আমাদের মীরা আপা – আজগর মোল্লা

By Published On: April 19, 2022Views: 352

আমাদের মীরা আপা
আজগর মোল্লা

লিটন-কে দেখতে যাবো, হচ্ছে না। আজও হবে, সে ভরসা কম। সকালে আনছার স্যার বলে গেছেন, দুপুর পর থানা শিক্ষা অফিসার আসবেন, ভিতরে ভিতরে আমরা যেনো প্রস্তুতি নিই। টিচারদের সাথে এইসব অফিসারদের কাজ কী, তা এক রহস্য। তবে আমাদের সাথে কাজ তার সামান্যই। মুচকি হেসে ক্লাসে ঢোকেন। মিহি সুরে কথা বলেন। কথা শুনলে লাগে যেনো ব্যাটার দাঁতের গোড়ায় আলোচাল। হা একটু বড়ো হলেই তা ব্রাশফায়ার হয়ে যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলার কারণও বোধহয় তা-ই। মিচকে শয়তান আর বলে কারে!

তবে দেখতে-শুনতে মানুষটা শয়তানসম হলেও, স্বভাবচরিত্রে অফিসার ব্যাটা খুব লাজুক মানুষ। টুকটাক কুশলাদির পর সহাস্যে প্রশ্ন যা করেন, তা খুবই কমন, অর্থবহ, খুব সম্ভবত অর্থকরীও। ক্লাসে এসেই তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমরা আমাদের হেডমাস্টারের পুরো নাম জানি কিনা, মেয়েদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা গার্ল বানান পারে কিনা, আর ছেলেদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ল্যাড মানে কী? এসব আমরা জানি। মুশকিলটা হচ্ছে, প্রশ্ন শুরুই হয় ব্যাক-বেঞ্চ থেকে। বলা ভালো, সে প্রস্তুতিও আমাদের আছে। আমরা যারা সারাজীবনই ফ্রন্টবেঞ্চার, সকাল থেকে তারা বিরস-বদনে ব্যাকবেঞ্চে বসে আছি। কখন এসে ভদ্রলোক দুটো জানাশোনা প্রশ্ন করবেন, আর আমরা বুক ফুলিয়ে তার জবাব দিয়ে বাহবা পাবো, এই আশায়। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, আমাদের এতোশত আয়োজন যার জন্য, দুপুরের আগ দিয়ে জানা গেলো তিনি আসছেন না। আহারে অফিসার! যতোই আমরা শান্তশিষ্ট হই, স্বভাবচরিত্রে ভালো ছেলে হয়ে থাকি, না চায়লেও এরপর কিছু উল্টাপাল্টা গালমন্দ, উড়াধুরা গালখেচা, আমাদের মুখগহ্বর থেকে আসেই। এরই ধারাবাহিকতায় ‘শালার ইতোর’ টাইপের কিছু বকাঝকা আমরা সেইবেলায় শিখেছিলাম। বলার প্রয়োজন নেই, তার শুরুটা এখানে।

লিটন আমাদের বন্ধু না। সহপাঠীও নয়। ক্লাস ফোর শেষ করেই আমরা জেনেছিলাম, ক্লাস ফাইভের মাঝারি মানের কিছু ভালো ছাত্র দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় স্কলারশিপটা বগলদাবা করতে ক্লাস ফাইভেই থেকে যাচ্ছে। লিটন তাদের একজন। আরও যারা ছিলো, তাদের মধ্যে তহিদুলের নামটা মনে আসছে। সদাহাস্য, মেধাবী আর বিরাট ফাজিল এক ছোকড়া। ক্লাস মাতাতে জুড়ি নেই। ওর নাম কিভাবে তহিদুল হলো, সেটা আরেক গল্প। মূলত ওর নাম সাঈদ। পছন্দসই নাম কিন্তু ক্লাসে আরেকজন সাঈদ থাকায় কে যে কোন্ সাঈদ বুঝা যায়না। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত সমাধান হয় খুব দ্রুত। একজন হয়ে যায় লম্বু সাঈদ, বাট্টু সাঈদ হয়ে পড়ে আরেকজন। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে গড়নপিটনে উভয়ই বাট্টু। এরপর আনছার স্যারের মধ্যস্থতায় একজনের নাম হলো তহিদুল। আমরা তহিদুল বললেও, ও অবশ্য বলতো ওর নাম তৌহিদুল। নামের শুরুতে এক্সট্রা একটা ঔ’কার দিলে নাকি নামের ভোল্টেজ বাড়ে। তা বলতে নেই, ভোল্টেজ ওর ছিলো। ইংরেজি বাংলা যা-ই পড়তো, মনে হতো যেনো সালেহ আকরাম খবর পড়ছে। আবার কী মনে পড়ে গেলো ছাতা! সেই সময়ই ছিলো সালেহ আকরাম আর আসমা আহমেদ মাসুদের দিন। কেবল খবর পড়ে যে এতো জনপ্রিয় হওয়া যায়, ভাবাই যায়না। রেডিও খুললেই সাদ্দাম বুশ আর কুয়েতের খবর। আর খবর মানেই আসমা আহমেদ মাসুদ। আহারে! কী দিন!

লিটনের সাথে আমার ক্লাস করা হয়নি। ওর সঙ্গে আমার স্মৃতিও সামান্য। আদর্শ ছেলের গল্প বইপত্রে পাওয়া যায়। তাদেরও কিছু দোষঘাট থাকে। লিটনের ছিলোনা। ও আসলেই তা-ই, আপাদমস্তক ভালো ছেলে বলতে যা বুঝায়। স্কুলে যাওয়া আসার পথে যা দেখেছি। মোষের গাড়ির পয়ান ধরে সে একমনে হেঁটে যেতো। ‘স্কুলে যেতে হয়, তাই যাচ্ছি, স্কুল ছুটি হয়েছে, সুতরাং এবার বাড়ি যাওয়া যাক’ টাইপের হেঁটে চলা। স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী তো বটেই, পথচলতি মানুষও তাকে ভালো ছেলে বলতো। দুঃখের কথা এই, দীর্ঘ দুইমাস রোগভোগের পর ভোররাতে এই ভালো ছেলেটা মারা গেছে। খবরটা সকালেই এসেছে। শিক্ষা অফিসারের আসা না-আসার হ্যাপা সামলে, আমরা যখন সদলবলে ওদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম, তখন বাদ জোহর।

করুণ বিধ্বস্ত বাড়ি। অল্পবয়সি ছেলের অকালমৃত্যুতে আমাদের আমজেল চাচার অবস্থা আরও করুণ। জানাজা আসন্ন। তবে মোল্লার খবর নাই। আব্বাকে দেখলাম আমজেল চাচাকে নিয়ে কলপাড়ে যাচ্ছে। এইসময় তার সামনে পড়া বোকামি। হাতে সাইকেল ধরিয়ে বলে বসতে পারে, কুদ্দুস মোল্লাকে ডেকে নিয়ায়। আমার এতো সময় নেই। হাতে অনেক কাজ। কাজও ডিটেক্টিভ। সুতরাং তা অতিমাত্রায় কনফিডেনসিয়াল। বাড়িতে মাতম চলছে। মরাবাড়িতে এরকমই হয়। মেয়েমহলে কান্নার আওয়াজ যেনো বেশি ভারি। যাকে বলে ডাকচিক্কুর। মরাকান্না বোধকরি এটাই। কিন্তু সে-কথা কথা নয়। কথা এই যে, এই অসংখ্য মানুষের ভিড়ে মীরা আপা কি আছে কোথাও? এসেছে নিশ্চয়। ঘটনা যাই ঘটুক, ছোটো ভাইয়ের মৃত্যুতে কি বড়োবোন না এসে থাকতে পারে?

মীরা আপাকে শেষবার দেখেছিলাম বছরখানেক আগে। আশ্চর্য! সেও ছিলো এক কান্নার দৃশ্য। হেডমাস্টার স্কুলে যথারীতি আসেননি। আনছার স্যার কেনো জানি মামুন ভাইকে টিচার্স রুমে ডেকে নিয়ে বাটাম ফাটানো মার দিচ্ছে। সে এক করুণ দৃশ্য। অপরাধ? সে স্কুলের সমস্ত ছেলেমেয়েকে আনছার স্যারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছিলো। আশ্চর্য মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যিটা এই যে, ক্লাস ফাইভে পড়া একটা ছেলের কথায় স্কুলের সমস্ত ছেলেমেয়ে সেদিন স্যারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। আনছার স্যারের বেতের ঘাই মানিনা, মানবোনা, আনছার স্যারের কালোহাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও, ইত্যাকার টাইপের আগুন-ঝরা স্লোগানে সেদিন আকাশবাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিলো। বলাবাহুল্য, টিচারদের উপর্যুপরি কাঁচা-কঞ্চির ঘাইতে সে আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বড়োঘরের ছেলে হিসেবে মামুন ভাইকে সে-যাত্রায় স্কুল ছাড়তে হয়না। তবে এসব মূলত বাহুল্য কথা। আসল কথা এই যে, সেদিন টিচার্স রুমের বদ্ধ দুয়ারে যে-মেয়েকে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল, সে-ই আমাদের মীরা আপা। আগেই বলে রাখি, ক্লাস ফাইভে পড়া একটা মেয়ের মনের খবর চাউর করা এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়।

মীরা আপা সুন্দরী। জনশ্রুতি যতোটা আছে, কিংবা মামুন ভাই যতোটা বলতো, ততোটা না হলেও, সুন্দরী সে বটেই। আমরা যারা আরও নিচু ক্লাসে পড়তাম, তাদের কাছে সে ছিলো টিচারসম। একসময় স্কুলগুলোতে এই অভিনব কালচারটা ছিলো। উপরের ক্লাসের ভালো ছাত্র-ছাত্রী নিচের ক্লাসের ছোটো ভাই-বোনদের পড়াতেন। শিক্ষক সংকট একটা কারণ হতে পারে। তবে সত্যি বলছি, এতে আমরাও খুব এঞ্জয় করতাম। প্রথমত, পড়া না-পারা জনিত মারাধরার ব্যাপার সেখানে ছিলোনা। দ্বিতীয়ত, ভয়ে কুঁকড়ে না থাকায় পড়াটাও একরকম সহজসাধ্য মনে হতো। এখন সম্ভবত প্রাইমারি স্কুলগুলোতে এই কালচারটা নেই। হয়তো প্রয়োজন পড়েনা। তবে ছেলেমেয়েরা আদৌ কিছু শিখছে কিনা, কে জানে। স্বীকার করতেই হয়, এখনকার ছেলেমেয়েরা অন্য যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ট্যালেন্ট। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, এদের বেশিরভাগের-ই বেসিক তৈরি হচ্ছেনা।

কেনো হচ্ছেনা, সে প্রশ্ন রাজনৈতিক। আমি সেটা এক লাইনে বলে দিই। মেধাহীন জাতিকে শাসনের নামে শোষণ করা সহজ। এই কথাটা বোঝার জন্য মাথায় চুল থাকার প্রয়োজন নেই। কাঁচা-পাকা চুলগুলো অযথা কালো কাপড়ে বাঁধার প্রয়োজন নেই। দাদাদের ইশারা বোঝার মতো একটু বুদ্ধি থাকলেই হয়। বলতে নেই, গতো চৌদ্দবছর যাবৎ এদেশের শিক্ষানীতি এই একটা লাইনের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। জানেন নিশ্চয়, এই চৌদ্দবছরে এদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস আটকানো যায়নি। কলেজ ইউনিভারসিটির ছেলেরা এখন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। ছাত্ররাজনীতির নামে দেশসেরা বিদ্যাপীঠে এখন ছাত্রখুনের ঘটনাও এদেশে ঘটে। আমি আসলে অতোটা সাহসী নই, যতোটা হলে বলতে পারতাম, এ-সবকিছুই খুব বড়ো একটা পরিকল্পনার অংশবিশেষ। তবে যারা মনে করেন এই প্রশ্নফাঁস, এই চাঁদাবাজি, কিংবা এই ছাত্রখুনের ঘটনা কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র, তারা চোখবুঁজে মুড়ি খান। চায়লে নাকে তেল দিয়ে খানিক ঘুমাতেও পারেন।

বিউটি নামের যে মেয়েটা আমার পাশের ফ্লাটে থাকে, ওর কথাই বলি। ওর বাবা ব্যাংকার। বাড়ি বসুরহাট। নোয়াখাইল্লা হলেও, লোকটা যারপরনাই ভদ্রলোক। দুই মেয়ে। বড়ো-মেয়েটা গেলোবার এসএসসি পাশ করেছে। ওর নামই বিউটি। মায়ের সাথে সে বাসায় এসেছিলো মিষ্টি নিয়ে। পাশের মিষ্টি। রেজাল্ট এ-প্লাস। কোন্ দুই বিষয়ে যেনো এ-প্লাস না হওয়ায়, প্লাসটা গোল্ডেন হয়নি। এ-নিয়ে মেয়ের মায়ের আফসোসের শেষ নেই। আমার বউ অবশ্য এই নিদারুণ আফসোসের কিনারা করতে পারেনি। সে কেবল ওই ফার্স্ট ডিভিশন আর সেকেন্ড ডিভিশনই জানে। প্লাস মাইনাস বোঝেনা। সেভাবে বললে, জিপিএ সিস্টেমটাই তো গোলমেলে। ছাতার এফ নামেও একটা গ্রেড একদা ছিলো। এখনও হয়তো আছে। তবে সত্যি বলছি, ওটা যে ফেল গ্রেড এবং এই গ্রেড প্রাপ্ত স্টুডেন্ট যে পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেনি, সেটা বুঝতেও মানুষের কয়েক সাইকেল লেগেছিলো।

চাকরিতে ছুটিছাটা এমনিতে নেই। কখনোই থাকেনা। তবে কিভাবে কিভাবে যেনো ওইদিন বাসায় ছিলাম। মেয়েটার নাম বিউটি বলেই হোক, কিংবা কৌতূহল বশেই হোক, আমি শুধু তাকে একটা প্রশ্নই করেছিলাম। বলো তো মা, ‘বিউটি ইজ দ্যা বিউটি’ এখানে সেকেন্ড বিউটি কোন্ নাউন? প্রথমে মেয়েটা আকর্ণ লাল হলো। মেয়ে তো! তারপর ফ্যাকাশে। একেবারে সাদা। যাকে বলে হতভম্ব। মেয়েটার গোমর কথা বুঝতে আমার বাকি নেই। এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন হলো? পার্টস অফ স্পিচ আট প্রকার, এই তো জানি। নাউন প্রোনাউন তার মধ্যে কয়েকটা, সেটাও না হয় জানা গেলো। কিন্তু নাউনের আবার প্রকারভেদ হয় নাকি? আজব তো!

