নেহ আবাসে যদি থাকা যায় তো উপাসনায় মন বসে । ঘুরছিল চিন্তাটা থেকে থেকেই । একদিন আমন্ত্রিত হয়ে গেলেন সুরুলের কাছে রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহ রায়ের বাড়িতে । রাঙা মাটীর দেশ , কাঁকুরে মাটির রাস্তা । জমিদারবাবু তার লেঠেল বরকন্দাজদের বসতি করিয়ে দিলেন । নিজের নামেই মাঠের নাম । চোখে পড়ল সেই বিস্তৃত মাঠে দুটি ছাতিম গাছ , মনে ধরলো দেবেন্দ্রনাথের । এই জায়গাই যেন তিনি খুঁজছিলেন । প্রস্তাব দিতেই একটাকায় পেয়ে গেলেন এক লপ্তে বিশ বিঘে জমি । এখানেই, নিরিবিলিতে এই আশ্রম , সাধনার স্থান । তৈরি হল অতিথি আবাস , নাম দিলেন শান্তিনিকেতন । বাড়ির নামে নাম হল ভুবনডাঙার মাঠের । সেখানেই পিতার পরে পুত্র , আশ্রমিক বিদ্যালয় । এ ধর্মবিশ্বাসের অলৌকিক সাধনার আশ্রম নয় । , এ আশ্রম নিজেকে শুদ্ধ করার আশ্রম , জ্ঞান সাধনা, চর্চা আর প্রয়োগের আশ্রম । প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়ে মানুষ তৈরির আশ্রম ।
আমরা প্রথম এসে থামলাম উপাসনা গৃহের সামনে । মনে হল ভেসে আসছে সমবেত উপাসনা সঙ্গীতের সুর । এই চত্ত্বরেই শান্তিনিকেতন নামে আবাসটি । এখানেই প্রতিমা দেবী ও সন্তানসহ কবি বেশি থেকেছেন ।এই চত্তরেই বিদ্যালয় । সে এক অন্য বিদ্যালয়, গাছের নীচে বসে শেখা , যেখানে সেখানে বসে আঁকা , প্রত্যেকেই যেন মুক্ত প্রকৃতির সন্তান । রাস্তার অন্য পাশে উত্তরায়ন চত্ত্বর , এখানেই কবির বেশি বসবাস । পাখিদের মতন বাসা বদলের অস্থিরতা ছিল তাঁর , তাই এই চত্ত্বরে পাঁচটি বাড়ি নিজের নক্সায় তৈরি করিয়েছিলেন । শুধু মাটি দিয়ে তৈরী “শ্যামলী” বাড়িটি অপূর্ব । কোনার্ক-পুণশ্চ-উদয়ন-উদিচী , প্রত্যেকটিই আপন বিশিষ্ট গঠন শৈলীতে পৃথক । কবির জীবনে ব্যবহৃত সকল সম্ভাব্য স্মারকে ভরা উত্তরায়নে তাঁর উপস্থিতি টের পাচ্ছি আর থেকে থেকে শিহরণ ।দোতলা বাড়ি প্রত্যেওকটি কক্ষে কবির ব্যবহার করা খুঁটিনাটি জিনিসপত্রে সাজানো । কলম , চামচ চায়ের পাত্র, হাতের লেখার নমুনা, পোশাক , আলখাল্লা , নাটকে কবির ব্যবহৃত পোশাক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া নানা উপহার । দেখছি আর ঘরে ঘরে ঘুরছি , কবির নিঃশ্বাস যেন আমার মাথায় আশীর্বাদের মত ছোঁয়া পাচ্ছি ।বেদনায় ভিতরটি দুমড়ে গেল যখন নোবেল পুরস্কারের পদকটির সামনে এসে দাঁড়ালাম , এটি নকল বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । তাঁর সাথে আমার এই প্রথম সম্মীলনে এক অনন্য বোধ , আচ্ছন্নতার কুয়াশায় ঘোরাফেরা ।
এই চত্ত্বরেই রামকিংকরের সাথে দেখা । থেকে থেকে দাঁড়িয়ে দেখি তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি , “সাঁওতাল পরিবার” আর “কলের বাঁশি” । চলনদার বললে, এই সকল ভাষ্কর্যের রমণীর মুখের আদল বোঝার চেষ্টা করতে । জিজ্ঞেস করি , কেন ? এ তো আভাস । উত্তর এলো, “আভাসের ছবিটি যে শিল্পীর চেতনায় ছাপা হয়ে রয়েছে , লক্ষ্য করলে বোঝা যায় একটিই নারীর মুখাবয়ব।” কে সে ? রবীন্দ্রনাথ জানতেন, কিচ্ছুটি বলেননি । শিল্পীর সৃষ্টির উৎস চাই , চিরকুমার রামকিংকরের দেখভাল , রান্নাবান্না, অসুস্থতায় সেবাশুশ্রূষা করতেন যে সাঁওতাল রমণী জীবনভোর , তাঁর মুখের আদলই তাঁর বিশ্ববিখ্যাত সৃষ্টিগুলির প্রেরণা । আশ্চর্য, এসব শুণে আমার মনে একবিন্দু বিরূপতা এলোনা বরঞ্চ শ্রদ্ধায় মনটা ভরে গেল । শিল্পীর সৃষ্টির যে শক্তি , তা জুগিয়েছেন এই নারী । ধন্য তিনি ।
সবশেষে হাটে যাওয়া র পালা । হাটে গিয়েই দেখি , এ হাট কোথায় , এ তো দেখি ছোট্ট নদী কোপাইএর তীরে খোয়াইএর রাঙামাটির বন । বড় বড় গাছ গায়ে গায়ে লেগে আছে , এখানে ওখানে ঝোপ ঝাড় । গাছের ফাঁকে ফাঁকে পসরা সাজিয়ে বসেছে গ্রামের মানুষ, গ্রাম্য মহিলারা । পাকা দোকানদারও আজকাল মাটিতে চাটাই পেতে মেলার মত বসেছে । ঝোপে ঝাড়ে বাউল বসে গান গাইছে , কিছু উৎসুক শ্রোতাও জুটেছে , লেপ্টে বসে মাটিতে, গান শুনছে ।
এই হাটেই বাউলের গান, সাঁওতাল মেয়েদের মাদলের তালে তালে নাচ, ভরাট করে রেখেছিল হাটের আসর । এমন জীবন বেঁচে বেঁচে থাক । দেখে নিয়েছি একসাথে , যতটুকু দেখা যায় দুচোখ ভরে ।
এ তো বনের মধ্যে মেলা , হাট বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে তার সাথে এর মিল নেই মোটেই । দু এক পা এগিয়েই আমার মনে একটা কথা আচমকাই খেলে গেল । চলনদারকে বললাম, তোমাদের কর্তামশাই এর দেখছি এক মস্ত বাতিক ! যখন যেখানে পারেন কেবল নাম বদলে দিয়েছেন । মানুষ , জড়পদার্থের তৈরি বাড়িঘর, বনজঙ্গল, গাছ, যেখানে ইচ্ছে কেবল নাম দিয়েছেন । অণিমাকে করেছেন কণিকা , মাটির বাড়ির নাম শ্যামলী, আবার এই বেচারা আকাশমণি গাছের নাম করে দিলেন সোনাঝুরি । মানুষ সব আসল নাম ভুলে গেছে । এহাটে সবই বিকিকিনি হচ্ছে , একতারা , কাপড়চোপড় রূপা পিতলের আদিবাসী গয়নাগাঁটি । শহুরে মানুষ কিনছেও উপুড় হয়ে । আমিও কিনলাম দু একখানা । কেনা হলনা বাউলের আলখাল্লা, আর একখানা একতারা ; তোলা থাকলো পরের বারের জন্য । তারে আঙুল ছোঁয়ালেই বেজে উঠবে ,
“ আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকলখানে ।।
আছে সে নয়নতারায়,
আলোকধারায়
তাইনা হারায়
ওগো তাই দেখি তায়
হেথায় সেথায়
তাকাই আমি যেদিক পানে ………”
মনে মনে বলবো পৃথিবীটা একদিন বাউলের দেশ হবে । করিম শাহ, লালনে সাঁই আর রবীন্দ্রনাথে কোন ফারাক নেই আমার মত সাধারন মানুষের কাছে ।