কারো কাছে যাই
ধ্রুব এষ
বেভিপ্রেক্স শেষ হয়ে গেছে। এখন যদি শ্বাসকষ্ট হয়?
বেভিপ্রেক্স ইনহেলার। সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার, রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে একবার নিতে হয়-শ্বাসকষ্ট হবে না কল্পে। শ্বাসকষ্ট কী? পৃথিবীতে এতো বাতাস আমার বুকে শুধু বাতাস নাই। ফুসফুস বাতাস পাম্প করতে পারছে না।-নিজস্ব অযত্ন অবহেলায় কলকজা বিকল হয়ে যাচ্ছে শরীরের। ডরাই না। শ্বাসকষ্ট ডরাই। বিষাদ ডরাই। এত বিষাদ কোথেকে আসে? বেভিপেক্স ইনহেল করলেও যায় না। শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কি কোনো সম্পর্ক আছে বিষাদের? আনোয়ারা আপা কী বলবেন?
পিয়াসকে কল দিলাম। পিয়াস ধরল না। ঘুম থেকে উঠেনি হয়তো এখনও। কবি পিয়াস মজিদ। -আনোয়ারা আপার খবর বলতে পারে সে। মনোবিদ ও লেখক আনোয়ারা আপা। মনোবিদ ডক্টর আনোয়ারা বেগম, লিখেন আনোয়ারা সৈয়দ হক নামে। কয়েকমাস ধরে আছেন লন্ডনে। চিকিৎসার্থে। পিয়াস বলেছে। আনোয়ারা আপা কবে ফিরবেন? আপা ফিরলে আমি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে
যাব? অন্তর্গত বিষাদ দূর হবে?
সব্য আর্টিস্টকে কল দিলাম। সব্যসাচী হাজরা। সে কি আমার বইয়ের প্রচ্ছদটা করেছে? দুই বার কল দিলাম। সব্য ধরল না। সেও এখনও ঘুম থেকে উঠেনি? বা হয়তো ব্যাস্ত।
পার্লকে কল দিলাম। পার্লও ঘুমিয়ে?
আমার চেনা সব মানুষ কি লেট রাইজার হয়ে গেছে নাকি?
আর কেউ আছে কল দিতে পারি? মান্না অধ্যাপক, এখন কলেজে। খোকন স্কুলশিক্ষক, এখন স্কুলে। তুষার উপজেলা মৎস্য অফিসার, এখন অফিসে। আরেক জনকে কল দেওয়া যাবে না। ‘জ্যানথিপি’ আছে, যন্ত্রনা করবে।
তবে? ফোন অফ করে দেব নাকি?
সকালের ওষুধ খাইনি। ফ্যামোটেক, ল্যাসিক্স, কারভিস্টা। জেসমিন ওষুধের বাক্স আয়োজন করে রেখেছেন। কোন ওষুধ কখন খেতে হবে লিখে সেই বাক্সে রেখে দিয়েছেন। দেখে খাই। না হলে কারভিস্টা মনে করে এসলোরিক খেয়ে বসে থাকতে পারি। ওষুধ খেয়ে মেসেজ দিলাম জেসমিনকে, বেভিপ্লেক্স ও ট্রাইটেস নাই। -জেসমিন নিয়ে আসবেন।
ফোন অফ করে দেব, তুলি মেসেজ দিল।
আমি আজকাল স্বপ্নে প্রায়ই তোমার পুরনো বাসা দেখি দাদাভাই। শুধু যে বাসা দেখি তা না, তোমার বাসা খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যেতাম, ওইসব স্মৃতিও আসে স্বপ্নে।
আমার বাসা। থাকতাম সেই এক বাসায়। ‘পরের জাগা পরের জমি’-র প্রগলভতা থেকে বহু দূরের সেই বাসা।
পরের জা’গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।
পরের জা’গা পরের জমি তো বটেই। কিন্তু ঘর বানাতে দিচ্ছে কে? পরের জা’গা পরের জমিতে পরের বানানো ঘরে আমরা থাকি, আমরা ভাড়াটে। ঘরের মালিক হুশৃশ বললে উড়ে যাই। উনিশ বছর ছিলাম সেই বাসায়। চারতলা পুরনো বিল্ডিং। আমাদের মৌরসী পাট্টা ছিল ছাদে। মাসুক ভাই, উত্তমদা, মামুন, জুবেরী ভাই, বুলবুল ভাই, হাকিম ভাই, মাহবুব, সৌর ও তারা বাচ্চা প্রেমিকারা, তুলি, টোকন, বর্ষা, চঞ্চল, আরও কতজন। কেউ আর্টিস্ট, কেউ কবি, কেউ গল্পকার, কেউ ‘ভংছং’। বিশেষ আকর্ষণ বৃক্ষদাদা উপস্থিত থাকতেন কখনও-সখনও। নিসর্গী, লেখক বিপ্রদাশ বড়ুয়া। আমাদের বৃক্ষদাদা এবং আমাদের গোত্রপিতা স্বরূপ।-আকাশ গঙ্গা আমাদের নিত সেইসব সন্ধ্যায়। আমরা ‘বাক্কাস’ বন্দনা করতাম। তরলদার ইমোশনাল অত্যাচারে ছাদে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ছিল। মদ গিলে অ-সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেই অত্যাচারের তুলনা হয় না। আমাদের গান বরং আমরাই বানিয়ে নিয়েছিলাম:
ঘুম আয় রে ঘুম পায় রে
ঘুমের দেশে থাকি
অভাব অনটনে কিছু
ঘুম বন্ধক রাখি…।
বুলবুল ভাইয়ের এই গান ভালো লাগবে কেন?
‘কালা বাউলানি ধরেন রে মিয়া।’
আমাদের মিডিয়া প্লেয়ার ছিল সৌর। বুলবুল ভাইয়ের হুকুম মাত্র ধরত,
মনে রাখসোনি রাখসোনি
ও হলুদ শাড়ি পরা আমার
কালা বাউলানি…।
উদ্দিষ্টা কালা বাউলানি কে?
বুলবুল ভাইকে আমি একদিন বলেছিলাম, ‘মায়ার মা।’
হোস্টেল লাইফ থেকেই আমি বুলবুল ভাইয়ের ন্যাওটা। পায়ে পায়ে ঘুরি। ওরশ, মাজার, মেলা, মায়াপাড়ায় যাই- রেড লাইট এরিয়াকে বলি ‘মায়াপাড়া’। সবখানে বুলবুল ভাইয়ের অবাধ গতায়ত, সবখানে বুলবুল ভাই ‘কবি সাহেব।’
‘কবি সাহেব বলে কেন তারা আপনেরে? আপনি কোনওদিন কবিতা লিখসেন?
‘লিখসিরে মিয়া।’
‘কী? কোন জনমে? ‘টুকা কাহিনি’ লেখার আগে না পরে?’
‘আগে আগে। হাসান পড়ে নাম দিসিল, প্রাকৃত কবিতা।’
‘আবুল হাসান?’
‘হ রে মিয়া।’
‘কী সর্বনাশ। আপনি একটা কবিতা লিখসেন, সেই কবিতার নাম আবুল হাসান দিসেন।’
‘হাসানের লগে আমার সংসার আছিল রে মিয়া।’
সংসার। ব্রোমান্স।
বুলবুল ভাইয়ের সখী মায়ার মা। কালা বাউলানি। যত মাজার ওরশ মেলাতে দেখা যায়। লাঙ্গলবন্দ পূণ্যস্নানের মেলা, বাবা ল্যাংটার মাজারে দেখেছি। ঘর-গেরস্থির গল্প শুনেছি বাউলানির। বাপ তার এক ‘পাগল’ সংসারে। সেই পাগলের মুরিদ এক কসাই। সেই কসাই ‘দেখিল কোন ভূত’, খেপল বিয়ে করবে পাগলের কন্যাকে। পাগলের কন্যাও পাগল। বলল, ‘আমারে বিয়া করব? আমি তার লগে দুইটা কথা বলব বাপজান। আপনে ব্যবস্থা করে দিবেন।’
বাপজান ব্যবস্থা করে দিলেন। মায়ার মা তখনও মায়ার মা হয় নাই বা তখন থেইে হয়তো মায়ার মা সে, সোজাসাপটা জবান দিল কসাইকে, ‘আপনে আমারে বিয়া করবেন? কেন? আপনে কী চান? ছেলে মেয়ে? কয়টা চান? যে কয়টা চান আমি দিব, কথা একটাই, আমারে শিকল দিতে পারবেন না। আমি বাউলের কইন্যা বাউল গো কসাই। ওরশে মেলায় ঘুরি জন্মেছে। বিয়ার পরেও যদি ঘুরতে দেন তবে আছি, বিয়া করতে পারি আপনেরে, না দিলে কথা এইখানে শ্যাষ।’
কসাই কথা এইখানে শ্যাষ হতে দেয় নাই। মায়ার মা ও কসাইয়ের এখন তিন মেয়ে, এক ছেলে। ঘর সংসার হয়েছে তাদের। মায়ার মা ও কসাই আছে মাজারে মাজারে-ওরশে মেলায় লোকায়ত হয়ে।
এই দুনিয়াদারিটা কী?
মায়ার মা ও কসাইয়ের সংসার?
চরৈবেতি: ঋষি ঔতরেয়?
মায়ার মা হাঁটে, কসাই হাঁটে। ঋষি ঔতরেয় তাদের বলেছেন হাঁটতে? বুলবুল ভাই, বুলবুল চৌধুরী হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন কোন ‘টুকা কাহিনি’র পটভূমিতে? কল দিয়ে দেখব?
‘হুমায়ূন স্যার আপনাদের ছাদের আড্ডায় কখনও আসেন নাই দাদা?’
‘না। আমি তাঁর কাছে যেতাম।’
কারো কাছে যাই, কারো কাছে থাকি। হুমায়ূন স্যারের ফোন নাম্বার কি এখনও ভেলিড? কল দিলে পাবো? কল না মেসেজ। স্যার আমি কি সন্ধ্যায় আসব? মেসেজ লিখে ডিলিট করে দিলাম।
পাখি উড়ে গেলে পাখির ছায়া পড়ে থাকে। ছায়া না মায়া। সেই মায়া পড়ে আছে। হাঁটি সেই মায়া নিয়ে। নাড়াচাড়া করি। মায়ার মায়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না?