ফকিরবাড়ি – দীলতাজ রহমান

By Published On: May 10, 2021

সূর্যের আলো স্পষ্ট হলেও মানুষের হাত-পা তখনো পেটের ভেতর সেঁধানো। বলছিলাম সেই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের কোনো এক মাসের কথা। চারদিকে তখন মুক্তিযুদ্ধের শোরগোল। একটু খবরেই মানুষের তখন পথে নয়, একেবারে পথের উল্টোদিকে সবচেয়ে বেপথ দিয়ে নেমে, ভরা ফসলের জমি থেকে চষা জমির বড় বড় ঢেলার ভেতর দিয়েও দিগ্বিগ দৌড়ে রক্তাক্ত হওয়ার সময়। তখন পুরো শীতকাল ছিল কিনা মনে নেই। তবে মানুষের তখন শীত এমনিতেও বেশি ছিল। এখন যেমন বাইরে তুমুল বৃষ্টি হলেও ঘরে আমরা ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে থাকি। শীত একেবারে জাঁকিয়ে না নামা পর‌্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়েও ফ্যান ছেড়ে রাখি। কিন্তু তখন বৃষ্টি আসতে না আসতে আমাদের গায়ে কাঁটা দিত। গামছা থেকে শুরু করে মায়ের শাড়ি ভাঁজ করে গলার সাথে বেঁধে গায়ে দিতাম, যেন খুলেপড়ে না যায়। মানুষের তো তখন কাপড় চোপড়ও কম ছিল। এক গামছাই যে কত কাজে লাগতো। কৃষকের গামছা গা মোছা থেকে শীতে তার চাদরের কাজও করত।
ছেলেমেয়েরাউঠোনের পালা থেকে ক’টা খড় টেনে তাতে আগুন লাগিয়ে পোহাবে কি, মা-বাবা তাতে তেড়ে আসত। বলত, ‘এমনিতে গরুর খাবার কম পড়বে। কাতি মাসে কী খাবে তারঠিক নেইৃ।’ আর নাড়া সে তো বহুদূর। কুয়াশায় বৃষ্টি পড়ার মতো ভিজে থাকতো। সেই জবজবে শিশির ভেজা নাড়া শুকোতে শুকোতে সূর‌্য মাথার ওপর উঠতো। যখন আর কারো আগুনই পোহানোর দরকার হয় না।
সেই তেমন একদিনের এক রাঙা ভোরে আমার বড় ফুপু নিহার বানু তার সাথে আরেক মহিলাসহ বিষন্ন বদনে আমাদের বাড়ি এসে উঠেছেন। এসে অন্দর মহলে ফিসফাস করে কি সব বলছেন। তাতে অন্দরের সবার মনও বিষন্ন হলো। বেলা আরেকটু বাড়লে আমাদের মানে, ছোটদের কানে এসে গড়ালো সে খবর। ফুপুর বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা পূবে। সর্দার বাড়ি নামে একটা বাড়ি আছে, ফুপুর বাড়ি তারও পরে। আবার আমাদের বাড়ি থেকে ঠিক অতোটাই পশ্চিমে এক ফকিরবাড়ি ছিল। মানে আমাদের বাড়িটি মাঝখানে! আর ফকিরবাড়ির নাম ছিল, খলিলের মা ফকিরের বাড়ি।
তখন এমন কাজে পায়ে হাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না। আর শখের বেড়ানো হলে না হয়, মহিলাদের জন্য পালকি অথবা গরুর গাড়ি ঠিক করা যেত। তাই অসময়ে পথে-প্রান্তরে নারীর চলাচলের প্রচলন তখন গ্রামে ছিলই না বলতে গেলে।
ফুপু তার ননদকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়েই সুবেহ সাদেকের আলো স্পষ্ট না হতে পায়ে হেঁটে নিজেদের বাড়ি থেকে সেই বাড়ি ফকিরবাড়ি গিয়েছিলেন। অত সকালে বেরোনোর কারণ, সেই গ্রামের রাস্তায় মানুষের নজর এড়ানো।
ফুপুর সমস্যা ছিল, গতকাল তার ননদ তাদের বাড়ি আসতে পথে, তার ব্লাউজের ভেতর থেকে চল্লিশটি টাকা ওধাও হয়ে গেছে। তাই ফুপু ননদকে নিয়ে ফকিরবাড়ি মানে খলিলের মা ফকিরের কাছে গিয়েছিলেন, টাকাটার খবর জানতে। ফকিরনী বলেছেন, ‘ব্লাউজের ভেতর গুঁজে রাখা ও টাকা জ্বিনে নিয়ে গেছে।’ জ্বিন টাকা নিয়ে যত ক্ষতিই করুক, কিন্তু জ্বিন ফুপুর ননদকে ছুঁয়েছে, তারই একটা ভারী গাম্ভীর্য ফুপুদের ননদ-ভাতৃবঁধু দ্বয়লের ওপর যেন আছর করে আছে। মাঝপথে তারা দু’জন আমাদের বাড়িতে উঠেছিলেন, ক্ষুধা-তেষ্টা মিটাতে।
যথা সময়ে ফুপুরা যখন বাড়ির ঢাল বেয়ে আবার নেমে চলে গেলেন, তখন আগের দিন বিকেলে বাড়ি থেকে মা’র খেয়ে অভিমান করে আমাদের বাড়ি চলে আসা বছর তেরো’র আমার মামাতো ভাই মকবুল হোসেন মিটিমিটি হেসে আমাকে বলল, তোকে একটা কথা বলতে চাই। কারো কাছে বলবি না তো?
আমি বললাম, না বলব না!
: আল্লাহর কিরা বল!
: আল্লাহ কিরা।
কিন্তু তাতেও মামাতো ভাইয়ের মন ভরল না, আবার বলল, বল্, খোদার কিরা!’ তাও বললাম।
মামাতো ভাই আবার বলল, বল্, কোরাণের কিরা।’ তাও বললাম!
এভাবে সে নবী-রসুলদের যত নাম জানা ছিল, সবার নামে আমাকে কিরা কাটিয়ে বলল, তোর ফুপুর ননদের ওই টাকা আমি পেয়েছি!
আমি আশ্চর‌্য হয়ে বললাম, তা কি করে হয়? ওদের বাড়ি গোপিনাথপুর। আমাদের চন্দ্রদিঘলিয়া। তুই কোনোদিন দেখিসইনি ওনাকে, আরে আমিই তো এই প্রথম দেখলাম ফুপুর ননদকে!
দশ বছরের আমাকে তের বছরের ভাইটি থামিয়ে দিয়ে হাত ধরে হিঁচড়ে টেনে বাড়ির সামনের দিকের আরো দূরে নিয়ে গেল। তারপর বলল, ‘উই-ই- যে, ওই বড় রাস্তার যে জায়গাটা কাটা। যেখানে হাঁটু পানি ভেঙে পার হতে হয়। মেয়েমানুষ তো, এই দেখ, এইভাবে শাড়ি গোঁজ করে ধরতে যে নিচু হয়েছিল, তখন ব্লাউজের ভেতর থেকে শক্ত করে রাখা টাকাটা নিচে পড়ে গেছে! আর ফকির বেটি বলে কিনা জ্বিনে নিয়ে গেছে, হা হা হা।’ তবে দশ টাকার চারখানা নোট একত্রে পাকিয়ে যদি শক্ত না করে, দুই ভাঁজ করে রাখত, টাকাগুলো নিজেই কিন্তু তাকে ধরে রাখত! শালার মাইয়ামানুষ টাকাও রাখতে জানে না!
ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে ফেরা আমার ফুপুর মুখখানা করুণ হয়ে বাজতে লাগল আমার মনে। আমি বললাম, ‘দাদা, বুঝতেই যখন পারছিস্, টাকাটা ফেরত দে! ফুপুকে ডাক দিই!’ এই দাদাটি ছিল চরম ডানপিটে। তখনি দুর্র্ধষ সব ঘটনার জন্য তাকে একসময় স্কুল থেকে ছুটিয়ে মাদ্রাসায়ও ভর্তি করা হয়েছিল। সে সেখান থেকেও পালিয়েছিল। পরে বহুদূরে কোনখান থেকে কে দেখে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। তারপর আবার তাকে স্কুলে ভরতি করা হয়।
আমার সে দাদা, আমার হাত টেনে মুচড়ে, কসাইয়ের মতো চোখ পাকিয়ে বলল, ঐ, তুই কিন্তু আমার কাছে কিরা কাটছিস্। এই কিরা ভাঙবি তো তোর গলা দিয়ে রক্ত উঠে মরবি!
মামাতো-ফুপাতো ভাইবোনের মতো মধুর সম্পর্ক আর হয় না। সেই মধুরতায়ই তো আমাদের শৈশব ডুবে ছিল। কিন্তু চল্লিশটি টাকা সব কেমন গরল করে দিল! দাদার চোখের তারায় আমি সাপের জিহ্বার মতো কি এক দৃষ্টি লকলক করতে দেখলাম। মনে হল সে আমার গলা চেপে মেরে, বিলের পানি নেমে যাওয়ায়, কিম্বা পুকুর ঘাটের চারপাশে যে নরম থকথকে কাদা, তার ভেতর পুঁতে রাখতে পারে। আমি তাই একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বুকজুড়ে ফুপুর পোড়া মুখখানা এসে যে ভিড়ে থাকল, আর তা অসহায় আমাকে ভেতরটা একেবারে পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
কিন্তু ভয় বা অনুতপ্ত না হওয়ার ভাব দেখাতেই বললাম, এত টাকা তুই কি করবি?
মামাতো দাদা বলল, আমাদের খেজুরবাগানটা মাত্র পঞ্চাশ টাকায় বন্ধক দেয়া। সেটা ছাড়াব!
বললাম, মামা-মামীমা তোর এমন পাওয়া টাকা নেবেন?
: আমি কি আর বলব, যে পথে পেয়েছি। বলব, খেজুরবাগানে মন খারাপ করে বসেছিলাম, জ্বিন এসে দিয়ে গেছে!’
শেষ পর‌্যন্ত ওই টাকার কথা ফাঁস হলে ভাই না আমার গলা চেপে ধরে। তাই বোঝাই, যদি ফাঁস হয়ই, তাহলে গায়েবীভাবেও কেউ জানলে জানতে পারে। কিন্তু আমি তো তোর কাছেই ছিলাম। আর ওই আধা দিন ওর কাছে থাকার দরুণ ও সারাক্ষণ আমাকে ফিসফিস করে বলতে লাগল, জানিস, ওই ফকির বেটির কত ইনকাম রোজ?
শুকনো গলায় বললাম, ‘কত?’
মামাতো ভাই আবুল হোসেন বলল, জানিস, বছরে কয়বার গরু জবাই দিয়ে তার বাড়ি জেয়াফত হয়, মানে ওরশ করে? শোন্, মানুষ অন্ধবিশ্বাসে নানান কারণে মান্নত করে। তারাই চাল-ডাল তেল-মশলা স-ব বয়ে এনে এগুলো করে। আর যারা সে ওরশে আসে, ওই ফকির বেটিকে তারা শ শ টাকা দিয়ে যায়। গ্রামে এখন খলিলের মা’দের জমিই সবচেয়ে বেশি! কারো ঠেকা হলে আগে ওদের বাড়ি যায়, জমি বেচার প্রস্তাব নিয়ে। অথচ আগে ওদের কি ছিল? আর এখন তার পুরো পরিবারের কিছু করতে হয় না। সব মানুষ দিয়ে যায়। কতজন ওই খলিলের মা বেটিরে ভারী ভারী সোনার হার গড়িয়ে দিয়ে যায়।
আমি বলি, কই, কোনো হার তো ওনাকে পরতে দেখি না! আমিও তো আমার মা’র সাথে দু’একবার গেছি!’
মামাতো ভাই বলে, ওনার পরতে হবে কেন? বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখ! জানিস, কতজন পাগল মেয়ে ও বাড়িতে। মেয়েরা নানান মানসিক চাপে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, আর সবাই মনে করে ভূতে ধরেছে। শেষে ওনার কাছে রেখে যায়, ভূত ছোটাতে। আর উনি সেগুলোকে চাকরানীর মতো খাটায়! কাজে একটু ত্রুটি হলে পাচুন দিয়ে পিটায় ওনার বাড়ির মানুষেরা। অথচ সেইসব মেয়ের বাড়ি থেকে কত কিছু বখরা দিচ্ছে। ওই যে পাগল মেয়েগুলোর একটাও কিন্তু অত গরীব না! আর ওনার ছোট ছেলে ওই মেয়েদের একেকটাকে নিয়ে পুকুর পাড়ের ঝোপঝাড়ে কি করে, তাও কেউ কেউ নাকি দেখেছেৃ!’
আমি অবিশ্বাসের সুরে বলি, তুই এতকথা জানলি কি করে?
মামাতো পকেট থেকে আধা ময়লা ময়লা চারখানা দশটাকার নোট ধানাধান গোণার মতো করে দেখিয়ে বলল, কেন, এখন তুই জানলি না? মানুষ কি বোকাচোদা জানিস, একটা ঘটনা না, হরহামেশাই হচ্ছে, ছোট শিশু পানিতে পড়ে মরে ভেসে উঠছে। লাশ তুলে দেখা যায়, তার গালে পাঁচ আঙুলের থাপ্পড়ের দাগ নীল হয়ে আছে।’
আমার গায়ে কাঁটা দেয়। আমি আগবাড়িয়ে বলতে গেলাম, হ্যাঁ দাদা, আমিও দেখছি।’ তের বছরের দাদা তেমনি চোখ পাকিয়ে বলে, কি দেখছিস?’
ওই যে ভূত! খুলনাতে আমরা তখন তুতপাড়া কবরস্থানের কাছে। একটা বাচ্চাকে থাপ্পড় দিয়ে পানিতে ফেলে রেখেছিল। বিশাল পুকুর। মরে মাঝখানে ভাসছিল। ওঠানোর পর দেখা গেল, ইয়া বড় হাতের থাপ্পড়ের দাগ নীল হয়ে ছিল।’
মকবুল হোসেন দাদা বলল, শোন, ভুতের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, যে মানুষের বাচ্চাকে মেরে পানিতে ফেলতে যাবে! তুই আমাকে বল্, ভূতের কোনো লাভ আছে মানুষের বাচ্চা মেরে?
আমি কিছু বলি না। শেষে কি বলি আর জল্লাদের মতো কষে থাপ্পড় দেয়।
দাদা পুরনো ঝাঁঝ বজায় রেখে বলল, ‘কান খুলে শোন্, ভুত যদি থেকেও থাকে তাহলেও ভূত মানুষের মতো এত নিষ্ঠুর কাজ করবে না!’
আমি বলি, তাহলে কে করবে? বল, কার লাভ?’
: এগুলো করে ওই শিশুদের চাচারা!’
আমার পায়ের নিচের মাটি দুলে উঠল! আমার একমাত্র চাচার মুখটা মনে পড়ে, নানাভাবে তার ছবি বিম্বিত হতে লাগল মনে।
আমি বললাম, ‘ধ্যেৎ।’
কিন্তু দাদা আমার মনে এই বিশ্বাস সেদিন স্পষ্ট করতে আরো বলল, শোন, এক ভাইয়ের যদি ছেলেমেয়ে না থাকে, তাহলে তার সম্পত্তি কে পাবে?’
আমি আশেপাশে আর কাউকে না দেখে বললাম, জীবিত ভাই-ই তো! বেশি ভাই-বোন থাকলে সবাই ভাগ করে পাবে!’
দাদা এবার ঢিল মারার মতো করে বলল, ‘তাহলে এবার হিসাব মিলল? ওই চাচারাই এই কাজ করে। বিশেষ করে মেয়ে মারার থেকে ছেলেদের ওপরই চাচাভূতদের বেশি নজর থাকে! কারণ ভাই না থাকলে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা বাপ-দাদার সব সম্পত্তির ভাগ খুব বেশি পায় না। তখন বাকিটা চাচার ছেলেমেয়ে পায়।’
আমি বলি, তুই আইনের এতকথা জানিস কি করে?’
মামাতো ভাই এমনভাবে উত্তর দিল, যেন আমাকে এতক্ষণ যা বলেছে, সেসব তার অভিজ্ঞতার নস্যিমাত্র। সে দৃঢ়স্বরে বললো, ‘আব্বা পুলিশে চাকরি করে না? থানার সাথেই তো আমাদের বাসা! পুলিশ সব বুঝেও কত সময় ওই অস্তিত্বহীন ভূতের কান্ডকারখানা বলে মানুষের ঘটানো দুর্ঘটনাগুলো চালিয়ে নেয়। মানে যখন দরদামে বনে না, তখনই কেবল আসল সত্যি দুই একটা করে বেরিয়ে আসে!’
দুপুরে খেয়েদেয়ে তের বছরের দাদা গা ঝাড়া দিয়ে আমার মা’কে বলল, ফুপু আমি বাড়ি চলে যাই।
মা বললেন, কেন, তুই যে কাল বললি, ক’দিন থাকবি?
: না ফুপু। চলে যাই, বলে ভাইটি হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বাড়ির নিচে নেমে আমাকে বলল, ‘চল দেখিয়ে দিই, টাকাটা কোথায় পেয়েছিলাম!’
আমার ভয় হল, ওখানে হাঁটু পর‌্যন্ত দেবে যাওয়া কাদা। একপারের থেকে আরেকপারে উঠে অনেকক্ষণ সময় লাগে পায়ের কাদা ছোটাতে। দাদা ওই কাদায় আমার মাথা ঠেসে ধরতে পারে, তার চল্লিশ টাকা পাওয়ার সাক্ষীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। আমি তাই তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। ইতোমধ্যে টের পেলাম আমার কলিজার ভেতর বিদ্যুতের মতো একটা চমক খেলে গেছে। দাদার হাত থেকে হাত ছোটাতে দেরি হলে সে বিদ্যুতের প্রবাহে আমি মরেই যেতাম। তখনো মানুষ বলত তরতাজা মেয়েটাকে মেয়েটার ফুপু নিহার বানুর সাথে বাড়ি চিনে আসাভূত মেরে ফেলেছে! অথবা ফুপুর ননদের টাকার পরে জ্বিন আমাকে চিনেছিল বলে গুজব রটবে।
আমার মামাবাড়ি কাছেই। ওই খলিলের মা ফকিরের বাড়িটা আমাদের থেকে যতদূর, ওই ফকিরবাড়ি পার হয়ে ঠিক আমাদের বাড়ি সমান দূর আরো পশ্চিমে। মকবুল হোসেন দাদা চলে যাওয়ার পর আমার আর অদৃশ্য ভূতের ভয় মোটেও থাকল না। তখন থেকে কেবল প্রতিটি মানুষের মুখে ফড়িংয়ের মতো খুনের ইচ্ছেগুলো উড়তে দেখি। মনে হয়, কারো দ্বারা কারো স্বার্থে আঘাত লাগলে, যে কোনো ভাবে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা বুঝি সবার মনেই কুণ্ডলিত হয়ে আছে। আর সেই ইচ্ছেটাই বদ জ্বিন! বা ভূতৃ।

মিউনিসিপ্যালিটির কতিপয় কাক
আব্দুল আজিজ
বটতলাহাট জাগ্রণী ব্যাংক উধাও – সকাল সকাল হাট করতে আসা মানুষজন এই শিরোনামে খবরটা শুনে চমকিত হয় এবং তা  প্রচারের শেষ দিকে দুই ভ্যান পুলিশ আর রাজ মিস্ত্রিদের একটা দল সেই স্থানে এসে দাঁড়ায়। হলুদ টাই পরা সাংবাদিকদের দঙ্গলের চাপে সাধারণ মানুষ ছিটকে দূরে সরে আছে এবং পুলিশের নির্দেশে খনন কাজ শুরু হয়েছে। কোদাল শাবল চলছে, যে স্থানে এতদিন দোতলা ব্যাংকটি দাঁড়িয়ে ছিল, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নড়ে বসাতেই সাধারণ হাট করতে আসা মানুষেরা এই মাটি কোপাকুপি দেখছে।
একবেলা হয়ে গেছে নাহ, কোন ইট রডের স্তুপের হদিস মিলছেনা, যতদূর খোড়া হয়েছে তাতে আবার বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করা যাবে। 
মানুষ কাকের জাত, কাক যেমন কা-কা ক’রে ময়লা মুখে নিয়ে উড়ে যায়, তেমনি মানুষ এই কাহিনি মুখে ক’রে বয়ে নিয়ে চলে যেতে লাগল নিজ বাড়ি অথবা মহল্লা কিংবা গ্রামের দিকে। যারা চলে যাচ্ছিল তারা যাওয়ার কারণ দেখাল এই বলে যে, আজ সে খচ্চা বা খুচরা মাছ কিনেছে তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি না গেলে ব্যাগে থাকা মাছ মরে যেতে পারে। মছলিখোর মানুষেরা ভীড় ভাঙলে গুজবখোর মানুষেরা এসে জোটে।
গত পরশু তখনো জাগ্রণী ব্যাংক উধাও হয়নি। মঞ্জুর মেম্বারের কথায় ফতেমা বিবি আসে এই ব্যাংকে। তার গায়ের কাপড়টির রং জাগ্রণী ব্যাংক বটতলাহাট শাখার সাইনবোর্ডের লোগোতে থাকা ফ্যাকাসে সবুজ রংটির মতো, ফতেমা বিবি কখনো দাঁড়ায় কখনো বসে, গলা উঁচিয়ে লাইনটা দেখে এসে  পিঁপড়ের লাইন কিংবা খোর খব্বিশের লাইন – তবুও ফতেমা বিবি এ লাইনে এসে কাকের ময়ূর হবার তীব্র বাসনার কৃত্রিম পুচ্ছের মতো এসে ভিড়ে৷ তারপর ভীড় ভেঙে যায় যোহর অক্তে, সেই সকাল দশটার দিক থেকে এসে তার লাভটা কী হল!  যে কাজে ফতেমা বিবি লাইন ধরেছিল পরে সে জানতে পারে জাগ্রণী ব্যাংক বটতলাহাট শাখার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে মেম্বার তাকে এই ব্যাংকে আসতেই বা বলল কেন? 
এসব ঘটনার উত্তর না পেয়ে এবার ফতেমা বিবি সোজা মুঞ্জুর মেম্বারের বাড়ি চলে যায়, সে তাকে ভাই ডেকে বলে – ‘ভাই ছ’মাস থেকে ঘুরছি, এটার একটা বিধি করো। ‘  মুঞ্জুর মেম্বার তার গলা হাংড়ে কথা বের করে বলল, জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি আর তোমার হাতের বুড়া আঙুলের ছাপ লাগবে। ফতেমা বিবি বলে ভাই জি হাতের আঙুলের ছাপ যে হবে না, তারপর সে তার দুহাত বের করে তার সামনে ধরে। এই দ্যাখো দু হাতের বুড়া আঙুল জন্ম থেকেই নাই। তাই ভোটের আইডি কার্ডও হয়নি। মুঞ্জুর মেম্বার এবার ফতেমা বিবির দিকে দুনিয়ার বিরক্তি বিষ এনে ঢেলে বলল, কি ভোটের আইডি কার্ড নাই! তোমার ভোট নাই! কী লাভ অ্যাঁ –  তাহলে জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি করারও দরকার নেই।
বয়স্কভাতার কার্ড হবেনা, যাও।
মেম্বারের কথা শুনে মুষড়ে পড়ে সে এবং  বিমর্ষ হয়ে ফতেমা বিবি বলে আমার টাকা?
তিনহাজার মাত্র! মুঞ্জুরের থুথুতে এসব সংখ্যা আসার প্রশ্নই ওঠেনা একজন ন’হাজার টাকা দিয়ে গুম মেরে বসে আছে আসলে সে একজন বোবা কালা মানুষ, তার থুথু মুঞ্জুর মেম্বারের থুথুর কাছে পাত্তা পাবেনা। গুম মেরে বসে থাকা পুরুষটির জিব্বা এ কদিনে শুকিয়ে এসেছে সে ঘন ঘন পানি খেয়েও থুথু ফেরাতে পারছেনা আর সেই মহান দয়ালুর থুথু যদি জায়গা মতো পড়ে তাহলে ন’হাজারের মতো কত সংখ্যা নাই হয়ে যাবে তা প্রেত থুথুদের আত্মা জানে।
ফতেমা বিবি বঞ্চিত হল জন্মসুত্রে পাওয়া ফ্রি আঙুল থেকে, কিন্তু পৃথিবীর সেরা পোকার কাতারে সে হয়ে গেল খুঁত পোকা, তার দুটি বুড়া আঙুল না থাকার জন্য রাষ্ট্রের নিয়ম তাকে তাচ্ছিল্য করল। তবে তাচ্ছিল্যের এই খেলায় সে তার জন্মকে প্রশ্ন করে বসল এবং আঙুলহীন জীবনের কি মানে সেটাও জিজ্ঞাসার জন্য তার হৃদয়, মগজে ঢুকে ঢিপঢিপ করে বাজতে থাকল – ক্ষুধার চেয়ে কি মৃত্যু শ্রেয় ?
দেরী হয়নি তেমন, মুঞ্জুর মেম্বারের কানে জাগ্রণী ব্যাংকের উধাও হয়ে যাওয়ার খবরটা এসে পৌঁছায় –
হায়রে মুঞ্জুর মেম্বার, কেন যে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখল না, সে ভাবে যা টাকা তা কি মাটির ছোট কয়েকটা ব্যাংকে আটতো! সে জন্যই তো জাগ্রণীতে রাখা। মেম্বার পরিকল্পনা করতে থাকে মাটির ব্যাংকের এবং বাড়ির পেছনটা কল্পনায় খনন করে তারপর সে দ্যাখে মাটির ব্যাংকটি অবিকল আকারে কবরের ন্যায় খনন করা হয়ে গেছে। মুঞ্জুর মেম্বার কল্পনার মধ্যেই স্বপ্নজালে জড়িয়ে পড়ে এবং ভাবতে আরম্ভ করে যে সে মারা গেছে, তার লাশ ধুয়ে – কাফনে বাড়ির আঙিনাতে খাটলিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাদ জোহর মাটি। সবাই দাফনকাজ সেরে গোরস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারে তার বুকের উপর থেকে সব মাটি সরে যাচ্ছে, যত বাতাস লাগছে তত। তখনো কোন ফেরেস্তা আসেনি তার কবরে। সে ভয় পেয়ে যায়। এমনি করে মুঞ্জুর মেম্বার বুঝতে পারে আসলে তাকে মাটি দিয়ে নয় টাকা চাপা দিয়ে গেছে,  যে টাকা গুলো বয়স্ক ভাতা আর প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিবে বলে সংখ্যাহীন মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিল। তার কাফন সেই টাকায় কেনা বিধায় কাফনের কাপড় টাকার মতো টুকরো হয়ে বাতাসে ভেসে যেতে থাকল। সে ভয়ে কাকড়ি মাকড়ি হয়ে বলে ইয়াল্লা আমি তো সম্পূর্ণ উলংগ হয়ে পড়লাম। তারপর একটা বেড়াল জাতীয় প্রাণী তার কবরে নেমে যেতেই সে চিৎকার দিয়ে উঠে। আর মুঞ্জুর মেম্বারের কল্পিত ঘুম ভেংগে যায়।
তারপর?
‘জাগ্রণী ব্যাংক বটতলাহাট শাখা’- উধাও হওয়ার সমস্ত নিঃসঙ্গতা কাটাতে মিউনিসিপ্যালিটির কতিপয় কাক টা-কা..টা-কা..টা-কা শব্দে হস্তমৈথুন শুরু করে…

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop