ব্যক্তিত্বই মানুষের আসল সৌন্দর্য। তা যে কোনোভাবে ঠিকরে বেরোবেই – ইসমত শিল্পী

By Published On: July 29, 2021

ব্যক্তিত্বই মানুষের আসল সৌন্দর্য। তা যে কোনোভাবে ঠিকরে বেরোবেই
ইসমত শিল্পী

এই অবিশ্বাসের যুগেও অনেক বিশ্বাসই টিকে আছে। তার অধিকটুকু আত্মবিশ্বাসের জোরে আবার অনেকটা অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে। এই অবস্থার মধ্যে যারা আত্মবিশ্বাসের পথের পথিক, তাদের স্ট্রাগলটা বড় মর্মান্তিক। যখন সমস্ত বৈরিতার মুখোমুখি হয়ে জীবনে খুব বেশি ধাক্কা খেতে হয়, কিছু মানুষ তখন মাথা নত করেন প্রচলিত ক্ষমাতার কাছে। কিন্তু কিছু মানুষ ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় আত্মবিশ্বাসে ভর করে। সমাজকে উপেক্ষা করার উপায় নেই তাই তথাকথিত সামাজিকতাও বজায় রাখতে হয়।

সমাজের আসল কাজ বলতে যা বোঝায় তা এখন শূণ্যের কোঠাই। সমাজ তার নিজস্ব বা আপন রীতিতে চলছে না। চলছে ঢালাওভাবে, একটা চোরাবলির পথে। চলছে তথাকথিত সমাজপতিদের তৈরি ব্যবস্থার উপরে। একমাত্র তাদের বিচারের উপরেই চলছে সামাজিকতা। এখানে সব দায় যেনো নিজের, সমাজের কোন দায় নেই। সমাজ সহজ কোনো পদ্ধতি দেয়নি, দিয়েছে শুধু নিয়মাবলী আর প্রতিবন্ধকতা। সমাজের আছে শুধু কিছু নিম্নতর নীতি- যাকে কোনভাবেই উন্নত ভাবতে পারা যায় না। তা হোক ধর্মীয় বা হোক মানসিক; তা মানবিক তো নয়ই; বরং সবটায় একরকম চাপিয়ে দেওয়া। যে মানুষের নিজস্বতা এখানে ব্যতিক্রম হয়ে জ্বলজ্বল করার কথা সেখানে ভূয়া একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেই মানুষের সামনে। নিজস্বতার যেন কোন নিজস্ব আবাস নেই। নেই কোনো নিয়ম বা বিধি। কোনো আইনও না। যতরকম আইন তা সবই কেবল সমাজের। যদিও তা কখনোই আইনত সঠিক নয়। সবই প্রচলিত ভাবনাবোধ থেকে দাঁড় করানো মানসিকতা। আর উল্টোদিকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক শক্তিতে গড়ে ওঠে যা তা হলো সেই নিজস্বতা। সে আপনার ভূবনে আপনিই রাজা। যদি এই জায়গায় পৌছুনো সম্ভব হয়- তখন আর কোনরকম অন্ধত্ব স্পর্শ করেনা তাকে। এটা উদারতার একটা আঙ্গিক। বড় বেশি সৌন্দর্যের।

আসলে নিজস্বতায় সব; এটাই ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ববান মানুষ নিজেকে যেমন মর্যাদাবান হিসেবে দেখতে চায় তেমনি অন্যদেরকে মর্যাদা দিতেও জানে। অন্যদের মর্যাদা দিতে পারাটাও ব্যক্তিত্বেরই অংশ।


কষ্টের বিষয় হলো, সামাজিক সীমাব্ধতা নিয়ে আপনাকেও সেই বিচারেই মেপে চলবে এই সমাজ। কোন স্বীকৃতি বা সহযোগীতা তো করবেই না বরং হাজার রকম প্রতিবন্ধকতা আসবে। সামাজিক মর্যাদাবোধের ধরনও বদলে গেছে খুব। এই সমাজে সবাই নিজে মর্যাদা পেতে ইচ্ছুক। কাউকে মর্যাদা দেবার চিন্তা বা চেতনাবোধ লোপ পেয়েছে একেবারেই। সামাজিকতা বড়জোর কিছু অন্যায় প্রকোষ্ঠ অযাচিতভাবে চাপিয়ে দেবে মাথায়। যা আপনার ব্যক্তিত্বের উপর বিরাট আঘাত। এই চরম আঘাতে অপমানিত মানুষটা তখন কী করবে ? ঘুরে দাঁড়াবে, নাকি মেনে নেবে সব ?

যে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারা যায় তবে তা পাহাড় জয়ের সাফল্য। তবে এই ঘুরে দাঁড়াতে পারা টা বেজায় কঠিন কাজ। এটাই ব্যক্তিত্ব। কেউ না কেউ তো এই কঠিন কাজটি করবেই। কারণ সময় তো তার নিজস্ব নিয়েমেই চলবে। সেগুলো অনেক সময়ই আপনার জীবনের নিয়মে না। তবে কি স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতার কাটা !

জীবনের কোনো নিয়ম নেই, তা সবটুকুই সময়ের কাছে পরাভূত। তার সবটুকুই সমাজের সাথে যুক্ত ও সংযুক্ত। এসব না মানলে আপনি অসামাজিক। কিন্তু যা ব্যক্তিত্ব তা তো অসামাজিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। যদি বলি নতুন সামাজিকতা গড়তে পারা সম্ভব। আর তথাকথিত সামাজিকতার স্রোতে গা ভাসাতে না পারলে এ কাজটাই করতে হবে।

ঠিক তখন আত্মবিশ্বাসের মতো কঠিন একটা পয়েন্টে চলে আসে জীবন। আপনা আপনিই নিজ ক্ষমতায় চলতে থাকে। তখন একটাই লক্ষ্য- সকল বাধাকে অতিক্রম করা। আশেপাশের সমস্তরকম তীরগুলো তখন এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। তখন একলা মানুষটি ভেতরে ভেতরে খুব একা হয়ে যায়। কোনো অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার সীমানা ছিলো না কখনোই। তাই নির্দিষ্ট লক্ষ্যেও বেঁধে থাকে না কেউ। বাধ্য হয়েই নিজের ভেতরে আরেক ক্ষমতা নিজেই বপিত হয়ে যায়। ক্ষমতা মানে শক্তি। আত্মশক্তি। এই শক্তি বাড়তে থাকে; বাড়তে বাড়তে মানুষটা নিঃশেষ হলেও ভেতরে বাড়তেই থাকে সেই ক্ষমতা। ক্ষমতা কিন্তু যোগ্যতার উপর নির্ভর করে নয়। ক্ষমতা বলতে জয় করবার বাসনা বোঝানোও নয়। ক্ষমতা হলো দক্ষতা। দক্ষতায় মানুষ তখন আত্মবিশ্বাসে ভরিয়ে দেয়। আর আত্মবিশ্বাসী মানুষ কখনো হেরে যেতে পারেনা। আবার জিততে চাওয়ার নেশায় বা আগ্রহেও এই চলতে থাকা নয়। আমি হারতে রাজি নই- মূলত: এটাই আত্মবিশ্বাস। সবরকম পরিস্থিতির মোকাবেলা আমি একাই করতে পারি- এটাই তো আত্মবিশ্বাস!

অনেক সময় ‘আত্মবিশ্বাসের মধ্যেও অন্ধত্ব থাকে। কিন্তু সবসময় না। তবে আমরা আত্মবিশ্বাস ভেবে বিশ্বাসকে একটা ঘেরাটোপে বলি দিতে থাকি। আসলে বিশ্বাস অবিশ্বাস সবই যেনো আপেক্ষিক। এটাও ভাববার বিষয়। বিশ্বাস কিন্তু স্বার্বজনীন না। অবিশ্বাসও না। অবিশ্বাস অসুন্দর কিন্তু তা সত্য। কোনো একসময় সত্য হবেই, এমন। আর বিশ্বাস হলো সুন্দর। কিন্তু তা সত্য হতেও পারে আবার সত্য নাও হতে পারে। তাহলে অবিশ্বাসকে নেতিবাচকভাবে ভাবা তো সঠিক হচ্ছে না। এটা এক প্রকার সতর্কতা। পথে বেরুলে যেমন সাবধান থাকতে হয়, সচেতন থাকতে হয়। তেমনই সচেতনতা।

কেউ যদি আপনার বিশ্বাসকে দুর্বলতা ভাবে এই ঘাটতি তার। যেমন সৌজন্যকে দুর্বলতা ভাবলে, দায় টা তার ই। কেউ যদি আপনাকে বোকা ভাবে এই দোষ আপনার বা বিশ্বাসের নয়। বিশ্বাস সর্বদাই একটা শক্তিশালী শব্দ। আর মর্যাদা সৌজন্যতার বসতবাড়ি। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা হয় না।


তেমনি অপরকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। একটা সময় এটা প্রকট আকারে থাকতে পারে আবার নষ্টও হয়ে যেতে পারে- যে কোন কারণে। তবে ওই যে- প্রকট বিশ্বাস, এটাও একটা রোগ। অবিশ্বাসও তেমন। তবে বিশ্বাস নিজের ভেতরের সৃষ্ট ক্ষমতা। আর অবিশ্বাস যে কোন প্রশ্ন থেকে উত্থিত হয়। প্রশ্ন মানেই সন্দেহ নয় অথবা সন্দেহ। কিন্তু সন্দেহ নিয়ে প্রশ্নকারীর তো দোষ হতে পারে না- দোষ প্রশ্নের- যা সৃষ্ট হয়েছে। যেটাই হোক, সচেতন থাকাটাই মূখ্য বিষয়।—- আবার এলো সচেতন শব্দ।


সচেতন আর সতর্কতা কিন্তু একরকম নয়। সতর্ক শব্দের মধ্যে চতুরতা আছে। যেমন প্রকাশ্যে চলতে গিয়ে চতুর্দিকে লক্ষ্য রাখা। এর মাঝে স্বার্থপরতা থাকে। এই সুচতুর লেখাগুলোকে আমার ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ অপছন্দ, দেখলে অস্বস্তি তৈরি হয়। সচেতন শব্দটা অধিকতর উন্নত, উদার এবং গুণনিভর। সচেতন হলে আর সতর্কতার দরকার হয়না। ওটার মধ্যে সবই আছে। নিজস্ব এক দর্শন আছে। যা কোনকিছুকে পরোয়া করেনা। অনেক ব্যক্তিত্ববানই আছেন- খুব সতর্ক কিন্তু সচেতন না। একটা সময় সে স্লিপ করবেই। কারণ সচেতন মানেই আত্মবিশ্বাসী লোক। আর আত্মবিশ্বাস মানেই তো আত্মনির্ভরশীল। আত্মনির্ভরশীল মানুষ ভাঙা পায়েও নিজের মতো চলতে পারে। অন্যে কাঁধের উপর ভর করে চলা যাদের স্বভাববিরুদ্ধ। এ কারণেই আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভরশীল মানুষ বড্ড একা। এই একাকীত্বের ভারও মোটেই টলাতে পারেনা সেই মানুষকে। উঠোন ভর্তি আত্মীয়-স্বজন আর ঘর ভর্তি বন্ধু-বান্ধব মানেই বড্ড সুন্দর মনের তা কিন্তু একেবারেই নয়। বরং উল্টোই হয়। আত্মবিশ্বাসী মানুষ একলাই একশো। কী সিদ্ধান্ত নেবার বেলায় কী কাজের বেলায়। কপালগুণে একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ যদি পাশে জোটে তো জীবন সুন্দর। সুন্দরকে কখনোই সফলতা দিয়ে বিচারে আনা ঠিক নয়। ব্যর্থতার মাঝেও এক ধরণের তৃপ্তি আছে। যদি তাকে উপভোগ করতে শেখা যায়। জীবন আসলে উপভোগের, ভোগের নয় মোটেই। সেখানে সফলতা ব্যর্থতার হিসেব তুচ্ছ। আমরা বরং সচেতন হই। নিজস্বতায় গড়ে তুলি নিজেকে।


আসলে নিজস্বতায় সব; এটাই ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ববান মানুষ নিজেকে যেমন মর্যাদাবান হিসেবে দেখতে চায় তেমনি অন্যদেরকে মর্যাদা দিতেও জানে। অন্যদের মর্যাদা দিতে পারাটাও ব্যক্তিত্বেরই অংশ। নিজস্বতায় ঋদ্ধ মানুষটি নিজেই নিজের কাছে সমাদ্রিত এবং সম্মানিত। সে নিজেকে যেমন সম্মানিত ভাবতে জানে অপরকেও সমানভাবে সম্মানিত করতে পারে। অপরকে সম্মান করতে না পারা শুধু জটিলতায় নয় ব্যক্তিত্বহীণতাও বটে। যা নিজের অজান্তেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে ভেতরে ভেতরে এবং ভয়ংকর ও নিচতার পরিচায়ক। অদৃশ্যমান একটি নান্দনিক বলয় সব সময় তাকে ঘিরে রাখে সযত্নে। সবরকম প্রতিকূল বাতাসে পাল তুলে অনায়াসে পৌঁছতে পারে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। মানুষকে মর্যাদা দেওয়া যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। এমন বিরল গুণ সবার মাঝে থাকে না। যাদের থাকে তারা মহানুভব।


তবে আবারও বলি, বিশ্বাস যদি হয় জেদের বশে তা তবে খুব ভয়ংকর এবং নেতিবাচক তো বটেই। আর অবিশ্বাস যদি একবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় সেটাও বেজায় খারাপ। এ দুটোকেই আমি ‘মরণব্যাধি’ বলি। অনিরাময়যোগ্য !


–অন্ধ বিশ্বাস এবং ক্রমাগত অবিশ্বাস দুটোই ব্যাধি । অনিরাময়যোগ্য রোগ।


বিশ্বাস শব্দটার সাথে মর্যাদার যোগ আছে। বিশ্বাস আর মর্যাদা ধরে রাখতে পারাটাই মূল কথা। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয় আত্মবিশ্বাসী এবং ব্যক্তিত্ববানও। ব্যক্তিত্ববান মানুষ নিজেকে যেমন মর্যাদাবান হিসেবে দেখতে চায় তেমনি অন্যদেরকেও মর্যাদা দিতে জানে। আসলে ব্যক্তিত্বই মানুষের আসল সৌন্দর্য। তা যে কোনোভাবে ঠিকরে বেরোবেই।

 

ইসমত শিল্পী
কবি, প্রাবন্ধিক ও এডভোকেট

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop