সবসময়ই আমি ভেবেছি, নাটকটি কতটা নান্দনিক হলো, কতটা নাট্যপন্ডিতদের তুষ্ট করলো তার চেয়ে নাটকটি দর্শকের কাছে কতটা বোধগম্য হলো – মামুনুর রশীদ

By Published On: May 12, 2021

সবসময়ই আমি ভেবেছি, নাটকটি কতটা নান্দনিক হলো, দর্শকের কাছে কতটা বোধগম্য হলো – মামুনুর রশীদ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ইসমত শিল্পী

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের পথিকৃৎ মামুনুর রশীদ একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের পথিকৃৎ। নাটক রচনা ও নাট্যপরিবেশনা বাংলাদেশের নাট্যজগতে মামুনুর রশিদকে একটা আলাদা স্থান করে দিয়েছে। মামুনুর রশিদের জন্ম ২৯ ফেব্রুয়ারি। লিপইয়ার হওয়ায় দিনটি ৪ বছর পরপর আসে। নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।

শ্রেণিসংগ্রাম, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের নানা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে নাটক লিখে ও নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশের নাট্যজগতে মামুনুর রশীদ হয়ে উঠেছেন অপরিহার্য। ‘ওরা কদম আলী’ থেকে শুরু করে তাঁর প্রায় সব নাটকেই মামুনুর রশীদের যে পরিচয় আমাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে তাঁর সমাজসচেতনতা। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের হাসি-কান্না নিয়ে তাঁর নাটক, শোষকের মুখোশ উন্মোচন এবং পরিশেষে বঞ্চিতেরা জোট বাঁধলেই যে সমাধান সম্ভব তার ইঙ্গিত। কাজপাগল, নাটকপাগল গুণী এ মানুষকে নিয়ে তাঁর সময়ের বা পরের প্রজন্মের নাটকের মানুষদের মূল্যায়ন নিয়ে একদিন বৃষ্টির দুপুরে অনেকটুকু সময় কথাবার্তায় কেটে যায়। সাজানো না হলেও সেসব কথাবার্তার সামান্য কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।

প্রশ্ন : ভাইয়া, নাটক নিয়েই শুরু করি। নাটক রচনা, নির্দেশনা, পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই আপনার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে, শ্রেণিসংগ্রাম, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নাট্যজগতে আপনার একটা আলাদা স্থান গড়ে উঠেছে। আপনার এই আলাদা হয়ে ওঠার পেছনে কারণ কী?

উত্তর : হুম, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আলাদা হয়ে ওঠার কারণ। আমি সবসময়ই বলতে মানুষের কথা চাই। সবসময়ই আমি ভেবেছি, নাটকটি কতটা নান্দনিক হলো, কতটা নাট্যপণ্ডিতদের তুষ্ট করল তার চেয়ে নাটকটি দর্শকের কাছে কতটা বোধগম্য হতে হবে। এবং যে ইস্যুগুলো নিয়ে আমি নাটক করব সেগুলো যেন মানুষের কাজে লাগে। মানুষের কাজে যখন লাগাব তখন আমাকে প্রত্যেকটি নাটকের জন্য একাধিক বিষয় ভাবতে হয়। একটা হচ্ছে শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি; সেটা তো থাকবেই। তার পাশাপাশি আমার এই অনুসন্ধানটাও থাকতে হবে যে, নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন থেকে শুরু করে তার চরিত্র নির্মাণ এবং চরিত্র ভাবনা এগুলোও যেন জনগণের মধ্যে থেকেই জনগণের সংকট থেকেই উঠে আসে। এই ভাবনাবোধের একটা পটভূমি আছে। একসময় আমরা নাটক করতে গিয়ে মুক্ত নাটকের একটা আন্দোলন করেছিলাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন গ্রামে শুরু করি। গ্রামের মানুষ, তাদের সংকট, তাদের ভাবনা তাদের স্বপ্ন, এবং তাদের জীবনকে গভীরভাবে দেখার একটা সুযোগ পেয়েছি। এবং এটা একদিন দুদিন নয়, বছরের পর বছর আমরা করেছি। নাটক নির্বাচনের জন্য এবং নাট্যনির্মাণের জন্য একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে আমার জীবনে। আরেকটি হচ্ছে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কথা। যেটা বললে। আদিবাসীদের কথা। সেটা হচ্ছে আদিবাসীদের সঙ্গে তাঁদের সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমি জড়িত আছি। সেই চাকমাদের ওপর যখন নিপীড়ন নেমে আসে, তখন সেই লোগাং হত্যাকাণ্ড, … এইগুলোকে নিয়ে আমরা ঢাকা শহরে রীতিমতো আন্দোলন করেছি। তারপর অনেক চাকমা গ্রামে যাবার সুযোগ হয়েছে। গাঢ়ো গ্রামে, সাঁওতাল গ্রামে যাবার সুযোগ হয়েছে। এবং এই সুযোগের মধ্য দিয়ে তাঁদের সংগীত, তাঁদের নৃত্য, তাঁদের জীবনযাপনে, চলনে-বলনে, এটা দেখারও একটা সুযোগ হয়েছিল।

প্রশ্ন : এই যে সুযোগ, সেটা আপনি করে নিয়েছেন নাকি ওখানে গিয়েছেন বলে দেখে দেখে এসব ভাবনা মাথায় এসেছে?

উত্তর : না, না, আমি করে নিয়েছি।

প্রশ্ন : মানে সুচিন্তিতভাবেই করেছিলেন?

উত্তর : হ্যাঁ, সুচিন্তিতভাবেই। আমি আদিবাসীদের প্রশ্নে প্রথমে আড়োলিত হই মহাশ্বেতা দেবীর লেখা পড়ে। মহাশ্বেতা দেবির সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করি। তিনি একটা পত্রিকা বের করতেন ‘বর্তিকা’। এই পত্রিকাটি হচ্ছে, আদিবাসীদের লেখা নিয়ে। এবং আদিবাসীদের কাঁচা হাতের লেখা; সেগুলো উনি প্রকাশ করতেন। তো, বছরের পর বছর উনি এই কাজটা করেছেন। আমিও দেখেছি। এবং দেখে আলোড়িত হয়েছি। যে ভারতবর্ষে আদিবাসীরা কীভাবে নিগৃহীত এবং পীড়িত হচ্ছে। আমাদের দেশে আরও বেশি নিগৃহীত হচ্ছে। এবং কানাডাতে রেড ইন্ডিয়ানদের যে রিজার্ভ ফরেস্ট সেখানেও আমি গিয়েছি। সেখানেও দেখেছি, আমেরিকানরা, কানাডিয়ানরা, হোয়াইট জনগোষ্ঠী, ওখানকার আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন করে। অস্ট্রেলিয়ায় সেখানকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর নিপীড়ন করছে। অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাবঅরজিনালস ডোমিনিকান রিপাবলিক ইকোয়েডার এ সমস্ত জায়গাতেও আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। এবং বলিভিয়া এ সমস্ত জায়গাতেও আমার বন্ধুবান্ধব আছে। ইন্ডিজেনাস যাঁরা আদিবাসী, তাঁদের স্ট্রাগল বোঝার চেষ্টা করেছি, দেখেছি। সেগুলো থেকেই আমার এগুলো করার প্রেরণা। আরও যেটা হচ্ছে যে, একেবারে চোখের সামনে আমি হত্যাকাণ্ড দেখেছি যেমন, আলপ্রেইড এই স্মরণীর হত্যাকাণ্ড সামনাসামনি দেখেছি। কীভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এবং এসব থেকেই আমার মধ্যে একটা বোধ জেগেছে যে, আমাদের দেশের নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু দাঁড়াব কীভাবে? আমি তো রাজনীতি করি না! দাঁড়ানোর আমার একটাই উপায় হচ্ছে, নাটক নির্মাণ করা। শুধু যে আদিবাসীদের নিয়ে একটি নাটক করা তা নয়, আমি বেশ কয়েকটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। সাঁওতালদের নিয়ে কাজ করেছি। ওঁরাওদের নিয়ে কাজ করেছি। গাঢ়োদের নিয়ে কাজ করেছি। এবং গাঢ়ো গ্রামে গিয়ে লক্ষ করেছি, কীভাবে তারা লুণ্ঠিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। এ সবকিছু নিয়ে, এ ভাবনাগুলো নিয়ে আমার ক্ষুদ্রজাতিসত্তার নাটক করা।

আবার আমাদের মেইনস্ট্রিম যে পপুলেশন, মেইনস্ট্রিম যে বাঙালি জনগোষ্ঠী তাদেরও নানারকম সংকট আছে। এবং যে সংকটগুলো দেখবে ‘ওরা কদম আলী’ ‘ইবলিশ’-এ। আবার ‘গিনিপিগ’-এ গিয়ে আরেকটা স্তর। একেবারে উচ্চপদস্থ আমলা তাঁরাও কীভাবে তাঁদের পরিবারকে তাদের শিকড়কে কীভাবে অবজ্ঞা করে, অবহেলা করে! এবং তৃতীয় বিশ্বের বিত্তটা কোথায় যায়! তাদের টাকা-পয়সা কোথায় যায়! এই যে, আজকে আমরা যেভাবে দেখছি। আমি ‘গিনিপিগ’ নাটক লিখেছি, ১৯৮৪ সালে। তো, আজকে ’৮৪ সালের আগের থেকেও এবং তারপরেও কী পরিমাণ আমাদের দেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে! কোন পদ্ধতিতে পাচার হচ্ছে! কোন স্বপ্ন থেকে পাচার হচ্ছে! এগুলো ‘গিনিপিগ’ নাটকে যেমন আছে আবার ‘পাথর’ নাটকে মানুষকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে নিয়ে কীভাবে সেখানে শোষণ চলছে। ধর্মকে কীভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেসব চিত্র আছে। আবার, ‘সংক্রান্তি’ নাটকে একেবারেই প্রান্তিক মানুষ কৃষিকাজ করে, আবার তারা শিল্পের কাজও করে, সঙ করে সেসব চিত্র। আমার অনেক দিনের ভাবনা ছিল, তাঁদেরকে নিয়ে একটা নাটক করব, একটা সত্য ভাষণের জন্য। নাটকের যে সত্যিটা এবং সঙের যে কী সত্যি শক্তি এবং শোষককে যখন চিহ্নিত করা হয় হাজার মানুষের সামনে তখন তার পরিণতি কী ঘটে তা দেখা যায় এই নাটকটিতে। আমাদের এই উপমহাদেশে এটা দেখা গেছে যে, বহু বছর ধরে, বহু শতাদ্বী ধরে এই সমস্ত শিল্পীরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে। তারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলেছে এবং তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে যে সঙের প্রচলন আছে সেটাকে ধরার চেষ্টা করেছি। আর ‘রাড়াঙ’-এর কথা তো আগেই বলেছি। ‘রাড়াঙ’ নাটকটা কীভাবে নির্মিত হয়েছে। সবসময় আমি একটা কথা ভেবেছি, সেটা হচ্ছে আমার নাটকটা মানুষের যদি কাজে না লাগে, মানুষ যদি এই নাটক দেখে একটা কিছু মাথায় না নিয়ে বাড়ি যায় তাহলে এ নাটক করে কোনো লাভ হবে না।

প্রশ্ন : মুক্ত নাটকের কথা আপনি বললেন; বিশেষভাবে এই নাটক নিয়ে আপনি কাজ করেছেন ১৯৮৪’রও আগে থেকে। এটা তো আন্দোলনই বলা যায়! তো এই আন্দোলনের চর্চা শুরু কোন চিন্তা থেকে? কোন ভাবনা থেকে?

উত্তর : এটা হচ্ছে যে, একটা পর্যায়ে আমাদের নাটকের জায়গা ছিল ঢাকা শহর। আরও ছোট আকারে বললে মাহিলা সমিতি। তো, আমরা একবার ভাবলাম যে, এতে ছড়াচ্ছে না কিছু! তখন আমরা পথনাটক করতে শুরু করলাম। পথনাটক করতে গিয়ে দেখলাম যে, সেটারও একটা গণ্ডি আছে। সেই গণ্ডিটা শহিদ মিনার বা…এ রকম কিছু স্থান মাত্র।

প্রশ্ন : জি, বিশেষ বিশেষ স্থান ছাড়া পথনাটক তো হয় না?

উত্তর : হ্যাঁ, শহিদ মিনার বা বিশেষ বিশেষ স্থান বা বিশেষ বিশেষ দিবসে এগুলো হয়। তখন ভাবলাম, এটাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া যায় কীভাবে! পথনাটক নিয়ে গ্রামে যাওয়া যায়, গিয়েছিও। কিন্তু গ্রামের মানুষ, এই যে এক বিশাল জনগোষ্ঠী, শ্রমিক, এদেরকে কীভাবে নাটকের গণ্ডির মধ্যে নিয়ে আসা যায়! তখন আমরা ভাবলাম, এর একটাই উপায় তা হচ্ছে, আমরা যদি গ্রামে গ্রামে যাই। গিয়ে যদি আমরা কাহিনি সংগ্রহ করি এবং কাহিনি সংগ্রহ করে তাদেরকে দিয়েই যদি অভিনয় করায়, তবে! এটা প্রথমে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল; কিন্তু গ্রামে গিয়ে যখন আমরা মানুষের কাছে গল্প শুনতে চাই ‘আচ্ছা, আপনাদের সমস্যা কী?’ তখন বলে, কোনো সমস্যা নাই; সমস্যাও বলে না। মানে, এটা খুব একটা দূরতিক্রম্য বিষয় তাদেরকে দিয়ে কথা বলানো। তাদের দিয়ে যখন কথা বলানো শুরু করলাম, তখন তারা শুধু কথা বলছে তা-ই না, তারা অঙ্গভঙ্গি করে দেখাচ্ছে, ‘এইভাবে হইছিল ঘটনাটা’। তারপরে আমরা মহড়ার মধ্যে গিয়ে ইপ্রোভাইজ করি। ইমপ্রোভাইজ করে, কোনো পাণ্ডুলিপি ছাড়াই আধঘটা, চল্লিশ মিনিটের নাটক নির্মাণ করে ফেলি।

প্রশ্ন : মানে, তখন মুখে মুখে স্ক্রিপ্ট?

উত্তর : হ্যাঁ, একদম তাই। এবং এটাকেই অভিনয় করা। অভিনয় করার পরে এটার প্রতিক্রিয়াটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল। যেমন নাটকের পরে একজন এসে বলল যে, ‘আরে ভাই, এই লোকটা যে ওইভাবে কথা বলতেছে, ও তো তোতলা ছিল! ওই লোকটা ওইভাবে হাঁটে না, এইভাবে হাঁটে!’…। তার মানে টোটাল নাট্যক্রিয়ার সঙ্গে তারা ইনভলবড হয়েছে। এটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং অনেক জায়গায়ই এমনটা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা যা হলো, তা হচ্ছেÑ আমরা যারা ঢাকা থেকে যাই, যারা মধ্যবিত্ত, আমাদের তো জীবন-জীবিকা আছে। আরেকটা হলো, কোনো রাজনৈতিক শক্তি আমাদের সাহায্য করেনি। কোনো দল না, কোনো পলিটিক্যাল পার্টি না। মানে, এই কাজটা করেছি আমরা স্বৈরাচারের সময়ে। কমিউনিস্ট পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ সবাই আমাদের পক্ষে দাঁড়াতে পারত; কিন্তু নাটকগুলো হয়ে দাঁড়াচ্ছিল একেবারে শ্রেণিসংগ্রামের। অর্থাৎ লোকাল যে জোরদার, যারা দুষ্কৃতিকারী, যারা শোষক, তাদের বিরুদ্ধে আমরা বলছি। তাহলে হচ্ছে কী যে, তারা ওই সমস্ত দলের সঙ্গে যুক্ত; তারা কেউ আমাদের সাহায্য করবে না। সাহায্য না করাতে একটা হলো যেমন, আমরা যখন থাকছি গ্রামে তখন ঠিক আছে। আমরা চলে আসার পরেই গ্রামের লোকদের ওপর নিপীড়ন নেমে আসছে। দু-চারটে জায়গায় আমরা হয়তো আবার গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলছি, কাজ করছি; কিন্তু এত গ্রামে আমরা কী করে এসব করব! এরপর হলো যে, এনজিওগুলো এই মাধ্যমটাকে মনে করল খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের সঙ্গে যারা কাজ করত তাদেরকে খুব উচ্চ বেতন দিয়ে কিনে ফেলল। সবচেয়ে বেশি কিনেছিল, গণসাহায্য সংস্থা। আমাদের উত্তরবঙ্গের যে টিম, পুরো টিমটাকে তারা চাকরি না কী দিয়ে-টিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিল। তারপরেও অনেক দিন ফাইট করেছি, অনেক দিন লড়াই করেছি। কিন্তু…

প্রশ্ন : মানে ওরা কি এগুলো করতেই দেবে না, এ রকম? নাকি করতে দেবে কিন্তু…

উত্তর : না, ওরা করবে। ওরা স্যানিটাইজেশনের জন্য ব্যবহার করবে। ওদের যা যা প্রোগ্রাম আছে ওদের প্রজেক্ট হিসেবে তার সঙ্গে। কাজেই নাটক হিসেবে যে শৈল্পিক জায়গাটা তা আর থাকবে না। আমরাও একটা পর্যায়ে ভাবলাম যে, এটা না করে আমরা আবার পথনাটকে ফিরে আসি। আমরা পথনাটকে ফিরে এলাম।

প্রশ্ন : এটা তাহলে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল বা এনজিওর ভেতরে চলে গেল! তো, সেই অবস্থার প্রেক্ষিতে পথনাটকের প্রয়োজনীয়তাটা কতখানি বলে মনে হয়?

উত্তর : ওই ট্রেনিংটা নেয়া ছিল…। ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রচুর লোকজন আছে। যারা ইচ্ছে করলে পথনাটকটা করতে পারে। পরেও অনেক জায়গায় হয়। একেবারেই যে শেষ হয়ে গেছে তা নয়। এটা তো মুভমেন্ট! মুভমেন্টের একটা পরিসমাপ্তি থাকে। এই মুভমেন্টের একটা পর্যায় শেষ হয়েছে। নতুন করে এই ফর্মটা আবার অন্য কোনো রকমভাবে আসতে পারে। এটা একেবারেই বিলীন হয়নি। একেবারে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা এই কাজটা করেছি। হ্যাঁ, নিজেদের টাকা জোগাড় করে। আমি হয়তো কখনো বিদেশে গিয়েছি সেগুলো ফটোগ্রাফিতে আসছে, বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে বাঙালিরা। ওখান থেকে টাকা নিয়ে এসে এখানেও হচ্ছে। মুভমেন্টের জন্য তো টাকা লাগে। টাকা চেয়ে নিতে হয়। টাকাটা কে দেবে?

প্রশ্ন : আরেকটা প্রশ্ন করি। শ্রেণিসংগ্রাম অধিকার আদায়ের আন্দোলন নিয়ে নাটক রচনা করেছিলেন, সবগুলোই তো প্রতিবাদের। যদি এই জায়গায় না আসতেন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে কখনো কি রাজনীতিতে যেতেন? মানে, এই রকম কোনো চিন্তা ছিল?

উত্তর : রাজনীতি আমাকে কখনো টানেনি। থিয়েটারই করেছি, থিয়েটারই টেনেছে। রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি থাকার ফলে তার একটা সীমারেখা আছে।

প্রশ্ন : নিজের মতো কাজ করা যায় না…।

উত্তর : হ্যাঁ, নিজের মতো কাজ করা যায় না। সেই কারণে কখনোই কোনো পলিটিক্যাল পার্টি আমাকে টানেনি।

প্রশ্ন : মঞ্চনাটক রচনায় শ্রেণিসংগ্রাম আপনার নাটকের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। আবার টেলিভিশনের জন্য অসংখ্য নাটক লিখেছেন। এবং অভিনয়ও করেছেন। এই যে বৈচিত্র্য এটা নিয়ে আপনার অনুভূতি জানাবেন।

উত্তর : টেলিভিশনেও আমি প্রান্তিক মানুষের জন্যই লিখেছি। বড় বড় সামাজিক সমস্যা, বড় বড় ইনফর্মাল সমস্যা। এই যে আজকে সুন্দরবন নিয়ে কথা হচ্ছে, এই সুন্দরবন নিয়ে আমি বাইশ বছর আগে টিভি সিরিয়াল করেছি। সুন্দরবন কেন নষ্ট হচ্ছে, কারা নষ্ট করছে…?

প্রশ্ন : আপনি তো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন ’৭১ সালে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গেই সংযুক্ত হয়েছিলেন। একটা নাটক ছিল আপনার ‘পশ্চিমের সিড়ি’ প্রথম মনে হয়। প্রথম নাটক রচনা কি ‘পশ্চিমের সিড়ি’?

উত্তর : হ্যাঁ, সেটা মঞ্চের জন্য।

প্রশ্ন : হ্যাঁ, ওটা বোধ হয় রবীন্দ্রসদনে মঞ্চায়নের কথা ছিল। হয়নি…?

উত্তর : ওটা বাহাত্তর সালেই করেছিলাম। এখন আর করি না। স্ক্রিপ্টটাই হারিয়ে গেছে। স্ক্রিপ্টটাই খুঁজে পাচ্ছি না।

প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন করি। সাম্প্রতিক নাট্যচর্চা প্রসঙ্গে, ভালোমন্দ বা তরুণদের জন্য বা এখনকার জেনারেশনের জন্য আপনার কিছু দিকনির্দেশনা আছে? যদি বলেন…

উত্তর : এখনকার তরুণদের অনেক ভালো ভালো দিক আছে। তবে, তরুণের চাইতে যারা একটু প্রবীণ তারাই এখন নাট্যচর্চাটাকে ধরে রাখছে। কিন্তু এর নিচের বয়সে যারা, তারা নাটক করছে ঠিক; কিন্তু ওই রকমভাবে না। আমরা যখন ত্রিশের কাছে বা বিশের কোঠায় তখনও আমরা অনেক কাজ করেছি। তা, এখন ওই বয়সের কর্মীদের কাছ থেকে তেমনভাবে পাচ্ছি না।

প্রশ্ন : এটা কি মিডিয়ার প্রভাব বলা যায়?

উত্তর : হ্যাঁ, মিডিয়ার প্রভাব।

প্রশ্ন : তারকাখ্যাতি পেতে চাইছে, তাই?

উত্তর : না, তারকাখ্যাতি চাওয়া অন্যায় কিছু না। তারকাখ্যাতির জন্য এটা ছেড়ে দেয়ার দরকার নেই। তরুণরা সবচাইতে অগ্রগামী, এনার্জেটিক। তারা না-বুঝে খুব ভালো কাজ করে ফেলে কখনো কখনো; কিন্তু এখনকার তরুণদের মাঝে সেই তারুণ্যের একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যারা চল্লিশোর্ধ্ব, অনেক দিন থিয়েটারে আছে, মোটামুটি একটু ভালো কাজ করার চেষ্টা করছে। চল্লিশোর্ধ্ব, ষাটের কাছাকাছি বয়স এঁরা মঞ্চে নানারকম নাটক করছে, খেয়াল করে দেখো! সেই কাজগুলো সবই যে অসাধারণ তা না। তবে দু-একটা নাটক আছে খুব ভালো তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই; কিন্তু যেটা বড় সংকট, সেটা নাটক লেখার। যারা একটুখানি লিখতে জানে, তারা টেলিভিশনে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে ওখানে টাকা আছে। আর এইখানে তো মঞ্চে নাটক লিখে কোনো টাকা নেই, তাই না? কাজেই এখানে টাকার বিষয় কাজ করে। টাকা যেদিকে সেদিকে তো মানুষ ছুটবেই। আর যারা একেবারে কমিটেড স্ক্রিপ্ট রাইটার তারা মঞ্চে নাটক লিখছে। তো, এখন যেটা সমস্যা, তা হলো প্রবণতা কী? একটা প্রবণতা হচ্ছে যে, নাটককে খুব গ্লামারাস করতে হবে। নাটককে খুব ফানি হতে হবে এ রকম ভাবনা।

প্রশ্ন : ঠিক, এটা বর্তমানে একটা প্রবণতা…

উত্তর : হ্যাঁ, বর্তমানের প্রবণতা।

প্রশ্ন : হাততালি বেশি পেতে হবে…

উত্তর : হাততালি পেতে হবে। এটাও আছে আবার শুদ্ধ শিল্পের চর্চাও আছে। কাজেই সেই দিক থেকে উভয়ই দেখা যায়। এই যে নাটকের কত বড় বড় একটা উৎসব হচ্ছে প্রায়ই। কাজেই এগুলো যে হচ্ছে তা তো এমনিতে হচ্ছে না। কাজটা হচ্ছে বলেই তো হচ্ছে।

প্রশ্ন : তার মানে চর্চাটা এগোচ্ছে?

উত্তর : হ্যাঁ, চর্চাটা এগোচ্ছে, নাটক এগিয়ে যাবে, যাচ্ছে; কিন্তু আরেকটা সমস্যা কী-যে, নাটকে অনুশীলনটা কম। চর্চা বলতে যেটা, চর্চার দিকটা কম হচ্ছে। নাটকের সঙ্গে আবৃত্তি, পারফর্মিং আর্ট যেখানে, সেখানে চর্চার দিকটা অবশ্যই থাকতে হবে। চর্চাটা জরুরি।

প্রশ্ন : মানে কবিতা নাটক সংগীত একসঙ্গেই ছিল, তো এখন সব পার্ট পার্ট হয়ে গেছে। এখন কবিতার লোক নাটক দেখে না। আবার নাটকের ছেলেমেয়েরা কবিতা পড়ে না বা শুনতেও যায় না। এই যে বিভাজন, এটা অবশ্যই ক্ষতিকর এবং মন খারাপেরই। এই অবস্থা থেকে অবশ্যই উৎরানোর দরকার; কিন্তু সম্ভব হবে কি? সংগীত নাটক কবিতা এসব তো একসঙ্গে থাকলেই মনে হয় সংস্কৃতির উন্নয়নটা আরও ভালো হয়। মানসিক উন্নয়ন হয়, তাই না?

উত্তর : তা তো অবশ্যই সত্যি। সংস্কৃতির উন্নয়নসহ জীবনের গভীর চর্চাটা করতে হবে। এটাকে বলে ক্রসফার্টিলাইজেশন অব আর্ট। মানে সংগীতের কাছ থেকে আমি শিখব। কবিতার কাছে শিখব। উপন্যাস গল্পের কাছে শিখব। আবার কবি চলচ্চিত্রকার বা অন্য যারা আছেন তারা নাটকের কাছে শিখবে। এই যে দুজনের মধ্যে মিথোস্ক্রিয়া এটা এখন আর নাই, নষ্ট হয়ে গেছে।

প্রশ্ন : এটা কি হওয়ানো সম্ভব? কমেই-বা গেল কেন?

উত্তর : এটা হচ্ছে ব্যস্ততা। নাটকের ছেলেমেয়ে সন্ধ্যার পর সবাই ব্যস্ত তাদের মহড়া কক্ষে। কবিদের ওই রকম ব্যস্ততা নেই; কিন্তু আড্ডার জায়গা থাকে। যেখানে গিয়ে নাট্যকর্মীরা আড্ডা দেবে সেই সময়টা তাদের কমে এসেছে। আর এখন মিডিয়ার যুগে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এত ব্যস্ত যে তাদের আর সেই অবসরটা নেই। এটা তো অবসরের কাজ! আর অর্থনৈতিক জীবনটা এমন কঠোরভাবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যেটা শিল্পসাহিত্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ নয়।

প্রশ্ন : মানে আমরা জীবন কাটাচ্ছি প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে। এখানে সংস্কৃতি চর্চার জায়গাটা ক্ষয়ে যাচ্ছে।

উত্তর : খুবই কমে এসেছে।

প্রশ্ন : আপনার জন্মতারিখ ২৯ ফেব্রুয়ারি, লিপইয়ার। চার বছর অন্তর আসে। এটা নিয়ে আপনার অনুভূতি কী? প্রত্যেকের জন্মদিন তো প্রতিবছর আসে, আপনার চার বছর পরপর?

উত্তর : এটা একদিক দিয়ে ভালো। এতে একটা প্রতিক্ষার সময় থাকে। প্রতিবছর হলে তো প্রতিবছর একটা হুলুস্থুল লেগে যায়। সেই জায়গায় চার বছর পরে হলে একটা আগ্রহ থাকে। অপেক্ষা থাকে। উৎসবটাও ভালো হয়, হা হা।

প্রশ্ন : নাটক নিয়ে আপনার পরিকল্পনা, নতুন কিছু?

উত্তর : পরিকল্পনা তো আছেই। এই যে নাটক লিখছি…।

প্রশ্ন : নতুনত্বের কোনো ভাবনা তো আছেই…

উত্তর : সে তো অনবরতই হচ্ছে; কিন্তু হয়তো মঞ্চে আসছে না।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে এই যে সামাজিক নৃশংস ঘটনাগুলো আমরা দেখি যা সোশ্যাল সাইটে ভাইরাল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি চর্চার ভূমিকা কতখানি?

উত্তর : সংস্কৃতিটা ঠিকমতো চর্চা হলে এসব হতো না। এই যে, বুয়েটের ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হতো না। তারপর প্রতিদিন একটা না একটা ঘটনা আছেই। এই যে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটা ক্যাসিনো আছে, তার মানে একটা শ্রেণির বড় অংশ এর মধ্যে যুক্ত থাকছে। সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে থাকলে এসবের দিকে যেতে পারে না মানুষ। বোধ শাণিত হয়। সে নিজেই নিজেকে একটা সাংস্কৃতিক আবহে রাখতে সক্ষম হয়। সেই চর্চাটার ভীষণ দরকার ছিল তো…

প্রশ্ন : তাদের কাছে ওটাই সংস্কৃতি হয়ে যাচ্ছে?

উত্তর : হ্যাঁ। সেটাই। ওটা অপসংস্কৃতি। এই অপসংস্কৃতিকে দমন করতে পারে একমাত্র সংস্কৃতিই। সংস্কৃতির চর্চাটা আমাদেরকে করে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যত যাই ঘটুক এখান থেকে সরে যাওয়া চলবে না। তাহলে অপসংস্কৃতির পথ একদিন না একদিন ঠিক বন্ধ হবে। আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop