অমৃতা-মির্চা এলিয়াদের প্রেম ও পরবর্তী কথামালা (মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’র শেষ পর্ব) – জাহাঙ্গীর হোসেন

By Published On: July 20, 2021

অমৃতা-মির্চা এলিয়াদের প্রেম ও পরবর্তী কথামালা
(মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’র শেষ পর্ব)

৩০২১ সনের এক চমকপ্রদ বিস্ময়কর পৃথিবীতে ক্লোনে পুনর্জম্ম লাভের তৃতীয় দিনে নেয়া হলো আমায় ‘হিউমান প্রডাকশন ল্যাবে’। ঐ ল্যাবের দুজন পরিচালক আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, কিভাবে এখানে নতুন মানুষ উৎপাদন করা হয় কিংবা পুরণো কোন ‘অকেজো’ বা ‘অনাগ্রহী’ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে ‘ফ্রিজ’ করে রেখে দেয়া যায় সাময়িক সময়ের জন্যে। ২০২১-পূর্ববর্তী বিশ্বকে আরো নিবিড়তায় জানার জন্যে ৪-সদস্যের এক ‘বিশেষজ্ঞ টিম’ আমার কাছে জানতে চাইলো, ঐ সময়ের আরো কজন মানুষের ‘ক্লোন’ করার ব্যাপারে, যাদের মাধ্যমে তারা ২০২১ পূর্ববর্তী পৃথিবীর সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্কে সুন্দর একটা ধারণা লাভ করতে পারে।

আমার জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের নাম ছাড়িয়ে কেন যেন তাদের আগেই আমার মনে নাড়া দিলো ১৯৩৩-সনে রুমানিয়ান, ১৯৫০-এ ফ্রেঞ্চ ও শেষে ১৯৮৮ সনে বাংলাতে ‘লা নুই বেঙ্গলী’ এবং তার প্রতি জবাবে ১৯৭৩-এ লেখা ও ১৯৭৪-এ প্রকাশিত মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’র কথা। দুটো আত্মজৈবনিক উপন্যাসই পড়া ছিল আমার ছাত্রাবস্থায়। এমনই পড়া ছিলো যে, আজ এক হাজার বছর পরও এই ৩০২১-সনে হুবহু ঐ ঘটনার অনুপুঙ্খ মনে আছে এক অমীয় প্রেমের গল্পকথনের মত। ‘অমৃতা’ আর ‘মির্চা’র ক্লোন করার পুস্তাবনা শুনে ও ‘লা নুই বেঙ্গলী’ ও ‘ন হন্যতে’ নামক ‘আন-কমন’ এমন নামে ‘বিশেষজ্ঞ টিম’ জানতে চাইলো, “কি এমন চমৎকারিত্ব ছিল ঐ কাহিনির, যাতে অন্য অনেক ঘটনার আগেও আপনার মনে পড়লো মির্চা আর অমৃতার এ গল্প”? বিশেষজ্ঞ টিম প্রস্তাব দিলো, তারা কি তাদের সাহিত্য আর্কাইভে রক্ষিত ‘মাইক্রো-ফ্লিম’ ঘেটে ঐ বই দুটো বের করবে? ঘটনাটা আমার কাছে তখনো জলের মতই উজ্জ্বলতর ছিলো বলে আমি তাৎক্ষণিক বললাম –

“দরকার হবেনা খোঁজার। আশা করি আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারবো আমার পুরোণ স্মৃতি থেকেই। ‘হিউমান প্রডাকশন ল্যাবে’র নিয়মানুসারে বিশেষজ্ঞ টিমের কাছে বর্ণনা দিতে শুরু করলাম আমি উনিশ শতকের কোলকাতার মেয়ে ‘অমৃতা’ আর ‘রুমানিয়ার’ ছেলে মির্চার ভালবাসার গল্প এক নিটোল প্রেমের সপ্তপদি দু:খদের বহ্নিমান মৃত্যুর মত!

প্রাক্তন ভারতের কলকাতা শহরের ভবানিপুরে মৈত্রেয়ী দেবী নামে ১৬-বছরের এ তরুণী বাস করতো তার মা, বাবা, বোনের সাথে। যদিও এ পরিবারটির বসবাস ছিল মূলত প্রাক্তন বাংলাদেশের বরিশাল জেলার মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্তের গ্রাম ফুল্লশ্রীতে। ষোড়শী এ মেয়েটিকে তার বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বাবা ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন ও মা হিমানী মাধুরী রায় (ইন্দিরা) ‘রু’ নামেই ডাকতো। মির্চা এলিয়াদের জন্ম ১৯০৭-সনে প্রাক্তন রুমানিয়ার বুখারেস্টে। ১৯২৮-৩২ সালে ভারতে ‘নোয়েল এন্ড নোয়েল’ কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ২৫০-টাকা বেতনে সে ভারতে আসে চাকরি নিয়ে। উদ্দেশ্য চাকরির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি আর জ্ঞান সাধনা। এবং ঘটনাক্রমে ড. সেনের বাড়িতে ‘পেয়িংগেস্ট’ হয় তখনকার খৃস্টধর্মী ইউরোপিয়ান শেতাঙ্গ মির্চা। এ দার্শনিক বিজ্ঞানীর মেয়ে তৎকালীন ভারতীয় কফিরঙা অমৃতা কলেজছাত্রী, ভাবুক ও কবি। তার কথাবার্তায়, চালচলনে রয়েছে কিছুটা দার্শনিকতার ছাপ। অল্প বয়সী মেয়ের এমন আচরণ মির্চার মধ্যে ‘যার পর নাই’ বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। একদিন সেই মেয়েটিকেই তখনকার ফ্রেন্স ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়লো মির্চার ওপর। আর মেয়েটিকে দেয়া হলো মির্চাকে ঐ সময়ের কলকাতার বাংলা শেখানোর কাজ। অমৃতা প্রথম ভালোবেসেছিল একটি গাছকে, যে বৃক্ষ ছাড়া সে থাকতে পারতোনা একটুও! অমৃতার দার্শনিকসুলভ ধীরস্থির আচরণ সহজেই মন কাড়ে মির্চার। অর্থাৎ নারী চরিত্র হিসেবে অমৃতা ঐ যুগে ছিল আধুনিক ও অনন্য।

১৯৩০-সালে কালচে বাদামি রঙের ভারতীয় এ বালিকার সাথে রোমানিয়ার এ তরুণের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনা। এ সম্পর্ক তারা গোপন রাখতেও পারেনি বেশিদিন। অল্পদিনেরই অভিভাবকেরা বিষয়টি জেনে যায়। কিন্তু বিস্ময়কর ছিল সেই ১৯৩০-এর পৃথিবীর ধর্মনির্ভর সমাজ। জাত-পাত তথা ধর্মীয় কারণে তরুণটিকে শিক্ষকের বাড়ি থেকে চলে যেতে হয় রূঢ়ভাবে এক সকালে এবং আর কখনোই মেয়েটির সাথে যোগাযোগ না করতেও বলা হয় কঠোরতর নির্দেশে। সন্যাসজীবন শেষে পরবর্তীতে সেই তরুণ পরিচিতি পান বিশ্বখ্যাত দার্শনিক হিসেবে। লেখেন একটি আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস, যা ১৯৩৩-সালে রোমানিয়ায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটি লেখা হয়েছিল বিশেষ করে একটি সাহিত্য পুরস্কারের জন্যেই। পরে তা “হট সেলার বুক” হিসেবে দেদার বিক্রি হয় এবং লেখকের জন্য বিপুল অর্থ ও খ্যাতি বয়ে আনে। উপন্যাসটি তখন ইতালিয়ান, জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় অল্পদিনেই। রোমানিয়ার সেই লেখকের নাম মির্চা এলিয়াদ, আর ভারতীয় মেয়েটির নাম মৈত্রেয়ী দেবী। রোমানিয়ার উপন্যাসটির ইংরেজি নাম ‘বেঙ্গল নাইটস’! মির্চা এলিয়াদও এরপর সংসারি হন। তার দু’স্ত্রীর নাম ছিল যথাক্রমে Christinel Cotescu ও Nina Mareş কিন্তু দুজনেই ঘটনাক্রমে জ্ঞানতাপস মির্চার আগেই মৃত্যুবরণ করে তাকে একাকি ফেলে, সম্ভবত অমৃতার জন্যে!

বিশ বছর বয়সে অমৃতার বিয়ে হয়ে যায়, কলকাতার ভারতীয় বনেদী মনমোহন সেনের সাথে। তাদের সন্তানও হয় দুটো। এরপর সে লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। প্রকাশ করতে থাকেন কবিতা ও গদ্যের বিবিধ বইপত্র। ১৯৩৯-সালে তার পিতা ড. সেনের ইউরোপ ভ্রমণের পরেই কেবল ‘রু’ রোমানিয়ায় প্রকাশিত মির্চার লেখা ‘লা নুই বেঙ্গলি’ উপন্যাসটি সম্পর্কে জানতে পারেন। এও জানতে পারেন, সেটি তাকেই উৎসর্গ করে লেখা হয়েছিল, তার পিতা যাকে “পর্ন” লেখা হিসেবে ব্যঙ্গ করেছিল। ১৯৭২-সালের দিকে লেখকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলকাতায় এলে অমৃতা বুঝতে পারে যে, বইটিতে তাদের দুজনের ‘যৌন’ সম্পর্কের বর্ণনা করা হয়েছে অসত্যরূপে। ঐ বইতে মির্চা সহজাতভাবে লেখেন, তাদের প্রেমের এক পর্যায়ে প্রায়শ রাতে তার প্রেমিকা তার ঘরে চলে আসতো তথা তাদের মধ্যে স্থাপিত হতো “শারীরিক সম্পর্ক”। যদিও মির্চার বইর উৎসর্গপত্রে অমৃতাকে লেখা ছিল “….. Tomar Ki moné acché ? …. Yadi thaké, taholé Ki, Kshama Karté Paro ? ….” ‘মির্চার এ বর্ণনা পরিপূর্ণ মিথ্যে’ – এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই পাল্টা আরেকটি বই লেখেন ভারতীয় নারী মৈত্রেয়ী দেবী তথা অমৃতা তথা “রু”। সে বইটিই হলো ‘ন হন্যতে’। বাংলা করলে ‘ন হন্যতে’-এর অর্থ দাঁড়ায়, “হত্যা করা যায়না” বা “নিহত হয়না” এমন কিছু। মানবাত্মার আঁধার যে মানব-শরীর, তাকে হত্যা করা যায় কিন্তু আত্মাকে যায়না। উপন্যাসটিতে আসলে লেখিকা আত্মার অমরত্বের পাশাপাশি প্রেমের অমরত্বের কথা বলতে চেয়েছেন। এতোটুকু শোনার পর কিছুটা ‘অধৈর্য’ হন বিশেষজ্ঞ কমিটি। তারা জানতে চান – “যেহেতু প্রেমের পর দুজনেই আবার দুজনকে ভুলে যায় এবং আলাদা ‘স্পাউসে’র সাথে ঘর-সংসার করতে থাকে, তাহলে আর বিশেষত্ব কি রইলো এ কাহিনিতে”?

আমি আবার বলা শুরু করি। অমৃতা মির্চাকে নিয়ে এতোদিন কিছুই লেখেনি কিন্তু মির্চার উপন্যাসের “জৈবিকতার পাঠ” তার কাছে অতিকথন তথা ‘মিথ্যে বর্ণনা’ মনে হয় ও সে এর প্রতিবাদে প্রায় ষাট বছর বয়সে মূল সত্যটি সামনে আনতে এক নতুন উপন্যাস রচনা করেন, যার নামই মূলত ‘ন হন্যতে’। এ উপন্যাসে লেখিকার জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, মির্চার তুলনায় নিঃসন্দেহে অনেক গভীর ও হৃদয়গ্রাহী, যেখানে দৈহিক চাওয়াকে ‘অগ্রাহ্য’ করা হয়েছে, পারিবারিক-সামাজিক ধমীয় রীতিকে প্রাধান্য দিয়ে। দুজনের বর্ণনাতেই যদিও অনেক ঘটনার বেশ সাদৃশ্য বিদ্যমান কিন্তু ১৯৩০-সনে অমৃতার বাড়ি থেকে মির্চাকে তাড়িয়ে দেয়ার পরের বর্ণনায় অমৃতা নিটোল সত্যকে ধরে রেখেছিল অত্যন্ত নিপুণতার সাথে। বই এর শেষভাগে এসে দীর্ঘদিন পর মৈত্রেয়ী আর এলিয়াদের সাক্ষাতের বর্ণনা আছে; ঐ সময়ের জীবনের অপূর্ণতা আরেক জীবনে মিটিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি আছে, আর আছে পার্থিব ভালবাসার অব্যক্ত হাহাকারের দহন।

এবং পরিণতিতে ১৯৫২-সনে পিতা ড. নরেন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর, ১৯৫৭ সালে শিকাগোতে যখন ইতিহাসের ধর্মীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন মির্চা এলিয়াদ, ক্রমে সেও স্ত্রী হারিয়ে নি:সঙ্গ একাকি জীবন কাটাতে থাকেন পুস্তক আর জ্ঞানের রাজ্যে। ১৯৮৬-সনে মির্চার মৃত্যুর আগে অমৃতা একাকী ভারতবর্ষ থেকে শিকাগোতে গমন করেন, কেবল তার ১৬-বছর বয়েসি প্রেমিক মির্চার সাথে একবার দেখা করতে। কিন্তু শেষ জীবনে অমৃতা যখন পৌঁছলো তার বিশ্ববিদ্যালয়ে, মির্চা ততদিনে অন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্যে। তাদের সেই সাক্ষাতের দৃশ্য আমাদের চিত্তকে এতো আলোড়িত করে যে, সারা জীবন তা ভোলার নয়, এমনকি হাজার বছর পরও ঐ সাক্ষাতের সংলাপগুলো পর্যন্ত আমার মনে আছে এখনো। সাক্ষাতের প্রথমেই মির্চার টেবিলে অমৃতা তার নিজের লেখা ৪০-বছর আগের যে চিরকুটটি দেখতে পায়, তাতে লেখা ছিল – “অজস্র মণিমুক্তা সজ্জিত সুবর্ণ দেবতার মত, অপার অসীম সুষমায় আমি তোমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণতা হই, আর তুমি আমাকে বুকে তুলে নাও”। ঐ চিরকুটির এক কোণে মির্চার শেষ কথাটি ছিল – “আমার প্রচণ্ড ইচ্ছে করতে লাগলো, অমৃতাকে অন্তত একবার চোখের সামনে দেখি”।

এবং ৪২-বছর পর অশীতিপর বৃদ্ধা অমৃতা যখন পৌঁছলো বৃদ্ধ অধ্যাপকের কক্ষে মেঝেতে ছড়ানো হাজারো পুস্তকের পাহাড় ডিঙিয়ে, তখন তার কাঙ্খিত ২০-বছরের মির্চা চুলহীন টাক মাথায় থুড়থুড়ে বুড়ো তার দিকে না তাকিয়েই বললো – “তুমি অমৃতা”! এবং প্রলাপের মত যখন মির্চা স্বগতোক্তিতে বলতে থাকলো – “চল্লিশ বছর! হায়! চল্লিশ বছর”! তখন ঐ কথার রেশ টেনে অমৃতার বুকে ধ্বনিত হলো কেবল –

– “জানো লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করে, কতোদিন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে, আমার মনে পড়েনা, কতো দিন ছিলে বল তো?’
‘হাজার বছর-‘ তবে?… আমি তো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি, যাকে Weapon cannot pierce, fire cannot burn… সংস্কৃতিতে বললে, ‘ন হন্যতে হন্য মানে শরীরে-‘ ।

ফিরে যাচ্ছিল অমৃতা -অবশেষে কথা কইতে কইতে মুখ তুললে অমৃতা দেখলো স্থির দৃষ্টির পাথুরে চোখ মির্চার। চোখের আলো নিভে গেছে তার! হয়তো অমৃতার অপেক্ষাতেই। এবং অমৃতার কণ্ঠ রুদ্ধ অনুভব করে মির্চা বললো –

……’একটু দাঁড়াও অমৃতা-… এতো দিন এতো সাহস দেখিয়ে, এখন তুমি ভেঙে পড়লে কেন? আমি বলছি, আমি যাব তোমার কাছে, এখানে নয়, সেখানে গঙ্গার তীরে, আমার সত্যরূপ তোমাকে দেখাব I will show you my real self on the shores of the Ganges..।’
এবং অমৃতারূপী মৈত্রেয়ী দেবী তার উপন্যাসটির শেষ বাক্য পর্যন্ত পাঠকদের ধরে রাখেন তার সৎ ভাষণে স্নাত করে যে, “ফিনিক্স পাখি হলেও মির্চার চোখে আলো জ্বালাবেই সে একদিন”। এবং শেষ বাক্যটি লেখিকার “আশার মায়ায় গড়া সেই ব্যাবৃতপক্ষ মহাপক্ষী” —অর্থাৎ হঠাৎ ‘ফিনিক্স’ হয়ে যাওয়া “সেই ছোট পাখিটা”-র মুখ দিয়েই উচ্চারিত হয় —

– ‘যেদিন ছায়াপথে তোমাদের দেখা হবে, তার তো আর বেশি দেরি নেই।’

হ্যা, এবং বেশি দেরী ছিলওনা। শেষ সাক্ষাতের কদিন পরই প্রথমে মির্চা ১৯৮৬-তে এবং অমৃতা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৯-তে এক পরিপূর্ণ বিচ্ছেদের যন্ত্রণাকাতর হাহাকার নিয়ে। কেবল প্রাক্তন ভারতীয় সামাজিক আর ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে মির্চা আর অমৃতার মিলন হয়নি। তাই উনিশ শতকের এ দুই মানব-মানবী মূলত এক ট্রাজিক জীবন নিয়েই পৃথিবী ছাড়ে। আর ‘ন হন্য’তে বই লিখে অমৃতা অনেক আপনজনকে বিব্রত করেছিল ঐ সময়ের সামাজিকতায়। কেউ-কেউ ওঁর সঙ্গ চিরদিনের জন্যে সম্পর্ক ত্যাগও করেছিল, কেবল একজন অভারতীয় অধার্মিকের সাথে প্রেম করার ‘অপরাধ’ প্রকাশ করার কারণে। আর এ ট্রাজিকতার কারণে আমার ইচ্ছে ১৯৩০-সনের অমৃতা আর মির্চাকে ‘ক্লোন’ করা হয় যেন এবং তাদের বেছে নেয়ার অধিকার দেয়া হোক আজকের ৩০২১ সনের ধর্ম, জাতপাতহীন এ মুক্ত সুন্দর পৃথিবীতে।

৩০২১’র পৃথিবীর মানুষেরা তাদের চিন্তন, বিজ্ঞান, যোগাযোগ ইত্যাদিতে প্রভুত উন্নতি করলেও, তাদের আবেগ রয়ে গেছে সেই ২০২১’র মতই। তাই ন হন্যতের অমৃতা-মির্চা কাহিনি শুনে সুখ জীবনের স্মৃতিদীর্ণ পোড়ো বাড়ির কষ্টের মত বিশেষজ্ঞ টিম আবেগাপ্লুত হয় ঝড়োজলের মতই। ঐকমত্যে পৌঁছে তারা ১৯৩০-র শেষ বিচ্ছেদের দিনের অবয়বে অমৃতা আর মির্চার “ক্লোন” করবে।

১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ ভবানিপুরের বাড়ি থেকে বিদায়লগ্নে অমৃতা শেষবারের মত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মির্চাকে লক্ষ্য করে বলেছিল –
“অজ: নিত্য শাশ্বতোহয়ং পুরানো ন হন্যতে হন্য মানে শরীর’ আজ সে শরীর নেই কিন্তু সে আছে, সে অম্যতা”। তাই ঐ সময়ের অমৃতা – মির্চাকে বানাতে অনুরোধ করলাম আমি পুনর্বার। বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্য ‘ট’ বললো – “এমন করলে কেমন হয়? ক্লোনের পর অমৃতাকে তার ভবানিপুরের বাড়িতে স্থাপন করা হবে। আর মির্চা স্থাপিত হবে কাশীর কাছে শালবনের ছায়াঢাকা পাথুরে পথের পাশে পার্বত্য নদীর ওপারে ব্র্রহ্মপুরী অরণ্যে, ঋষিকেশের পাশেই ‘স্বর্গাশ্রম’ নাম ছিল যার। কালীকম্বলিওয়োলা ধর্মশালার ভোজনালয়ের ঠিক নৈকট্যে। ওখানে এক গুহায় ছাইমাখা জটাধারী কমণ্ডলুক সন্যাসিরূপী ‘মির্চা’। ‘ট’র এমন নিখুঁত বর্ণনায় হেসে উঠলো সবাই সমস্বরে। এবং তাই সিদ্ধান্ত হলো। কেবল ক্লোন নয়, ১৯৩০’র আবহ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে স্থাপন করা হবে তাদের দুজনকে ঐ সময়ের ভারতবর্ষে!

বিশেষজ্ঞ টিমের তৎপরতায় ডাকা হলো গণিতবিদদের। তারা ১৯৮৬’র মিশিগানের, আর ১৯৮৯’র কোলকাতার জল-মাটিকে একাকার করে শুরু করলো “স্কান”। কিন্তু যেহেতু অমৃতা ও মির্চার কোন ‘ডিএনএ’ sample রক্ষিত ছিলনা ৩০২১’র ‘হিউমান প্রডাকশন ল্যাবে’। তাই কয়েক হাজার রোমানিয়ান ‘মির্চা এলিয়াদ’ ও কোলকাতার হাজারো ‘অমৃতা’ নামীয় ডিএনএ-তে ভরে গেল ল্যাবের রক্ষণাধারগুলো। হাজার হাজার সংগৃহীত ‘ডিএনএ’ থেকে নমুনা নিয়ে ‘স্টেমসেল’ তৈরি করলো ৩০২১’র রোবটিক জিন বিজ্ঞানীরা অক্লান্তভাবে। এবং নমুনা হিসেবে ‘স্টেমসেল’গুলো থেকে পরবর্তীতে রূপান্তরিত মানুষের চেহারা পরিপূর্ণরূপে কেমন হবে, তা আগাম বিশ্লেষণ করলো ‘ফিউচার সায়েন্স’ বিজ্ঞানীরা বিশেষ কম্পিউটারে। প্রায় ৫-৬ হাজার নির্বাচিত ফিউচার মানবের চেহারা থেকে কেবল ২০২১-এ ‘নেটে’ দেখা মির্চা ও অমৃতার ছবির ধূসর স্মৃতি থেকে নির্বাচন করলাম আমি মির্চা আর অমৃতাকে। এবং চূড়ান্ত ‘স্টেমসেল’ চলে গেলো ল্যাবে ১৯৩০’র মির্চা এলিয়াদ ও অমৃতাকে বানাতে।

একটা নতুন সমস্যা দেখা দিলো। ২০২১-পূর্ববর্তী পৃথিবীতে কোন মানুষ ককেসীয়, আবার কেউ ছিল ঘুচঘুচে নিগ্রো; কেউ লম্বা সাড়ে ছ’ফুট, কেউবা ছিল বেটে ৩-ফুট; কেউ সুন্দরি ঐশ্বরিয়া – লেডি গাগার মতো, আবার কেউ কুৎসিত আফ্রিকার জুলু নারীর মত বেঢপ; কারো নলেজ আইনস্টাইনের মত আবার কেউবা ছিল ধর্মান্ধ তেতুল মালানা শফির মতো; ওজনে কেউবা মোটা জাপানি সুমু কুস্তিগিরদের মত, আবার কেউ ছিল শুকনো কলকাতার কাঞ্চনের মত; কেউ হাই-সেক্সের কেউবা সেক্স-হীন হিজড়া। ২০২১ সাল পুর্ববর্তী পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরা, যা মূলত হাস্যকরভাবে বিশেষ “গড” সৃষ্ট বলে মনে করতো ও মেনে নিতো নিজের ‘ভাগ্য’ বলে। কেবল দু’চারজনে যারা এ হাস্যকর ‘গডে’ অবিশ্বাস করতো, তাদেরকে তুচ্ছতরভাবে ঐ সময়ের অধিকাংশ গড-নির্ভর মানুষ “নাস্তিক” ইত্যাদি বলতো, যেন তারা কত জ্ঞানী! আসলে তখন অজ্ঞরাই নিজেদের “জ্ঞানী” মনে করতো, আর জ্ঞানীদের বলতো নির্বোধ!

এসব বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ আর গবেষণায় ৩০২১ সনের মানুষেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ঐ সময়ের মানুষের উচ্চতা, মেধা, গায়ের রং, চেহারা, সেক্স ইত্যাদি সবার প্রায় একই থাকবে। সর্বোচ্চ ১০% এর বেশি পার্থক্য থাকবে না মানুষে মানুষে। যে কারণে রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক বিভাজনহীন ৩০২১-র মানুষ এ নীতি গ্রহণ করে যে, প্রত্যেকটি পুরুষ ও নারীর ক্লোনকালীন বয়স হবে ২৫-বছর, উচ্চতা হবে ৬-ফিট, গায়ের রং সবার তামাটে ফর্সা, চুলের রং কালো, মেধা ৯৯-১০০ ইউনিট, প্রত্যেকটি মানুষ তৈরি হবে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসমুক্ত, ক্লোনের আগে প্রত্যেকটি মানুষ হবে “স্কানকৃত রোগশোকের জিনমুক্ত”, যাতে তারা কখনো বুড়িয়ে যাবেনা, ক্লান্তি অনুভব করবেনা কিংবা মৃত্যুবরণ করবেনা। ঐ সময়ের পৃথিবীর সকল নাগরিকই ছিল আসলে ২৫-বছরের তরুণ-তরুণীর মত সবাই। কোন শিশু, বৃদ্ধ, অুসুস্থ্য, বিকলাঙ্গ, হিজড়া একজনও ছিলনা ৩০২১-র পুরো পৃথিবীতে। প্রায় হাজার বছরের মানুষের ঐসব সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণে ৩০২১-সনের পৃথিবীর একমাত্র ‘হিউমান প্রডাকশন ল্যাবটি’তে মানুষের ক্লোন-করণে কতগুলো নির্ধারিত নীতিমালার ‘ডিফল্ট সেটআপ’ ছিল।

আমি এবং বিশেষজ্ঞ টিমের সবাই চাইছিলাম ‘অমৃতা’ আর ‘মির্চা’ সৃষ্টি হোক একদম ১৯৩০-সনের চেহারা আর চিন্তনে। কারণ ৩০২১-সনের মানুষের মত নতুন সেটআপে তাদের ক্লোন করা হলে, পূর্বপ্রেম তারা ভুলেও যেতে পারে কিংবা অন্য কোন নাটকীয়তা ঘটতে পারে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, একদম ১৯৩০’র আবহে ক্লোন হবে মির্চা আর অমৃতার। রোবটিক জিন বিজ্ঞানীর নির্দেশনামত তড়িৎ ‘চেঞ্জ’ করলো তাদের ল্যাবের প্রাক-সেটিংগুলো।

বিশেষজ্ঞ কমিটির ‘ট’কে বললাম – “অমৃতা-মির্চার নাটকীয় মিলন দৃশ্যটি আরো অনুপম হবে, যদি ঐ সময় অমৃতার সাথে উপস্থিত থাকে তার ছোটবোন ‘সাবি’। কারণ অমৃতা-মির্চার নিষিদ্ধ প্রেম কাহিনি মানসিক অসুস্থ্য ‘সাবি’ই বলে দিয়েছিল তার মা-বাবাকে, এর পরিণতি না বুঝেই”। এবং এ বিয়োগান্তক ঘটনার কদিন পরই শোঁক, দু:খ আর অনুশোচনায় মারা গিয়েছিল ‘সাবি’। মরার আগে অমৃতা যখন সাবিকে বলেছিল – “কি করলি সাবি, এ কি করলি”? কিশোরি এই মেয়েটি তখন কেঁদে কেঁদে বলছিল – “বুঝতে পারিনি ইউক্লিডদা! বুঝতে পারিনি তোমার এতো কষ্ট হবে, দিদির এত কষ্ট হবে”! এবং সিদ্ধান্ত হলো ‘সাবি’র ক্লোনও তৈরি করা হবে ওদের সাথে। স্থাপিত হবে ঐ নাট্য-সন্ধিক্ষণে!

ভূ-বিজ্ঞানীদের ডেকে বলা হলো, ঐ সময়ের কোলকাতার ভবানিপুরের ড. সেনের বাড়িটার সঠিক ‘অক্ষাংশ-দ্রাঘিমা’ বের করতে। সাথে হিমালয় সন্নিহিত ব্র্রহ্মপুরী অরণ্য, ঋষিকেশের পাশের ‘স্বর্গাশ্রমের’ পাহাড়ি গুহা। অত্যাধুনিক ‘এক্সরে স্যাটেলাইট’ দিয়ে স্কান করে বর্ণিত দুটো স্পটের নিখুঁত স্পট বের করলো সয়েল ইঞ্জিনিয়ারা। আবার দেখা দিলো নতুন সমস্যা। দুটো স্পটেই তখন ৩০২১ সনের মানুষের অত্যাধুনিক ‘কাপল-হাউস’ বানানো। বহুতল ভবনে মানুষের নানাবিধ সমস্যার কারণে ৩০২১ সালের মানুষেরা ছোট ছোট ‘ট্রান্সপারেন্ট বাড়ি’ বানিয়েছিল পুরো বিশ্বময়। একই ধাচের যার প্রতিটিতে দুজন অমর নারী-পুরুষ বসবাস করার জন্যে। কিন্তু দেখা গেলো ঐ “কাপল-হাউস” বানাতে গিয়ে অমৃতাদের পুরণো ভবানীপুরের দ্বিতল বাড়ি ও ‘স্বর্গাশ্রমের’ পাহাড়ি গুহা সবই এক হয়ে গেছে। মানে দুটো এলাকাই এখন সমতল এবং প্রতি ২০০-মিটার পর-পর একটা করে ছোট ‘কাপল-হাউজ’ বানানো, যার চারদিকে ফুলবাগান আর সবুজ বনানী। যেন ২০২১ সাল পূর্ববর্তী ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ যেমন ‘স্বর্গ’ কল্পনা করতো, তার চেয়েও মানুষ নির্মিত এ পৃথিবী এক ডিগ্রি ওপরে! সব ঘটনা জানার পর প্রাক্তন ভবানীপুর ও স্বর্গাশ্রম এলাকার কাপল-হাউসগুলো সরিয়ে নেয়া হলো। মাত্র একদিনের মধ্যে আর্কিওলজিস্টরা নির্মাণ করলো ১৯৩০-সনের ভবানীপুর এলাকা ও সেখানে ড. সেনের ইট-সুরকির সেই পুরনো দ্বিতল বাড়ি। ৩০-এর দশকের গ্যাস-ল্যাম্পগুলো দেখে বোঝার উপায় রইলোনা, এ বাড়ি ৩০২১-সনের বাস্তকারগণ এইমাত্র বানিয়েছেন। বাড়িতে মেয়েদের পোশাক, দার্জিলিং থেকে আনা মির্চার ‘কিউরিও’-গুলোর একটা অনুমানভিত্তিক মোটামুটি নিখুঁত বর্ণনার প্রেক্ষিতে রোবটেরা তৈরি করলো। যেমনটা ত্রিশোত্তর কলকাতায় সিনেমা-নাটকের ‘সেট’ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে বানানো হতো স্টুডিওগুলোতে। অপর চিন্তাশীল রোবটেরা হিমালয়ের পাদদেশে ব্র্রহ্মপুরী অরণ্যে, ঋষিকেশের পাশেই ‘স্বর্গাশ্রম’ তৈরি করলো ঠিক ১৯৩০-৩১ সনের প্রেক্ষাপটে।

ওদের ৩-জনের ক্লোন মানব বের করার আগেই এ নিখুঁত ‘সেট-ব্যবস্থাপনা’ দেখে পুরো আলোড়িত হলো ৩০২১’র পৃথিবী। এমন কোন মানুষ রইলো না, যারা জানতো না এ ঘটনা। সবাই সরাসরি এ দৃশ্য নিজ চোখে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। কারণ ঐ সময়ে মানুষের দৃষ্টির প্রখরতা এমন চমকপ্রদভাবে উন্নীত হয়েছিল যে, ‘বিশেষ চশমা’র সাহায্যে তারা পৃথিবীর যে, কোন অংশ থেকে পৃথিবীর যে কোন ঘটনা বা দৃশ্য সরাসরি দেখতে পেতো। এমনকি তারা দিনে ও রাতে, সামনে ও পেছনে, ওপরে ও নিচে, দূরে ও নৈকট্যে সমভাবে দেখতে পেতো। শরীরের অভ্যন্তরাংশ দেখতে সেকেলে ‘এক্সরে’ বা ‘আলট্রাসনো’ ব্যবহার করতে হতেনা ২০২১-পূর্ববর্তী মানুষের মতো। সাধারণ চোখেই প্রত্যেক মানুষের দৃষ্টি ঢুকতে পারতো যে কোন কিছুর অভ্যন্তরে। অবশ্য সবার তা ‘হাইড’ করার ক্ষমতাও ছিল, যদি কেউ চাইতো গোপন রাখতে। ২০২১’র মত টিভিতে রেকর্ড করা পুরণো ঘটনা দেখতে হতোনা তাদের সারাক্ষণ!

১৮ সেপ্টেম্বর ৩০২১-তে অমৃতা-মির্চার নাটকীয় সৃষ্টি পৃথিবীর সব মানুষ দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রইলো। কারণ ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ ছিল তাদের শেষ বিদায়ের দিনক্ষণ! এবং পরিকল্পনা অনুসারে স্থাপন করা হবে ১৯৩০’র হিন্দুস্থানী ১৬-বছরের তরুণির পোশাকে অমৃতাকে তার ভবানিপুরের শোয়ার ঘরের বারান্দায়, একইভাবে ‘স্বর্গাশ্রমে’র পাহাড়ি গুহায় ছাইমাখা জটাধারী কমণ্ডলুক সন্যাসিরূপী ‘মির্চা’কে। পুরো দৃশ্যটি আরো জীবন্ত ও বাস্তবভিত্তিক করার জন্যে ভবানিপুরের বাড়িতে বাবা ড. সেন, মা মাধুরী রায়সহ অন্যান্য জীবন্ত চরিত্রগুলোর রোবটিক অবয়ব স্থাপন করা হলো, যাতে অমৃতা আর মির্চা সেই ১৯৩০ সনের পরিপূর্ণ জীবনে ফিরে যেতে পারে। সকল কবি ও অ-কবিরা জীবনের এক প্রণব প্রতিধ্বনির গান এবং সুরের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলো পরবর্তী মির্চা অমৃতা নাটক দেখতে!

নির্বিঘ্নে ক্লোন ল্যাবের প্রাক ২০২১-সনীয় মাতৃজঠরের অনুরূপ ‘womb’ থেকে ষোড়শী ‘অমৃতা’, কুড়ি বছরের ‘মির্চা’ আর এগারো বছরের ‘সাবি’কে বের করা হলো একদম ত্রিশ শতকের অবয়বে। উপন্যাসের বর্ণনা মতো তাদের জন্য ভারতীয় ঐ সময়ের পোশাক তৈরি করা হলো বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। জটাধারী মির্চার জন্যে ছাই ধুপ-ধুনোমাখা জলপাত্রের মৃন্ময় ‘কমণ্ডলু’ তৈরি শেষে চুলকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জটে রূপান্তর করতে সমল লাগলো না বেশিক্ষণ টেকনিশিয়ানদের। কিন্তু পুরো নাটকীয়তা দেখার জন্যে, ক্লোন প্রক্রিয়ায় ওদের ‘ব্রেন’কে নিষ্ক্রিয় রাখা হলো। বিশেষজ্ঞ টিম ঠিক করলো যথাযথ প্রতিস্থাপনের সকল প্রক্রিয়া পুরো সম্পন্নের পরই, ক্রমান্বয়ে তাদের ব্রেনের ‘মেমব্রেনগুলো’ সচল করা হবে। এবং পরিকল্পনা মতো ভবানিপুরের বাড়ির দ্বিতল বারান্দায় অমৃতাকে, তার অদূরে ছোটবোন সাবিকে, লাইব্রেরিসহ ঘরের অন্যত্র মা, বাবা, খোকা, আরাধনা, শান্তি, লীলার সচল রোবটগুলোকে প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ হলো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। মির্চার বইরের বর্ণনা দেখে নিখুঁত দক্ষতায় তৈরি করা হলো ড. সেনের বেঢপ মেদভুড়ীবহুল পেটওয়ালা, থ্যাবড়ানো নাক, কালচে চেহারার রোবট, আর মিসেস সেনের সিঁদুর কপালে ভারতীয় পৌরাণিক নারীর জীবন্ত চেহারা। বোঝার উপায় রইলো না যে, এটা ৩০২১-সনের কোনো এলাকা। সবাই একবাক্যে বললো, “হ্যা একদমই বিশ শতকীয় মধ্যযুগ বা প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মতই সেট নির্মিত হয়েছে”।

বিশেষজ্ঞ টিম দুভাগ হয়ে এক গ্রুপ রইলো ভবানীপুরে অমৃতার বাড়িতে, অন্যদল গেলো ফতেপুর সিক্রির মৃত্যুপুরীর কাছে হিমালয়ের আলমোড়া অঞ্চলে চেস্টনাট আর ঘন পাইনের বনে। যেখানে সন্ন্যাস জীবনে জঙ্গলের পরিত্যক্ত গুহাতে প্রতিস্থাপিত হবে নতুন ক্লোনকৃত মির্চা। দু’টিমের কাজ মূলত প্রায় একই। দেহ প্রতিস্থাপনের পর ক্রমান্বয়ে তাদের ব্রেনগুলো সচল করা হবে, যাতে একদম ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ এর আবহে ফিরে যেতে পারে তারা ক্রমান্বয়ে জীবন গভীরতায়। সব নিঁখুতভাবে সম্পন্ন হলো। পুরো পৃথিবীর মানুষের চোখ তখন কোলকাতার ভবানীপুর, আর ব্র্রহ্মপুরী অরণ্যের ঋষিকেশের স্বর্গাশ্রমের দিকে। কলকাতা থেকে পৃথিবীর অপরপিঠের মানে আমেরিকা মহাদেশ, বাহামা, ক্যারিবিয়ান, হাওয়াই, গ্রিনল্যান্ড, ওসেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষেরা রাতের এ দৃশ্য দেখার জন্যে তাদের চোখেের ‘নাইট-ভিউ’ লেন্সগুলো পুরো সচল করলো। বলতে গেলে পৃথিবীর সকল মানুষের দৃষ্টিই তখন কোলকাতা তথা ভারতের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে সব কাজকাম ফেলে।

অবশেষে ‘কাউন্ট-ডাউন’ শেষে সে ‘মাহিদ্রক্ষণ’টি এসে গেলো। ভবানীপুরের টিম ক্রমান্বয়ে সচল করতে থাকলো অমৃতার স্মৃতিগুলো। এতোক্ষণ পাষাণ অহল্যারূপী অমৃতা ক্রমে ভবানিপুরের নিজ বাড়িতে মার ডাকা ‘রু’তে স্নাত হতে থাকলো ওর বোধগুলো। ধীর লয়ে তাকাতে থাকলো সে চারদিকে। সাবির দিকে চোখ পড়তেই একটু বিব্রত হলো ‘রু’। লাইব্রেরি বারান্দায় দাঁড়ানো মায়ের রোবটটি প্রথমেই একদম মায়ের স্বরে ‘রু’ বলে ডেকে উঠলো, যেন সে জানতে চাইছে অমৃতা কি করছে ঠিক এ মূহূর্তে? ড. সেনের প্রক্সি রোবট জানতে চাইলো কিছুটা গলার স্বর উঁচু করে অমৃতার কাছে, “মির্চা কি ঘরে না কোথায় গেছে দেখতো মা একটু”! অন্য রোবটগুলো ১৯৩০’র শব্দগুলো উচ্চারণ করে যথাযথ আবহে পরিপূর্ণ করতে চাইলো পুরো দৃশ্যপট। এসব শব্দ আবহে ক্রমান্বয়ে বাস্তবতায় ফিরতে ক’মিনিট লাগলো মাত্র অমৃতার। সাবির দিকে চেয়ে প্রথম কথা কইলো সে – “সাবি! মার কি মনে নেই যে, একটু আগে সে বাবার নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছিল মির্চা আর আমাকে? মির্চা কি এখনো আছে নিচে! সে কি চলে যায়নি”?
সাবিও মনে করতে পারছিলো কিছু সদ্য ফিরে পাওয়া অবোধ শিশুর বোধের মত সুপ্ত চিন্তনে। অষ্পষ্ট স্বরে কইলো, “আমার কিছু মনে পড়ছে না দিদি। সম্ভবত ইউক্লিডদা তার ঘরে এখনো আছে”। ডাকবাক্সের পাশ দিয়ে অমৃতা উঠে গেলো মির্চার ঘরে। কিন্তু মির্চার সখের ‘কিউরিও’গুলো ছাড়া কিছু দেখলো না সে ওখানে। স্বর যথাসম্ভব উচুঁ করে ডাক দিলো সে মির্চাকে। বিস্ময়করভাবে ঐ ডাক পৌছেঁ গেল তখন মির্চার ঋষিকেশের স্বর্গাশ্রমে।

ঋষিকেশের গুহাতে যে টিমটি কাজ করছিল তারা তাদের নিজের চোখেই স্পষ্ট দেখছিল ভবানীপুরের বাড়ির পুরো চিত্রটি। যেমন নজরে ছিল ভবানীপুরের টিমটির ঋষিকেশের মির্চার প্রতি। মির্চা গুহা অভ্যন্তরে আকস্মিক ধ্যানমগ্নতার ভেতরে অমৃতার ডাক শুনলো সুষ্পষ্টরূপে। দুই টিমের বিশেষজ্ঞরা তাদের বোধ, আর দেখার চোখটি ত্রিশ শতকের মত রাখলেও, শোনার ব্যাপার কিছুটা সময়ের জন্যে উন্নীত করে দিলো ৩০২১-সালের মানুষের মতই।

– “কই তুমি অমৃতা! তুমি কি স্বর্গাশ্রমে এসেছো”?
– “কই তুমি মির্চা! তুমি কি আমাদের বাড়ি ছেড়ে সত্যি চলে গেছো”?
– “হ্যা, তাতো কবেই! তোমার কি একদিনও মনে পড়েনি অমৃতা আমার কথা”?
– “প্রতিক্ষণে! প্রতি মুহূর্তে তোমারই ধ্যান করেছি আমার এ কষ্টবাতাসের সন্ন্যাস জীবনে। কিন্তু তোমার বাবা তো প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন

আমায়, আর যেন দেখা না করি তোমার সাথে এ জীবনে কখনো”!
“অমৃতা! অমৃর্তা! অমৃতা! তা কি মনে নেই তোমার”?

আকস্মিক রোবটিক বাবার জোরালো কণ্ঠ শুনতে পেলো মির্চা-অমৃতা দুজনেই। – “তোমার প্রতিজ্ঞা আমি তুলে নিলাম মির্চা। তুমি সন্ন্যাস জীবন ছেড়ে চলে এসো বাড়িতে”!
কিছুৃ বুঝতে পারেনা অমৃতা কি হচ্ছে। মায়ের কাছে দৌঁড়ে যেতে চায় সে। ডেকেও খুঁজে পায়না মাকে কোথাও। ডাকে – “মা! মাগো কই তুমি”? বাবা কি সত্যি বলছে এসব! বাবা! কই তুমি” !
পাশের ঘর থেকে মায়ের শব্দ ভাসে, “হ্যা। ডেকে আন মির্চাকে কিংবা চলে যা তার কাছে তুই”!
সব শুনে খিলখিলিয়ে হাসে সাবি। একমুঠো ভাললাগা সুখবাতাসের উড়ে চলা দুরন্ত মেঘডাকের মত সে ডাকতে থাকে তার ‘ইউক্লিডদা’কে। বলে

– “ক্ষমা করে দাও আমায় ইউক্লিডদা, ক্ষমা করো রু-দি! ফিরে এসো তুমি দিদির কাছে ইউক্লিড”! আর কখনো বলবো না তোমাদের প্রেমের কথা কাউকে আমি”!

এক শুক্লা-পক্ষের রাতের চাঁদের ক্ষীণ আলোতে মির্চা হাওড়া থেকে সোজা বেলুড়-মঠ ছেড়ে হেঁটে-হেঁটে অনেক মাঠ পেরিয়ে পৌঁছেছিল এ অজানা গন্তব্যে। অমৃতার অস্তিত্বের অনুভবে অনেক গ্রামের মেঠোপথ পেরিয়ে নৈনিতাল, কথ, বনবিথী, বর্ধমানের নৈকট্যের হল্ট স্টেশন ছেড়ে বনের টিলায় উঠে শুভ্র নির্ঝর ঝর্ণার শব্দে ডাক দিয়েছিল অমৃতার নাম ধরে অনেকদিন, অনেকবার! এক অবোধ্য ঘোরের মধ্যে মির্চা সুষ্পষ্ট শোনে অমৃতা, সাবি, ড. সেন ও মায়ের কণ্ঠ। এক সময় গুহা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। এবং হাঁটতে শুরু করে ভবানীপুরের দিকে। যেখানে অপেক্ষা করছে তার অমৃতা। সাবি আকস্মিক বলে ওঠে অমৃতাকে, “দিদি আমরা কি গঙ্গার ধারে যাবো? সেখানে অবশ্যই পাবো ইউক্লিডদাকে। আমি জানি কোথায় গঙ্গাতীরে পা ডুবিয়ে বসে থাকে সে”!

হ্যাঁ একবার মির্চা বলেছিল –

“একদিন আসবে। সেখানে গঙ্গার তীরে, আমার সত্যরূপ তোমাকে দেখাবো I will show you my real self on the shores of the Ganges.”।

গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার ‘সাবি’র প্রস্তাব কেন যেন অমোঘ সত্যের মত মনে হয় অমৃতার কাছে। বলে – “চল সাবি, আমরা গঙ্গার ঘাটে যাই”! রোবটগুলো ওদের মনের ভাষা আগাম বুঝে তৈরি করে রাখে ত্রিশ শতকের গঙ্গার পথঘাট। সে পথে হাঁটতে থাকে সাবি, হাঁটতে থাকে অমৃতা। সন্ধ্যা নামে গঙ্গাতীরে পৌঁছতে দুবোনের। সন্ধ্যা নামে মির্চারও গঙ্গাতীরে ফিরতে। কে যেন তাকে টেনে নিতে থাকে গঙ্গার সেই পরিচিত গাছ-গাছালি ঘেরা জলসিঁড়ির ঘাটে, সেখানে প্রতিনিয়ত বসতো তারা বৈকালিক গোধূলী-লগ্নে। অমৃতা বিচ্ছেদের কাল্পান্তরে পুড়তে পুড়তে কয়লা হওয়া হৃদয়টা ধুতে নামে গঙ্গার পবিত্র জলে এবার। কষ্টজীবনের অহোরাত্রির রক্তস্নানে ভেসে-ভেসে মির্চা সত্যিই পৌঁছে যায় গঙ্গার সেই পরিচিত পুরনো ঘাটে, যেখানে সাবি আর অমৃতা ভরা চাঁদজ্যোৎস্নায় গঙ্গাস্রোতের দিকে তাকিয়েছিল দূর-নিরীক্ষণে। ড. সেনের রূঢ়তার দহনে মূঢ় মানবিক বোধ আর মৃত প্রেমিকার শবদাহের যন্ত্রণা ঝেড়ে সত্যিই অমৃতার সামনে দাঁড়ায় সন্ন্যাসীরূপী মির্চা। অকিঞ্চন প্রেমের অমিয়ধারা-স্রোতের মাঝে মির্চাকে দেখে স্থিতধি অমৃতা বলে, “সন্ন্যাস জীবন কেন বেছে নিলে মির্চা? এ জীবন কি তোমায় মানায়”? স্তিমিত রক্তের দলিত লাভার মত মির্চা বলে – “তোমার বাবাইতো আমায় সন্ন্যাস জীবন দিয়েছে অমৃতা”।

রূপোলি জ্যোৎস্নাজলের চাঁদোয়া আলোতে এবার ৩০২১-র চেতনায় উদ্ভাসিত হয় অমৃতা এবং জেগে ওঠে মির্চা। খরায় শুকিয়ে ওঠা ফাটা জমির মত চৌচির হওয়া অমৃতা বলে – “মির্চা তুমি একটা উপন্যাস লিখেছিলে আমায় নিয়ে সেই ১৯৩৩-এ। তাতে অনেক মিথ্যে ভাষণ ছিল তোমার তাইনা”? স্পর্ধিত পাহাড় বেয়ে ঝরেপরা ঝর্ণাস্রোতের মত দৃঢ়তায় বলে মির্চা – “না আমার সব কথাইতো সত্যি ছিল, মিথ্যে বলিনি আমি”!

– “ঐ যে তুমি প্রথম বললে আমার মা-বাবা তোমার কাছে বিয়ে দিতে আমাদের ঘরে নিয়েছিল তোমায় । সেটাতো মিথ্যে ছিলো”।
– “আর” ?
“সাবি যে রাতে অসুস্থ্য হলো খুব, সে রাতে নাকি ‘নিরাবরণ’ হয়েছিলাম আমি তোমার কক্ষে গিয়ে? আমার নগ্নদেহ দেখিয়েছিলাম তোমায়? আমার ভার্জিনিটি ভাঙতে আহবান করেছিলাম নিজে? এসব কি মিথ্যে নয়”?
মাথা নাড়লো মির্চা। বললো – “মিথ্যে কেন হবে”?
– “তুমি পবিত্র গঙ্গার বহমান জলে নেমে শপথ করে বলো, এসব কথা সত্যি ছিল”?

সত্যি এবার জলে নামলো দৃঢ়চেতা মির্চা। প্রথমে হাঁটুজলে, তারপর গলাজলে নামলো সে। এবং জলে ভিজে দৃঢ়তায় বললো – “আমি গঙ্গার নামে শপথ করে বলছি, আমার উপন্যাসে অমৃতার সাথে যে শারিরীক সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছি তা সত্যি ছিল”!
আকস্মিক গঙ্গাতে একটা ডুব দিলো মির্চা। এবং অনেকক্ষণ পর যখন জল থেকে উপরে উঠলো সে, তখন তার কুৎসিত কদাকার চেহারায় বিস্মিত হলো অমৃতা, বিস্মিত হলো সাবি। সাবি চিৎকার দিলো আতঙ্কে ওর গায়ের রঙ আর শারীরী কদর্যতা দেখে।

এই প্রথম কাছাকাছি দৌঁড়ে এলো বিশেষজ্ঞ টিমের সবাই। এলো সংশ্লিষ্ট আরো মানুষজন, যারা কাছাকাছি ছিল। এলাম আমি নিজেও। ওরা সবাই বললো – “মিথ্যে বলছে মির্চা। ৩০২১-র পৃথিবীতে মিথ্যে বলতে পারেনা কেউ। বলা মাত্রই তার চেহারা পাল্টে যায়। কুৎসিত কালো হয় মিথ্যে বলার কারণে। এমনই ‘প্রোগ্রাম’ সেটাপ করা আছে পুরো পৃথিবীর সব জল বাতাসে”।
এবার ঘাবড়ে যায় মির্চা। এমন পরিণতিতে ব্যথিত হয় সবাই। আমি জানতে চাই বিশেষজ্ঞ টিমের কাছে – “এর কি কোন প্রতিকার নেই”?
টিম সদস্য ‘জ’ বলে – “সে অনুতপ্ত হয়ে বহমান গঙ্গায় নেমে আবার সত্যিটা বললে, তার পূর্বরূপ ফিরে পাবে সে, তবে একবার মিথ্যে বলেছিল চেহারায় এমন একটা চিহ্ন থাকবে তার আজীবন! তাই করতে রাজি হয় মির্চা। এবং সত্যিটা বলে ২য় ডুবে ফিরে পায় সে তার পূর্বরূপ। ২৩-বছরের ককেসীয় মির্চা ইউক্লিড দাঁড়ায় ষোড়শী অমৃতার সামনে এবার‍!

এবার হাসে ‘অমৃতা’। হাসে ‘সাবি’। হাসে পুরো পৃথিবী। এ নাটকীয়তা পর্যবেক্ষণে করতালিতে জেগে ওঠে পুরো বিশ্বের মানুষ। যে সত্যের জন্যে অমৃতারূপী মৈত্রেয়ী দেবী জীবনে যুদ্ধ করেছিল অনেক বার, প্রাক্তন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত গিয়েছিল অমৃতা তার নামে মিথ্যাচারে ভরা The Bengal Night ছবির প্রদর্শনী বন্ধ রাখতে। সে সত্যিটা আজ প্রকাশিত হলো ৩০২১’র পৃথিবীর কোটি-কোটি মানুষের সামনে, এ সত্য-মিথ্যা নির্ণায়ক ক্লেদহীন ভালবাসাময় পৃথিবীতে!

হাত ধরতে চাইলো মির্চা অমৃতার। চোখ ভিজিয়ে বললো – “অমৃতা ক্ষমা করো তুমি আমায়। তোমার বাবার দেয়া আঘাতে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে মাত্র ২৩-বছর বয়সে এক মিথ্যেভরা প্রেম কাহিনিতে পুরো বিশ্বকে ভুল বুঝিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এটাতো মিথ্যে নয় যে, তোমাকে সত্যি ভালবাসি আমি এবং এখনো”!
মির্চার বন্ধু সেবাস্টিন সেরগেই তার বাড়িতে সাক্ষাতে একদিন বলেছিল – “প্রেমের মধ্যে অমরতা থাকে, মির্চা সেই অমরতায় ফিরে আসবে”! এ কথাই হয়তো ডি প্রফান্ডিস তার কবিতায় বলেছিলেন এভাবে – “Where all that was to be in all that was”!

– “তাই কি মির্চা! তাই কি সত্যি ছিল জীবনে”?
চলার পথের অমিত প্রগলভতায় ভিজে যায় পুরো বোধ অমৃতার। প্রাক্তন ভালবাসাময় জীবনের অনিদ্রার গানে ভেসে-ভেসে ওর হৃদয় নেচে ওঠে আবার পুরণো দিনে। চোখ ভিজিয়ে বলে –
– “মির্চা, জ্যোতিষী আমায় বলেছিল, আমি সমুদ্র পার হবো। সারাজীবন যার অপেক্ষা করেছি, তার সাথে দেখা হবে আমার! সে জ্যোতিষ কিভাবে জানতো, এ গঙ্গাতীরে সত্যভাষণ শেষে তুমি দাঁড়াবে আমার পাশে এ গঙ্গা সুমদ্রে”!
– “এই কি এসেছে সে সত্যদিন! last of life for which the first was made —” !
মহাকালের কারাগার ভেঙে মির্চার সাথে একদিন যেতে চেয়েছিল অমৃতা। যে মহাকালের আদি নেই, মধ্য নেই, অন্ত নেই। সে মহাকাল দেখছে অমৃতা আজ। ক্ষণিক প্রবাহিত জীবনের আনন্দ স্রোতস্বিনী নদী সপ্তবর্ণা মেঘ হলো এবার দূর আকাশে। তাইতো মির্চাকে পেতে বলেছিল একদিন অমৃতা
– “মহাকাল তার জটার বাঁধন খুলে নিয়ে যাবে তাকে মির্চার কাছে। লজ্জা, ভয়, স্বজনের বন্ধন ঝেড়ে কালজয়ী প্রেম তার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে নীলাকাশে ধ্রুবতারার মত মহাসমুদ্র পার করে নেবেই তাকে একদিন”।
উডল্যান্ডে মির্চাকে খুঁজতে গিয়েছিল একদিন অমৃতা। গঙ্গাতীরের এ বৃক্ষবাতাস আর বনশ্রেণির হাতনাড়া কি সেই উডল্যান্ড! শার্লি নামের মেয়েটিও একবার অমৃতাকে দেখিয়েছিল মির্চার কক্ষ। ‘সাবি’ কি আসলে সেই শার্লি!
– “বিয়াল্লিশ বছর কি বড় সময় মির্চা! হাজার বছর কি বড় কিছু এ জীবনে? দেখো পৃথিবীটা কত দিনের পুরনো। এ চাঁদ সূর্যের বয়সও কি কম মির্চা? হাজার বছরটা আসলে কি খুব বড় মির্চা”!

শীর্ণ গিরিপথে সারারাত জেগে থাকা কষ্টবাতাসে ভর করে অবশেষে মির্চার দিকে হাত বাড়ায় অমৃতা। ১৯৩০ সালের নিষ্পলক নারীর অসূয়া বুকের সুখ স্মৃতির মত মির্চার হাত ধরে সত্যি সত্যি অমৃতা। এবং ভালবাসার পরম আশ্রয়ে অবশেষে হাতে হাত রাখে তারা, যার সাক্ষী থাকে বিশ্বের সকল সজাগ মানুষের চোখ!

এবার আকস্মিক মহাশূন্য থেকে জাদুকরের মত সেই সাইনবোর্ডটা শূন্যতায় দৃশ্যমান হয়। যাতে লেজার ঝিলিকে ভেসে উঠতে থাকে প্রথমে মির্চার ছবিতে – “… Tomar Ki moné acché ? …. Yadi thaké, taholé Ki, Kshama Karté Paro ? ….” অমৃতার ছবিতে
– “অজস্র মণিমুক্তা সজ্জিত সুবর্ণ দেবতার মত, অপার অসীম সুষমায় আমি তোমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণতা হই, আর তুমি আমাকে বুকে তুলে নাও”। এবং শেষে –

“আমি তো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি, যাকে Weapon cannot pierce, fire cannot burn… সংস্কৃতিতে বললে – ‘ন হন্যতে হন্য মানে শরীরে-” এবং সব শেষে পুরো বিশ্বময় করতালিতে সবাই পাঠ করে –
“শুভতা মির্চা ইউক্লিড! শুভতা মৈত্রেয়ী দেবী। ৩০২১’র পৃথিবীতে স্বাগতম তোমাদের। এ বিশ্বে চিরন্তন তোমরা। তোমাদের “লাভ কাপল হাউস” সেই ভবানীপুরের পুরণো বাড়িতেই। আজ তোমাদের মধুচন্দ্রিমার রাত। যে রাতের নামটিই হচ্ছে “The Bengal Night 3021”.

কাহিনি এখানেই শেষ হয়না। মির্চার মিথ্যাচারের জন্যে একটা লঘু শাস্তি ঘোষিত হয় তার। ১৯৩০-সনের কোলকাতার হাতেটানা একটা ‘রিক্সা’ নিয়ে আসে রোবটেরা ওদের পাশে। যাতে যাত্রী হিসেবে বসবে অমৃতা। আর শাস্তিটা? হ্যাঁ মির্চা পুরো পথটা টেনে নিয়ে যাবে রিক্সাটা ঐ ভবানীপুরের বাড়ি পর্যন্ত। একদম খালি পায়ে ঠিক ত্রিশ সালের কলকাতার হাতেটানা রিক্সাওয়ালার মত!
মির্চা তার লালঠোঁটে হাসি এনে বললো – “তথাস্তু”!

 

জাহাঙ্গীর হোসেন
কথাসাহিত্যিক

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop