গুচ্ছ কবিতা – রওশন রুবী

By Published On: August 4, 2021

০১.আমরা দু’জন

আমরা দু’জন অনাবাদি রঙতুলিতে মেশা
আমাদেরই খুদকুঁড়োতে অন্যরকম নেশা।

আমরা দু’জন বিকেল ভেঙে একটি সেতু গড়ি
আকাশ ছুঁতে দিনদুপুরে কারুমইয়ে চড়ি।

আমাদের নেই গোলাপ বাগান অঢেল কাঁটার ঘাত
এক মোহনায় ভিড়াই তরী এক মোহনায় প্রভাত।

০২.অবশেষে দরজা খোলে নি

সেদিন বন্ধ দরজার দিকে বিড়ালের মতো চেয়ে ছিলাম,
একটা আলতো পায়ের আওয়াজ, কাঁচের চুড়ির সুর,
চুল আর ঝুমকোর মিহি কথন-কিছুই শোনা গেল না।

রোদ আস্তে আস্তে কনকচাঁপার ছায়া রেখে চলে যাচ্ছে,
আনমনে হাওয়া এসে গা ভেজায়, ভেতরের হুল্লোড় কানে আসে।
চেয়ে চেয়ে গড়ানো বিকেল গেল,
সন্ধ্যায় নেমে এলো মুখরিত ভিলায়।

দরজা আগের মতো। ফোন করবার কথা ছিল।
ফার্সি কবির বই, একজোড়া ছবি, অর্কিড-দেবার কথা ছিল।
গতবছর নভেম্বরের ভ্রমণ- আর্কাইভ থেকে/ ছবিগুলো আলাদা করার কথা ছিল।
১৯৯৫ সালের বাবার ছবি। ওফ্ফফ!
কণ্ঠ রুদ্ধ! অসম্ভব জলের গতি-ঠেলে চোখ…

দরজার দিকে বেড়ালের মতো তাকিয়ে;
না! কেউ খোলে নি! কেউ ডাকেনি!
বলে নি “সরি দাঁড় করিয়ে রেখেছি । সরি ভুলেই…”
অবশেষে পেছনে শ্বেত দরজা খোলে।
অভিমান ফিরতে দেয় না।

০৩.মাকে কোথাও পাই নি

মা বলতেন আল ধরে হাঁটো, ফসল কষ্ট পাবে, নষ্ট হবে।
মাটি, ঘাস, জল-মেশা গন্ধ নিতে নিতে আল মাড়িয়েছি।
হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি আমি ছাদহীন, চারপাশে ধূধূময়,
ফসলের মাঠ শূন্য। কৃষকের হাহাকার ল্যাপ্টানো বাতাস,
মা আমার কথা রাখেন নি। তিনি তার কথাও রাখেন নি।
প্রকৃতির ডাক এলে কেউ কথা রাখতে পারে না;
গুটিয়ে ফেলে সবটুকু। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।
এগিয়ে যাই… অস্থির লাগে তাকে ছাড়া।

সমুদয় চাঁদের রোশনাই আমার নয়,
নিস্তব্ধতা আর হতাশা ছাড়া কিছুই আমার নয়।
ওসব দূরে ঠেলে নক্ষত্রের ঈশ্বরকে বললাম-
এমন কেন হলো? এই খাঁখাঁ মাঠ ভেজাও,
তিনি নির্বাক! আবার বললাম। তিনি আরো শীতল!
আবার! আবার…
অতঃপর মেঘ চিরে বেরিয়ে এলো শব্দের রাগ-
জলের ধারা সাঁতরিয়ে এগিয়ে যাও।
বহু বহু দূরে! দূরে…
পলিতে পরিণত হলো আমাদের ভূগোল,
ফসল নষ্ট না করে এগিয়েছি। মাকে কোথাও পাই নি।

০৪.কোথায় আছেন রানু’দি

প্রতিনিয়ত হেরে যাওয়াদের দলে আমি রানু’দি।
জিততে চাইনি কখনো, একথা আপনি ভালো জানেন।

জানালা টপকে পালিয়ে যেদিন টপার হয়েও বলিনি-
“আমি সেই পালাতক।” আপনার সুঢৌল ঠোঁটে
একপলক রঙধনু দেখে জানি না কেন যে ডুবেছি
সেই দ্বিতীয় বার; বিশ্বাস করুন আজো
সেই সে আবেশ ফেলে ভেসে উঠিনি বলে- দুঃখ নেই।

ঋতুচক্রের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে
পুনঃ পুনঃ নির্মাণে সঙ্গ চেয়েছি আপনার।
পূবাকাশ লাল হলেই ভয়ের বোতাম খুলে
বেরিয়ে আসতো হলদে পালক; কুঁকড়ে যেতাম,
তখনো চেয়েছি আপনাকে, হ্যাঁ চেয়েছি; না পাই নি।

একদিন আপনি কিছু মানুষের সাথে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
ভিড় দেখলেই আজো ছুটে যাই। ভীড় মিলিয়ে যায়।
আপনাকে দেখি না। কোথায় আছেন রানু’দি?
আর কোনদিন কী আমাদের দেখা হবে না?

মনে আছে, আপনি ভাগ্যশ্রী হয়ে বদলে দিতেন
আমার ভবিতব্য। আবার বদলে দিবেন জন্য আমি প্রতিক্ষায়।

কী ভীষণ চঞ্চল ছিলেন আপনি,
উদ্যমে ছুটতে ছুটেতে ফিকে হয়ে যেত ইচ্ছের আঁচল,
নাকফুল, ঠোঁটের রঙ, কাজলে অদ্ভুত দ্যুতি ছড়াতো।
বারংবার আষাঢ় মেঘের চেয়ে কালো ভ্রু কাঁপিয়ে
আপনি বুকে আগলে নিতেন আমার মুখ;
প্রতিবার হলুদের গন্ধে আমি ডুবসাঁতারের সম্মুখ।
সেই হলুদের গন্ধ এখনো তাজা হয়ে উঠে,
আপনার স্নিগ্ধ বকুলগন্ধামুখ ছুঁই।

ফেলে গিয়ে বহুবার বহুরূপে অরূপেও ফিরেছে অনেকে,
ফিরেছেন যোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, রিফিউজিরাও;
ফেরেন নি আপনি। অভিমান কত বড় হলে
ফিরে না আপন মানুষ? কত বড় অভিমান
বুকে চেপে আছেন; কোথায় আছেন রানু’দি?
আর কোনদিন কী আমাদের দেখা হবে না, হবেই না?

০৫.ধ্যানের উনুনে রাঁধি মরু

কীসের ভয় দেখাও!
চোখে যা দেখা যায় না অন্তরে দেখো!
অশ্রাব্য ভাষা!! উফ্ফফ…
টপকে গ্যাছো ভাবছো মহাকাশ?

আমার হাতের মুঠো খোল, হাসছেন ঈশ্বরের দূত।
দেখ টগবগ করছে বুকের ভেতর সাহসের লাভা।
চোখে ছেদ করে দিতে পারি সুমেরু থেকে কুমেরু।

ও মুখোশের দল! ও হাঁড় জ্বালা ঝঞ্ঝাল।
চেয়ে দেখো কমলেও ঝরছে সততার অনল।
যাও! যাও! যেদিকে খুশি!
ঝরা ভরা ঝুলি ঐ রয়েছে পড়ে,
আমি ধ্যানের উনুনে রাঁধি মরু!
আমারে ভয় দেখাও? আমার ভয় কী অকর্ম ভীরু?

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop