হাসিবুয়া কোনদিনও এতো কামাই করে না। কিন্তু নয় দিন হয়ে গেল তার দেখা নেই। সরকারি আবাসন ‘পারিজাত’-এর দোতলা ও চারতলার তিনটা ফ্ল্যাট হাসি বুয়ার বাধা। এ তিনটা ফ্ল্যাটে অফিসাররা বদলী হয়, অবসরে যায় কিন্তু হাসিবুয়া থেকেই যায়। হাসিবুয়া কারো বাসায় বাধা কাজ করে না। কামরাঙ্গীর চরের নিজ ভাড়া বাসা থেকে কাকভোরে বের হয়, কাজ শেষে ফেরে রাত নটা সাড়ে নটায়। অন্যান্য বুয়ারা যেমন স্বভাবজাতভাবেই আদেখলা, ঘ্যানঘেনে, ফাঁকিবাজ, নাছোড়বান্দা হাসিবুয়া তেমনটা তো নয়ই বরং একটু বেশী মর্যাদাবোধসম্পন্ন। ঘর মোছা, কাপড় কাচা আর বাসন মাজা ওর কাজ। এ কাজের বাইরে কোন কাজ সে করে না। কোনদিনও বলে না ‘আজ খিদে লেগেছে’ বা এবার ঈদে আমাকে অমুক দিতে হবে, তমুক দিতে হবে। হাসিবুয়ার মোছা মেঝেতে যেন চলতে ফিরতে মুখটা দেখে নেয়া যায় – এমন স্বচ্ছ। তানভিরের বউ মনে মনে বলে –
‘ন’দিন ঘর মোছা হয়নি। কিন্তু এখনও কতো পরিস্কার। হাসিবুয়ার যে কী হলো। ইদানিং কোমর ব্যথায় বেচারা কেবল কষ্ট পায়। বিছানায় পড়ে রইলো না কি? ঠিকানা জানা আছে ওর। যাবে নাকি একবার? ’
দশ দিনের দিন তিন-চার বছরের মেয়ে কোলে শীর্ণকায়া এক তরুণী ঠিক হাসিবুয়ার মুখের আদল নিয়ে তানভিরের বাসায় বেল দিল। তানভিরের বউ কান্তা যে আশংকা করেছিল – তাই। হাসিবুয়া কোমর ব্যথায় আর বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। বুয়ার রিকশাচালক মেয়ের জামাই পা ভেঙে ঘরে বসে আছে একমাস। এখন মেয়েটা কাজে না বেরোলো সবার খাওয়া বন্ধ। কান্তা স্বস্তি পেল। কিন্তু অস্বস্তি লাগছিল হাসি বুয়ার নাতনিটাকে দেখে। ছোট বাচ্চা বসিয়ে রেখে কাজ করা কান্তার একদম ভাল লাগে না। কান্নাকাটি করে-
এটা ওটা ধরে- ভারি বিরক্তিকর। কিন্তু হাসিবুয়ার নাতনির মুখ দেখে ওর মনে হলো এতো সুন্দর বাচ্চা ও জীবনে দেখেনি। একটু ভালো কাপড়-চোপড় পরালে চাই কি তার পুতুনের চাইতেও মিষ্টি দেখাবে। নিজের অজান্তেই বাচ্চাটার গাল টিপে দিতে কান্তার হাত ওর গাল ছুঁলো। সে একটু হেসে মায়ের ঘাড়ে মাথা কাত করে দিল। ওর বাম গালে প্রীতি জিনতার মতো পুটুস্ করে একটা টোল ফুটে উঠলো। কান্তার খুব শখ ছিল ওর নিজের একটা মেয়ে হবে আর ওর গালেও হাসলে টোল পড়বে। কিন্তু মেয়েও হয়নি। টোলও পড়েনি। হাসিবুয়ার মেয়ের নাম অনেকবার শুনেছে কান্তা বুয়ার মুখ থেকেই। মেয়ে আর নাতনিটা যেন তার কলিজার টুকরা। নিজে বুড়ো হয়ে পরের বাসায় কাজ করলেও মেয়েকে কোন অমর্যাদাকর কাজে সে পাঠাবে না – বলতো। এখন এমনই নাচার যে আদরের মেয়েকে না পাঠালে তিনটি প্রাণি না খেয়ে মারা যাবে। কান্তা জিজ্ঞাসা করলো –
‘নাম কী?’
‘বানেছা’
‘আরে তোমারটা তো জানি। মেয়ের’
‘ও, তিশনা’।
বানেছা মায়ের মতো দ্রুততার সাথে কাজ করতে না পারলেও সেও মায়ের মতোই পরিচ্ছন্ন। ওড়নার খুট খুলে এক টুকরো বিস্কুট দিয়ে মেয়েকে বসিয়ে রাখে। মেয়েটা খেতে খেতে মেঝের ওপর ঘুমিয়ে যায়। যাওয়ার সময় রোজ মেয়ের জামা পেটের উপর তুলে ধরে ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে বানেছা পেট মুছিয়ে দেয়। প্রথম ক’দিন এমন কিছু মনে করেনি কান্তা। কিন্তু লক্ষ্য করে তিশনার নাভির বরাবর ফ্রকের উপর গোল ময়লা দাগ। বানেছাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে কান্তার মনে পড়ে যায় হাসিবুয়া প্রায় বলতো-
‘নাতনিটা আমার অসুস্থ। ওপরেশন করা লাগবে’।
বানেছা বললো জন্মের পরই ওরা লক্ষ্য করে মেয়েটার পায়ুপথ নেই। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার নাভির কাছে একটা ফুটো করে দেয়। ওখান দিয়েই মল বেরোয়। বলে দেয় একটা অপারেশন করে পায়ুদ্বার তৈরী করে নিতে হবে। বেশ ব্যয়বহুল। বানেছার স্বামী রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল। কিন্তু পায়ের চিকিৎসা করতেই সব শেষ। সরকারী হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে বানেছার মেয়ের অপারেশনের খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা।
কান্তা কোমল প্রাণের মেয়ে। কিন্তু তানভির কেবল বাচ্চার স্কুলের বেতন, রিকশাভাড়া আর মাঝেমধ্যে বাসার দরজায় আসা সবজিআলাদের কাছ থেকে টুকটাক কাঁচা সবজি কেনার জন্য কান্তাকে হিসেব করে মাসের প্রথমে টাকা দিয়ে দেয়। এ টাকা থেকে কিছু তো বাঁচেই না বরং কম পড়লে কান্তা নিজের জমানো টাকা দিয়ে পুষিয়ে দেয়। কিন্তু তানভিরকে বলে না। তানভিরকে বললে যদি ভাবে কান্তা টাকা মেরে এটা ওটা কেনে, তাহলে? কান্তা শিশু একাডেমির সামনে থেকে ফুলের চারা কিনে আনে। ওর বরান্দায় টবে হরেক রকমের ফুলের গাছ। তানভির অফিসে বেরিয়ে গেলে ছেলে পুতুনকে স্কুলে দিয়ে এসে কান্তা আগে ফুলদের খানিক গান শোনায়। কোনদিন গোলাপের কুঁড়ি ছুঁয়ে গায় ‘বল গোলাপ মোরে বল তুই ফুটবি সখী কবে?’ কিংবা ‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লি¬কা বনে’। ডিগ্রি পাশ করার পরই কান্তার বিয়ে হয়ে গেছে। বান্ধবীরা মাস্টার্স করে অনেকে বেশ ভালো চাকরি করে। কান্তার কোনদিনও মনে হয়নি ও চাকরি করবে। সংসার ফেলে রোজ সকালে উঠে সেজেগুজে অফিস যাওয়া আর সন্ধ্যেয় ফেরা। সকালে কোনদিনও আরাম করে বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা যাবে না। ওর অতো পোষাবে না। চারটে কম খেয়েই নাহয় দিন গেল। তাবলে ষাট বছর পর্যন্ত সকালে গা গড়ানোর স্বাধীনতা থাকবে না? কান্তার নিজের আয় নেই বলে ওর তেমন মাথাব্যথা নেই। এটা দাও, ওটা লাগবে, শপিং-এ যাবোÑএসব ঘ্যানঘ্যানানো স্বভাব কান্তার নেই। তানভির খুব হিসেবি ছেলে। বাজে খরচ তানভিরের দু’চোখের বিষ। আগে একটা ফ্যাট কেনার পয়সা গুছিয়ে পরে অন্যকিছু। মেয়েদের ঘন ঘন শাড়ি কেনারও পক্ষপাতি নয় ও। এগুলো বাজে খরচ। দু’ঈদে দুটো আর বিয়ে বার্ষিকীর একটা দামী শাড়ি বরাদ্দ। কিন্তু কান্তার শাড়ি কেনার বাতিক আছে। ছোটখাট যে কোন অনুষ্ঠানেই ওর একটা নতুন শাড়ি না পরে গেলে ভালো লাগে না। নতুন শাড়ি পরে তানভিরের সাথে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যায়। তানভির আঁড়চোখে দেখে। কবে কিনলে, টাকা পেলে কোথায় -এসব কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করে না। করে না কারণ তানভীর জানে কান্তার বাবা মারা যাবার পর কান্তার মা স্বামীর পেনশনের টাকা পান। টাঙ্গাইল জেলা শহরে নিজের বাড়িতে বসবাস করেন আর একটা বাড়ি ভাড়াও দেন। একমাত্র মেয়ে কান্তার জন্য টাকা রেখে দেন। কান্তা মাঝেমধ্যেই মায়ের কাছে গিয়ে টাকা নিয়ে আসে। মার কানে কেমন করে যেন পৌঁছেছে জামাই বাবাজি একটু বেশিমাত্রায় মিতব্যয়ী। মায়ের প্রাণ সন্তানের কৃচ্ছতা সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া মেয়ে তার আগাগোড়াই খরুচে স্বভাবের। নিজের জন্যে যতটা না তারচে বেশি অন্যের জন্যে। আজ ভাসুরের মেয়ের জন্মদিন, কাল ননোদের বিয়েবার্ষিকী, পরশু বন্ধুদের বাচ্চাদের ভালো রেজাল্টে কান্তার নিজের মনের মতো কিছু দেয়া চাই-ই। এগুলোর জন্যে কান্তা তানভিরের কাছে কখনও টাকা চায় না। কিন্তু উপহার হাতে কান্তার সাথে তানভির দিব্যি ফিটফাট হয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলে যায়।
তিশনাকে দেখে কান্তার ভারি কষ্ট হয়। বারান্দায় কান্তার ছলেরে পরিত্যক্ত গাড়ি নিয়ে খেলা করে। কান্তাকে দেখলেই গাড়টিা সরিয়ে দিয়ে চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়টিা যে তাকে কান্তা খেলতে দেয়নি, দিয়েছে তার মা Ñএটা পরের জিনিস না বলে নেয়ার সামিল। কান্তা বোঝে। কিন্তু সে অবাক হয়ে যায় এতো নম্নিস্তররে মানুষের মধ্যেও এতো মর্যাদাবোধ আসে কোত্থেকে? হাসিবুয়া – বানেছা – তিশনা এদের পুর্বপুরুষরা নিশ্চয় উচ্চবংশজাত। আজ হয়তো এরা পথের ফকির। কিন্তু মর্যাদায় কোন অংশেই শিক্ষিত লোকদের চেয়ে কম নয়। কান্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ‘শিক্ষিত মানুষদের এদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ’ -বিড়বিড় করে বলে তানভিরের শার্ট রোদে মেলে দিতে গিয়ে শার্টের ভেতরের বিমূর্ত মানুষটার প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ করে না। শার্টের পুরুষালি গন্ধ শরীরে কোন আবেদন জাগায় না। শার্টটা কোনমতে মেলে দিয়ে কী খেয়ালে কান্তা হাতব্যাগের মধ্যে নিজের তহবিল থেকে কিছু টাকা ভরে বাজারে বেরিয়ে পড়ে। তিশনার জন্য একটা ফ্রক আর একটা পুতুল কেনার পর ওর বুকটা খানিক হালকা হয়। বাসায় ফিরে দেখে কাজ শেষ করে বানেছা ঘুমন্ত মেয়ে কোলে বসে আছে চলে যাওয়ার জন্য। ফ্রকটা বানেছার হাতে দিয়ে কান্তা তিশনাকে ডাকে –
‘তিশনা, ওঠ ওঠ দেখ তোর জন্যে পুতুল কিনে এনেছি’
মায়ের কোলের মধ্যে তিশনা পুতুলের কথা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে পুতুলটা একবার হাতে নিয়েও হাত ফিরিয়ে নিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করেÑ‘মা নিই?’
বানেছা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলে পুতুল বুকে চেপে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তিশনা কান্তার দিকে তাকালে কান্তা দেখলো তিশনার চোখ দুটো লাল। কপালে হাত দিয়ে দেখলো মেয়েটার গায়ে বেশ জ্বর।
একদিন পর বানেছা এলো। সাথে তিশনা নেই দেখে কান্তার বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠলো। বানেছা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো না দেখে কান্তা একটু স্বস্তি পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
‘জ্বর ছাড়েনি?’
বানেছা কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে ঝাড়ু তুলে নিতে নিতে বললো-
‘হাসপাতালে লইছিলাম। অসুধ দিছে। তয় কইছে সাতদিনের মইদ্যে ভর্তি করন লাগবো। প্যাটের হেই জাগাডায় নাকি ইনফেশোন হইচে। হপাই ওপরেশোন না করাইলে ..’
বানেছা ঝাড়ু দিতে থাকে। কান্তা লক্ষ্য করে দাঁতে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে গিয়ে বানেছার চিবুক থিরথির করে কাঁপছে।
‘টাকার জোগাড় হয়েছে?’
‘ওপরতালার খালাম্মায় পাঁচশো দিছে’।
কান্তার কাছে কুড়িয়ে কাড়িয়ে হাজারখানেক হবে। কিন্তু লাগবে আরও তিন হাজার। তানভিরও ঢাকার বাইরে ট্যুরে। অবশ্য তানভির থাকলেও খুব লাভ হতো না। কারণ তানভির চাওয়ামাত্র তিনহাজার টাকা বের করে দেবে ফেরেশতা নেমে এসে বললেও কান্তা বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া কান্তা কোনদিন তানভিরের কাছে নিজের জন্য হাত পাতেনি। এমনকি ফকিরকে ভিক্ষা দেবার সময়ও কান্তা নিজেরটা থেকেই দেয়। মর্যাদাবোধের দিক থেকে কান্তা হাসিবুয়া বানেছার কাছাকাছি। তাই বানেছার জন্য কিছু করা নিজের জন্যই করা বলে বলে মনে হলো কান্তার। নিজেকে কেমন অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। ওপরতলার খালাম্মা ইতোমধ্যেই পাঁচশো টাকা দিয়ে দিয়েছে আর ও কিনা দু’দিন আগেই হাজার টাকা দিয়ে একটা শাড়ি কিনে আনলো? দোকানে শাড়িটা দেখে রসনা সংযত করতে পারেনি কান্তা। ঘিয়ে রঙের মধ্যে কমলার কাজ। শাড়ির সাথেই রানিং ব্লাউজ পিস। কিনে পরিচিত এক টেইলার্সে ব্লাউজ বানাতে দিয়ে বাসায় এসে যখন শাড়িটা পরে দেখলো ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। একটুও মানাচ্ছে না। ইস্ কেন যে ঝোঁকের মাথায় অতোগুলো টাকা মাটি করতে গেল! কাল সকাল সাড়ে আটটার বাসে মায়ের কাছে গিয়ে টাকাটা নিয়ে সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে আসার কথা ভাবলো সে। বানেছাকে আজ কিছুই বলবে না। টাকাটা এনে পরশু একবারে বানেছাকে দিয়ে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত হবে। তিশনা ভালো হয়ে উঠবে। ওর নিজের সন্তানের বয়সী পৃথিবীর তাবৎ শিশুকে ওর সন্তানবৎ মনে হয়। তার ছোট্ট পুতুনেরও তো ওরকম হতে পারতো। কান্তার মায়ের হৃদয় বানেছার হৃদয়ের কান্নার সাথে একাকার হয়ে উঠলো।
সকালে উঠে ছেলেকে গুছিয়ে নিয়ে রওনা হবার মুখেই তানভিরের মামাতো ভাই হোস্টেল থেকে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এসে হাজির। ছাত্রদের দু’গ্র“পের মধ্যে গণ্ডগোলে ভার্সিটি বন্ধ। সন্ধ্যার বাসে বাড়ি চলে যাবে। ভালোই হলো বাসা খালি রেখে যাওয়া লাগলো না। কান্তা ফিরলে না হয় যাবে।
দুপুরের আগেই বানেছা এলো। বানেছার চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। তিশনার জ্বর বেড়েছে। এতদিন মুখফুটে কান্তার কাছে সে কিছুই চায়নি। আজ আর না বলে পারবে না। সে বিনা বেতনে একবছর দু’বছর কাজ করে দেবে। টাকাটা ধার হিসেবেই যেন কান্তা তাকে দেয়। তিশনাকে বাঁচানো ছাড়া তার পৃথিবীতে আর কিছুই চাওয়ার নেই। মা স্বামী থেকেও এ বিপদের দিনে কেউ তাকে এক পয়সা সাহায্য করতে পারছে না। বানেছা একা। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করাও তো এ মুহূর্তে সম্ভব না।
দরজা খুলে দিল অপরিচিত এক যুবক। বানেছা বাসায় ঢুকে চারদিক অসহায়ের মতো তাকিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে জিজ্ঞাসা করলো-
‘আপাই কই? আপাই নাই?’
‘তোমার আপা মায়ের বাড়ি চলে গেছে’
‘ও আল্লাগো। আমি এখন কই যাবো?’ – বলে বানেছা ধপাস করে মেঝের উপর বসে পড়লো।
যুবক সব শুনে বানেছার শরীরে ইতিউতি চোরা দৃষ্টি ফেলে ‘এ ক’টা টাকা কোনো ব্যাপার?’ বলে বানেছার মুখের দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার অর্থ বুঝতে বানেছার কোনই সমস্যা হলো না। বানেছার জন্মগত মর্যাদাবোধ কয়েক মুহূর্তের জন্য চেতনায় বিচারকের হাতুড়ির মতো শব্দহীন আঘাত করলো। একবার মনে হলো যুবকের কামনামদির চোখের মধ্যে দু’খাবলা থুতু ছিটিয়ে ঝাড়ুর একটা বাড়ি দিয়ে সে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো বেরিয়ে যাবে কোথায়? কে দেবে তিশনার অপারেশনের অতগুলো টাকা? বারবার ক্ষুধার অন্নে মুখ দিতে আসা বেড়ালকে ‘হেস্ হেস্’ করে তাড়ানোর মতো করে যে দৃশ্যটা সে মন থেকে তাড়াতে চাচ্ছে তা তিশনার মৃত্যু। মনে হচ্ছে তিশনার পেটের ঘা সমন্ত পেটে ছড়িয়ে পড়েছে, রাতদিন মাথায় এক সাগর পানি ঢেলেও জ্বর কমানো যাচ্ছে না, তিশনা যেন বলছে -মা আমার পুতুলডারে দেইখ্যা রাইখো। মাগো অহন না, আমার প্যাটের ঘাও সারলে আমি নতুন জামা পরুম’। কিন্তু তিশনা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হতে হতে তিশনা একটা বরফখণ্ডে পরিণত হচ্ছে। তিশনাকে খাটিয়ায় করে বস্তির লোকজন গোরস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। বানেছার নাকে আসছে আতরের ঘ্রাণ।
যুবক কখন যেন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে সামান্য অবশিষ্ট সুগন্ধীর সুদৃশ্য শিশি। বানেছা কতক্ষণ ভাবছিল? দু’এক সেকেন্ড, দু’এক মিনিট না দু’এক ঘন্টা? যুবকের দৃষ্টি সাদা, অর্থহীন, পলায়নপর। তাহলে যুবক যা চেয়েছিল তা কি এরই মধ্যে সংঘটিত হয়ে গেছে? কখন? কীভাবে? সুগন্ধীর শিশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে কেন যুবকটি?
‘এটা ধরো’
‘এইডা ক্যান?’
‘তুমি ওপরতলায় কাজ সেরে আসো। আমি বন্ধুর কাছে টাকা পাই। একঘন্টার মধ্যে টাকা নিয়ে ফিরবো’- বলে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বানেছাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে যুবক দরজায় চাবি লাগিয়ে চলে গেল। বিস্মিত, বাকরুদ্ধ বানেছা যুবকের পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা নেমে শরীরের সমস্ত ভার হারিয়ে রেলিং ধরে নিচে বসে পড়লো। তার মুখ দিয়ে অস্ফূটভাবে বেরলো -‘আমার দামটা..’। হাত থেকে পুরোনো সুগন্ধীর শিশি গড়াতে গড়াতে সিঁড়ির সবচে নিচের ধাপে গিয়ে ঠেকলো।
ওপরতলায় কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করতে করতে পাঁচবার নিচে এসে দেখে গেল বানেছা। দরজা আগের মতোই বন্ধ। মেইন গেটের সামনে আরও একঘন্টা অপেক্ষা করে শূন্য হাতে বারবার পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে ক্লান্ত পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরতে শুরু করলো। তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপের গোড়া থেকে যেন পাপের ভাপ বেরিয়ে আসতে লাগলো। সিনেমা হলের পাশ দিয়ে আসার সময় মুখে রঙমাখা মেয়েগুলোর সাথে নিজেকে কিছুতেই পার্থক্য করতে পারলো না। ‘তিশনা তিশনারে’ বলে হু হু করে কেঁদে উঠলো অন্তর। যে পাপ সে করেছে তাতে আল্লাহপাক যদি তাকে শাস্তি দিয়ে তার তিশনাকে পৃথিবী থেকে তুলে নেয়? এ পাপ শরীর সে আর রাখবে কেন? কী জবাব দেবে তার স্বামীর কাছে? তার তিশনাই যদি না বাঁচে তবে কী হবে পাপের শরীর সারা জীবন বয়ে বেড়িয়ে?
সন্ধ্যার সুরমারঙা আঁধারে বস্তির গলির মধ্যে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করে বাড়ি ঢোকার মুখে বানেছার বুকটা ছ্যাত্ করে ওঠে। তার তিশনার কিছু হয়ে গেলে তারই পাপে হবে। আল্লাগো, কেন এ সর্বোনাশ করলাম আল্লা Ñবলে ঘরের দুয়ারে পা দেয়ার আগেই যে সুগন্ধীর শিশি সে ফেলে দিয়ে এসেছে তার ঘ্রাণ পেল। ওমা, লোকটা কি তাহলে আগেই এখানে এসে টাকা নিয়ে বসে আছে? আশংকা আর প্রত্যাশায় মনটা দুলে উঠলো। সারা বাড়িভরা সেই গন্ধ। নাকি আতরের ঘ্রাণ? তিশনা কোথায়?
কান্তা তিশনাকে আঙুর খাওয়াচ্ছে। কান্তার ছেলে মায়ের পাশে বসে পরিচিত মেয়েটিকে ক’দিন পর পেয়ে বন্ধুর মতো হাসছে। বানেছার স্বামী-মা হতভম্বের মতো অবাকবিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে।
‘এই যে বানেছা, এতো দেরী করলে আজ? ভাবলাম তোমার হাতে টাকাটা দিয়েই বাসায় ফিরবো। এই নাও। কাল সকালেই হাসপাতালে ভর্তি ক’রো। সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি আসি।’ তিশনার মাথায় হাত রেখে নিরব চোখে নির্ভয়ের বার্তা শুনিয়ে ছেলের হাত ধরে নিশ্চিন্ত সুখী পায়ে কান্তা বেরিয়ে গেল।
বানেছা টাকার খাম হাতে কান্তার চলে যাওয়ার পথের দিকে কতক্ষণ চেয়ে রইলো সে নিজেও জানে না। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মেয়েকে কোলে তুলে বুকে চেপে ঘরের দেয়ালে মাথা কুটলো। যখন সন্বিৎ ফিরলো তখনও বাতাসে সেই প্রতারক শিশির সুগন্ধীর ঘ্রাণ। ঘ্রাণে পাপের গন্ধ না কোনো পূন্যরে বানেছা ধীরে নেমে আসা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কুলকিনারা খুঁজে পেল না।