বউতো রা রা করে উঠলো। তোমার এখানে মাস্টারি করতে কে ডেকেছে? মিষ্টি খেলে, খাও। নইলে ভাগো। মেয়ের মাও মেয়ের জ্বরজারি বিষয়ক কিছু এলোমেলো অজুহাতের কথা বলতে চাচ্ছিলো। আমি শুনিনি। মেয়েদের সবকথা শুনতে নেই। তবে আমার এই কথাটা শুনুন, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সত্যি বলছি, স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েরা আজকাল কোনোকিছুই পড়ছেনা। শেখানো হচ্ছেনা কিছুই। টিচারবৃন্দ পাঠ পরিক্রমাই সীমাবদ্ধ। মাস্টারিটা হয়ে গেছে মাসকাবারি চাকরি। গোটা সিস্টেম-ই শ্বাসরুদ্ধকর। এরমধ্যে চৌদ্দগ্রামের চারটা ছেলে তো পরীক্ষা না দিয়েই মেট্রিকে পাশগ্রেড পেয়ে গেলো। তো এরা পড়বেই কী, আর পরীক্ষা দেওয়ার-ই বা প্রয়োজন কী? সুতরাং বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, জাতিগত বিপর্যয় এখন অতি সন্নিকটে। সিম্পটোম একরকম শুরু হয়েছে বলা যায়। খুব সম্প্রতি যারা চাকরি-বাকরিতে আসছে, একটা জয়নিং লেটার তারা নিজ-হাতে লিখতে পারছেনা। ‘আমি গতকাল ছুটিতে ছিলাম’ এই কথাটা ইংরেজিতে লিখতে পারছেনা। ভাবা যায়!

মীরা আপার কথা বলছিলাম। হুদাহুদি জিনিসটা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। সেইসব দিনে ‘এম প্লাস এম’ অনেক বড়ো তিল। দ্রুতই তা তাল হলো। ফিসফাস ভাটভুট স্কুল ছেড়ে গ্রামে ঢুকে পড়লো। ফলাফল, এক অমিত সম্ভাবনার অপমৃত্যু। ক্লাস ফাইভে পড়া একটা মেয়ের বিয়ে খুব আজব কিছু নয়। তাইবলে মীরা আপা? আমজেল চাচা নিজেই অন্যদের বোঝায়। তাকে বোঝায় এমন লোক কই? সুতরাং সময় লাগেনি। আর সেইসময় তো বলা যায়, আমাদের চাঁদপুর ব্রিজ হয়ে উঠেছিলো স্থানীয় ঘটকালয়। ইতোমধ্যে হয়তো সেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে কোনো তাঁতি যুবক, কাঁচামালের কোনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কিংবা কোনো রাজমিস্ত্রির যোগানদার দেখে গিয়েছে মীরা আপার ঝালরযুক্ত ফ্রকের নিচে ঈষদুচ্চ বুক আর চুল নিংড়ানো পানিতে ভেজা খাড়া পিঠ। এই কনে-কে পছন্দ তার হবেই।

আমি সেদিন স্কুলে যাই নাই। পরে বন্ধুবর কামিরের কাছে শুনেছিলাম, মীরা আপা নাকি সেদিন আনছার স্যারকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো। মামুনের কোনো দোষ নেই, ওর যেনো কিছু না হয়, টাইপের আকুতিও নাকি ছিলো সেই কান্নায়। আহারে বালিকা মন! আজ এতোদিন বাদে কেনো জানি মনে হচ্ছে, আমাদের সকল অনুভূতি রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয়। মেয়েমন বড়োই জটিল। যেইখানে সে আঘাত পায়, সেইখানেই সে হৃদয় দিতে প্রস্তুত। মীরা আপার ক্ষেত্রেও কি এরকম কিছু ঘটেছিলো? আমাদের জানা নেই। এরপর মীরা আপাকে ভুলবার পালা। আনছার স্যারের পরবর্তী দুঃশাসনে আমরা তাকে দুইদিনে ভুলে গেলাম।

স্কুলের সবচেয়ে বড়ো প্যারার নাম ছিলো পিটি-প্যারেড। প্যারেড ছেলেমেয়েদেরকে সকল অচিন্তা কুচিন্তা আর তরলচিন্তা থেকে বিরত রাখার অব্যর্থ টনিক। সুস্থ দেহ সুন্দর মন, এই থিমের উপর ভিত্তি করে স্কুলে পিটি-প্যারেড বেড়ে গেলো। আরেব্বাস সেকি প্যারেড! প্যারেড তো নয়, পায়ের নিচের মাটি কে কতো দাবাইতে পারে, এ যেনো সেই পাল্লা। স্বভাবতই আমি খুব নাম করে ফেললাম। ওজনদার হওয়ায় আমার পক্ষে পা একটু উপরে তোলাই যা কঠিন ছিলো। বাকি কাজ পা-দুটো নিজে নিজেই করতো। তিতিবিরক্ত হয়ে আমাদের পিয়ারুল ভাই একদিন এর প্রতিবাদ করে বসলেন। এটা নাকি আসল প্যারেড নয়। আসল প্যারেডে এতো ধপাস ধপাস শব্দ হয়না কখনও। আমরা ততোদিনে জেনে গেছি, আজিজ মিলিটারি ওর ভাই। সুতরাং কথা সত্য হতেই পারে। আমরা একটু আশার আলো দেখলাম।

আনছার স্যার তার ভয়ানক চোখদুটো কোটর থেকে বাইরে এনে বললেন, আসল প্যারেড তোমাকে কে শিখিয়েছে বাছাধন? তোমার ভাই? যাও, তোমার ভাইকে ডেকে নিয়ে আসো। সেনাবাহিনীর নাকি ছুটিছাটা থাকেনা। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আরকি। আজিজ মিলিটারি তখন গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে গ্রামে এসে দিনগুজরান করছে। তিনি আসলেন এবং পরিষ্কার করে বলে গেলেন, স্যার যে প্যারেড শেখাচ্ছেন, এটাই আসল প্যারেড। বোধহয় বলার প্রয়োজন নেই, তিনি ছিলেন এই উত্তর চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। মিলিটারি গেলেন, শুরু হলো আনছার স্যারের চাল-চাবানো কমান্ড। আরামে দাঁড়াও, সোজা হও। তালে তালে ওই কাজ আরম্ভ করো। লেফট্ রাইট লেফট্, লেফট্ রাইট লেফট্…….,ঘাস খালি ঘাস, ঘাস খালি ঘাস…….। উল্লেখ্য যে, যে-ছেলেমেয়েরা কোনটা বাম-পা আর কোনটা ডান-পা বুঝতো না, তাদের বাম-পায়ে ঘাস বেঁধে দেওয়া হতো। হেডমাস্টার এসে না থামানো পর্যন্ত এ-প্যারেড চলতেই থাকতো। এই একটা কারণেই মনে হতো, স্কুলে হেডমাস্টার থাকার দরকার আছে।

স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি একবার সেকেন্ড হয়ে গেলাম। ‘সফদার ডাক্তার’ কিংবা ‘সুখী মানুষ’এর হাসুর চরিত্রে আমি যতো ভালোই অভিনয় করি না কেনো, দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি সেকেন্ড হবো, এটা কেউ ধারনাও করেনি। ওরা জানেনা, প্র‍্যাক্টিস কিভাবে আমাকে পারফেক্ট করেছে। সকালের ঘুম আমার কোনদিনই সময়মত ভাঙেনি। স্কুলে যেতে যথারীতি লেট। জাতীয় সংগীত শুরু হবে, হয়তো এমন সময় আমি স্কুল-ফিল্ডে ঢুকছি। আনছার স্যারের চোখে ছাতা কোনকিছুই এড়ায় না। জোরালো আওয়াজ আসে, ‘মার্চ অন’। বুঝতে পারি দৌড়াইতে হবে। আবার আওয়াজ আসে, ‘ডাবল মার্চ’। বুঝতে পারি আরও জোরে দৌড়াইতে হবে। ফলাফল ডিগবাজি। উপুড়পটাং হয়েই কি রক্ষা আছে? বাপরে বাপ! আনছার স্যারের কমান্ড অগ্রাহ্য করার সাহস কই? দেখা গেলো, গড়তে গড়তেই আমি প্যারেড স্কয়ারে পৌঁছে গেছি। বলতে নেই, এই দৌড়ের উপর থাকতে থাকতেই আমি সেবার সেকেন্ড হওয়ার গৌরব অর্জন করে ফেললাম। যেনতেন কথা!

সুতরাং পড়াশোনা ও পিটি-প্যারেড জনিত নানান ঝক্কিঝামেলায় মীরা আপাকে আমি ভুলে গেলেও, মন থেকে তার অস্তিত্ব একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি। আহারে! দেবীর আসন কি আর চটজলদি উপড়ানো যায়? সেই মীরা আপাকে আমি মরাবাড়িতে খুঁজছি। পেয়েও গেলাম দ্রুত। রান্নাঘরের সামনে সে মাটিতে বসে কাঁদছে। সম্ভবত আহাজারি সে করতে পারছেনা। বাড়ির লোকও কেউ তাকে ঘিরে আহাবাহি করছেনা খুব। ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন যে মেয়ে বাড়ির লোকের মুখে চুনকালি লাগাতে পারে, তাকে নিয়ে মূলত মাতামাতির কিছু নেই। সমাদরের সহিত সান্ত্বনা তার প্রাপ্য না। বাড়ির পাশে এক-দুইজন বান্ধবী যারা ছিলো, তারাই এসে তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিয়েথা না হলে, মীরা আপাও হয়তো ওদের সাথে সিক্স-সেভেনে পড়তো। ছেলকেপনার দিন যার যায়নি, কলুষিত সামাজিকতার ঘেরাটোপে সেই মীরা আপা আজ ছোটো ভাইয়ের মৃত্যুতে মন খুলে কাঁদতেও পারছেনা। ভাবা যায়!

ভিড়ভাট্টা না থাকায় সহজেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো গেলো। শীর্ণকায় মীরা আপা যেনো মাটির সাথে মিশে আছে। একবার চোখতুলে তাকালো বোধহয়। চিনতে পেরেছে কি? চেনার মতো, মনে রাখার মতো, কোনো কাজ আমি করিনি। একবার শুধু তার পঞ্জ স্যান্ডেলের ছেঁড়াফিতা আমি বাবলাগাছের কাঁটা দিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওতে কি আর কোনো পথচলতি ছেলেকে মনে রাখা সম্ভব? আমাকে অবাক করে দিয়ে মীরা আপা তার হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। আঁচলের কোনায় বাঁধা দুইশো টাকা আমার হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে বলে, আনছার স্যারকে আমার কথা বলো। আর এই টাকা দিয়ে স্কুলে একটা মিলাদ দিয়ো। মীরা আপা তার শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকে। আমিও বুঝলাম, এখানে আমার দাঁড়িয়ে থাকা চলবেনা। আমি বাড়ির সামনে এসে, অল্প একটু দূরে গিয়ে, ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়ালাম।

বড়ো আশ্চর্যের কথা এই যে, ঠিক সেই মূহুর্তে লিটনের মৃত্যু আমাকে ভাবাচ্ছেনা। আমি ভাবছি অন্য ভাবনা। সেই ভাবনার ধরন খুব বিমূর্ত। ছাতাপড়া দুইটা একশো টাকার নোটের দিকে আমি সরুচোখে তাকিয়ে আছি। ভাবতে ভালো লাগছে, মীরা আপার আঁচলের ছোঁয়া প্রাপ্ত দুইটা নোট এখন আমার হাতের মুঠোয়। ক্ষণেক্ষণে নোট-দুটোকে আমি মুষ্ঠিবদ্ধ করছি এবং এই কাজটা করতেও আমার যারপরনাই ভালো লাগছে। এই ভাবনার, এই অহেতুক কর্মের, কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ক্লাস ফাইভে পড়া একটা ছেলের এই ইল্লেতে মনোভাব ব্যাখ্যা করারও দরকার পড়েনা। আজ এতোদিন বাদে কেনো জানি মনে প্রশ্ন জাগে, সেদিনের সেই মনোভাব কি সত্যিই ইল্লেতেপনা ছিলো? কেনো?

Share:
1 1 vote
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop