ফেরদৌস হাসান – এক ব্যতিক্রমী নাট্যকার ও কথাশিল্পী

By Published On: February 27, 2022

আমি যে টেবিলে বসে এখন এই লেখাটা লিখছি সেই টেবিলের সাথে ছোট্ট একটা বুকশেলফ আছে। বুকশেলফে আমার নিজের লেখা কয়েকটি বইয়ের পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের ছড়া-কবিতাগ্রন্থ, প্রবন্ধ, গল্প আর উপন্যাস সাজানো রয়েছে। তার মধ্যে সগর্বে উঁকি মারছে দুটো বই। দুটোই উপন্যাস। একটার নাম – চাঁদের গায়ে চাঁদ। যার লেখক এ সময়ের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার ফেরদৌস হাসান। চাঁদের গায়ে চাঁদ প্রকাশ পেয়েছে একুশে বইমেলা ২০২০ এ। প্রকাশক – জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। আর একটি বই ঠিক তার বাম পাশে দেখা যাচ্ছে। নাম – পা। বলা বাহুল্য এই উপন্যাসটিরও লেখক ফেরদৌস হাসান, যেটা প্রকাশ পেয়েছে ২০২১ এ। পা – এর প্রকাশক বাংলাদেশ রাইটার্স গিল্ড।

ফেরদৌস হাসান রানা। আমাদের ছাত্রজীবনের বন্ধ’। সেই আশির দশকের বন্ধু। রাজশাহী বিশ^দ্যিালয়ে আমরা যখন আমতলা জামতলা, প্যারিস রোড, শহীদ মিনার চত্বর, ক্যাফেটেরিয়া, আবু কিংবা জয়নালের ক্যান্টিনে ধুমসে আড্ডা মারতাম, চায়ের কাপে ঝড় তুলতাম তখন রানাকে দেখতাম আসু, হারান, ঝিল, চন্দন, চাঘতাই, মতি, মন্টু এদের সাথে ঘুরছে। সব কটাই মার্কামারা চেহারা তখন ক্যাম্পাসে। রানা ছিলো ওদের লিডার। আমাদের দেখে দূর হতে হাত নাড়তো। বুঝতাম, ওর মাথার মধ্যে নিশ্চয় কোনো শয়তানি বুদ্ধি ঘুরছে। ওটাই ছিলো ওর প্রধান কাজ। ক্যাম্পাসে তখন এক নামে সবাই ওকে চিনতো। ছেলেরা যেমন চিনতো, চিনতো মেয়েরাও। বিশেষত মেয়েরা ওকে দেখলে একটু সরে দাঁড়াতো। বলা যায় না, দুম করে কাকে কখন কী বলে বসে। আমরা ওর কান্ড দেখে হাসতাম। শুধু ক্যাম্পাস না, শহরেও তার দাপাদাপি ছিলো সমানে। ঘুরে বেড়াতো এখানে ওখানে। তাকে মূলত: চিনতাম এক নম্বরের আড্ডাবাজ হিসেবে।

এই রানা-ই আচম্বিতে এক কাজ করে আমাদের সবাইকে চমকে দিলো। তখন আশির দশক। সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। অস্থিরতা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাস্পাসগুলোতেও। উত্তপ্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর সব ক্যাম্পাস। উত্তপ্ত আমাদের রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের মতিহার ক্যাম্পাসও। মিছিলের পর মিছিল। মিটিংয়ের পর মিটিং। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার। স্বের শাসনের পতন চাই। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ঝড় চারিদিকে। ক্যাম্পাসের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ভীষণ সোচ্চার। কবিতা-গান- নাটক যেদিকেই তাকাই সবাই মাঠে নেমে পড়েছে। আমি লিখতাম ছড়া। শিশুতোষ ছড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ছড়া। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেই প্রতিবাদী ছড়া পড়তাম। তালির পর তালি। সবাই উপভোগ করতো সেই ছড়া। আমাদেও সাহিত্য সংগঠন ছিলো রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদ। এছাড়াও সেসময় ছিলো কবিতা সংগঠন – শব্দায়ন। ছিলো লেখক শিবির। ছিলো সংস্কৃতি সংসদ। ছিলো নাট্য সংগঠন সমকাল নাট্য চক্র, অনুশীলন ৭৯, রুডা প্রমুখ।

তখন সারাদেশে একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি। বিকেল ৩টায় টিভির কার্যক্রম শুরু হতো। শেষ হতো রাত ১১টায়। টিভিতে আমরা খবর শুনতাম, সিনেমা দেখতাম, গান শুনতাম, বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখতাম। এখনকার মতো তখন বাড়িতে বাড়িতে টিভি ছিলো না। বিশ^বিদ্যালয় হলে টিভি ছিলো। ছিলো পাড়ার ক্লাবে। সরকারী অনুদানের টিভি। টিভির সামনে সবসময় ভীড় লেগেই থাকতো। আর ভীড় ছিলো বলেই বেশ মজা লাগতো। সবাই মিলে একসাথে বসে হই হই করে টিভি প্রোগ্রামগুলো দেখতাম। তখন বিটিভির সবচেয়ে প্রিয় অনুষ্ঠান ছিলো নাটক। এ সপ্তাহের নাটক। এ মাসের নাটক। ধারাবাহিক নাটক। ঈদের নাটক। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো হুমায়ূন আহমেদের নাটক। সেসময় বিটিভির নাটক মানেই এলাহি কারবার। বাঘা বাঘা অভিনেতা -অভিনেত্রী। বাঘা বাঘা নাট্যকার। অভিনয় করতেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফেরদৌসি মজুমদার, মামনুর রশীদ, হুমায়ন ফরিদী, পিযুষ বন্দোপাধ্যায়, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আলী যাকের, খায়রুল আলম সবুজ, আফজাল হোসেস, সুবর্ণা মুস্তাফা, সারা যাকের, তারানা হালিম, তারিন, রিচি সোলায়মান, শান্তা ইসলাম, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তৌকির আহমেদ প্রমুখ। এদের অভিনয় দেখার জন্য আমরা টিভির সামনে চাতকের মত বসে থাকতাম। নাটক প্রচারের সময় রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতো। কি দুর্দান্ত অভিনয়। নাট্যকাররাও ছিলেন তেমন-ই। হুমায়ুন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, সেলিম আল দীন, মামনুর রশীদ, আতিকুল হক চৌধুরী এমন আরো অনেকে। হঠাৎ একদিন দেখতে পেলাম সম্পূর্ণ নতুন একজনের নাম। অচেনা এক নাট্যকারের নাটক। নাটকের নাম – ঝিনুক নীরবে সহো। নাট্যকার আখতার ফেরদৌস রানা। সেদিন ১৯৮১ সালের ১১ জুলাই। কে এই আখতার ফেরদৌস রানা? আমরা তো এই নামে একজনকেই চিনি। আমাদের বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া বন্ধু রানা। একই নামে আর একজন আবির্ভুত হয়নি তো? এমন তো হতেই পারে। বন্ধুদের খোঁজ লাগাতে বলরাম। নিজেই খোঁজ লাগালাম। জানতে পারলাম – না, এ আমাদের সেই রান্-াই। দুর্দান্ত নাটক ছিলো ঝিনুক নীরবে সহো। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। সে সময়ের বাঘা বাঘা নাট্যকারদের সাথে পাল্লা দিয়েই রানা লিখেছিলো সেই নাটকটি। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও ছিলো সবাই পরিচিত মুখ। এর কয়েক মাস পরেই এলো তার দ্বিতীয় নাটক -কালপুরুষ। কালপুরুষও ছিলো দেখার মতো নাটক। এর পর পর এলো ঝুমকা, রাজ্যে ফেরা, তেমনই আছি এই নটকগুলো। এলো ধারাবাহিক নাটক – ফেরা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো সে বছর বিটিভিতে বছরের সেরা নাটক হিসাবে নির্বাচিত হলো – ঝুমকা। নবীন নাট্যকারের সে এক দারুণ স্বীকৃতি। এপর আর আখতার ফেরদৌস রানাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। সামনে এগিয়ে গেছে সে তার নিজস্ব গতিতে। এগিয়ে গেছে আখতার ফেরদৌস রানা থেকে ফেরদৌস হাসান নামে।

ইউটিউবে ফেরদৌস হাসানের নাটক – লিখে সার্চ দিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। অবাক হয়ে গেলাম। একটার পর একটা নাটক আসছে। একটার পর একটা। প্রথমে এলো – চোখের আলোয়। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান ও মাহফুজ আহমেদ। ২০০০ সালের নাটক। এরপর এলো – প্রথম দেখা। তানভিন সুইটি, লিটু আনাম, অপি করিম অভিনীত। এটি ২০০৫ সালের নাটক। তারপর অন্তরে বৈরাগীর লাউ। সেখানে আছেন জাহিদ হাসান, রিচি সোলায়মান, আবুল হায়াত। এরপর এলো – নক্ষত্র দিনের গল্প। আছেন শমী কায়সার, তৌকির আহমেদ। এরপর – অন্য তেপান্তর। এই নাটকে আছেন জাহিদ হাসান, মৌ, হুমায়ন ফরিদী। এরপর সুখের বন্দরে, বীরপুরুষ বশীকরণ, বোকা মানুষ, চাঁদ পোকা ঘুন পোকা, চশমা, থাকে শুধু ভালোবাসা, জীবন যেমনসহ অনেক অনেক নাটক। কোনোটা পুর্ণাঙ্গ নাটক, কোনোটা ধারাবাহিক, কোনোটা টেলিফিল্ম। জেনেছি এখন পর্যন্ত ফেরদৌস হাসানের সব ধরনের নাটকের সংখ্যা হিসেব করলে পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ভাবা যায়? একজন নাট্যকার নাটকের পেছনে কতটা শ্রম দিলে এতগুলো নাটক রচনা করা সম্ভব। শুধু রচনা নয়। বেশির ভাগ নাটকেই ফেরদৌস হাসান নিজেই পরিচালক। রাত জেগে জেগে নাটক লিখেছেন। সেই নাটক যখন শুটিং হয় নিজে উপস্থিত থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। নাটক পরিচালনা করেছেন। ফেরদৌস হাসানের বহু নাটকে বিভিন্ন দৃশ্যে গান সংযোজন করেছেন তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই গানের গীতিকার তিনি নিজে। সুরকারও তিনি। সেসব গানে কন্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, সুবীর নন্দী, এ্যান্ডু কিশোর, কনকচাঁপার মত শিল্পীরা।


এ্যান্ডু কিশোরের সাথে ফেরদৌস হাসানের সম্পর্ক ছিলো অন্যরকম। একাধারে বন্ধু অন্যদিকে বড়ভাই- ছোটভাই। আর তাইতো ফেরদৌস হাসানের ডাক পেলে সব কাজ ফেলে ছুটে আসতেন এ্যান্ডু কিশোর। শুধু ঢাকা নয়, নিজেদের শহর, প্রাণের শহর রাজশাহীতেও এসে নাটকে বহু গানের কন্ঠ দিয়েছেন এ্যান্ডু কিশোর। এ প্রসঙ্গে একজনের কথা না বললেই না। সে হচ্ছে মাকসুমুল হুদা বাড্ডু। রাজশাহী নগরীর গ্রেটার রোডে বাড্ডুর মিউজিক স্টুডিও। স্টুডিওর নাম – স্টুডিও হারমনি মিউজিক। এটা একটা মিউজিক কমপ্লেক্সের মতো। এখানে আছে মিউজিক কম্পোজিশন স্টুডিও, আছে বাদ্যযন্ত্রের শপিং সেন্টার- মিউজিকেয়ার। রাজশাহীতে এলে এখানেই বেশিরভাগ সময় কাটে ফেরদৌস হাসানের। রাজশাহী এলে এখানে নিয়মিত আসতেন প্রয়াত কন্ঠশিল্পী এ্যান্ডু কিশোর। এসেছেন বিশিষ্ট সুরকার আজাদ রহমান। রাজশাহীর শিল্পসংস্কৃতির মানুষের নিয়মিত আসা-যাওয়া এখানে। এখানে মাঝে মাঝে আসেন আর একজন সাহিত্য-শিল্পপ্রেমী রাজনীতিবিদ। তিনি রাজশাহীর নগরপিতা, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ, এইচ, এম খায়রুজ্জামান লিটন। কথাপ্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়, জনাব খায়রুজ্জামান লিটন ফেরদৌস হাসানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে।

আমাদের সেই ছাত্রজীবনে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হতো উত্তর জনপদের একমাত্র উল্লেখযোগ্য পত্রিকা দৈনিক বার্তা। সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী। পরে এলেন কামাল লোহানী। দৈনিক বার্তাতে নিয়মিত খবরের পাশাপাশি প্রতিদিন বের হতো একটা করে বিশেষ পাতা। সেই পাতাতে থাকতো বিশেষ আয়োজন। রোববারে প্রকাশিত হতো সাহিত্য পাতা। শুক্রবারে ছোটদের পাতা কিশোর কুঁড়ির মেলা। বুহস্পতিবারে বিনোদন পাতা – মন মহুয়া। সাহিত্যের পাতার দায়িত্বে ছিলেন ওয়াজেদ মাহমুদ। বাছাই করা লেখা ছাপতেন সাহিত্য পাতায়। তবে তরুনদের ভালো লেখা পেলে যত্ন করে ছাপতেন। ফেরদৌস হাসান সাহিত্য পাতাতে গল্প লিখতো নিয়মিত। কিন্তু কোনো সাহিত্যের অনুষ্ঠানে তাকে পাওয়া যেতো না। কোনো সাহিত্য সংগঠনের সাথেও যুক্ত ছিলো না সে। পরবর্তেিত গল্প থেকে উপন্যাস লেখায় মনোযোগ দেয় ফেরদৌস হাসান। তার লেখা প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস – পা। পা পরবর্তীতে ২০২১ সালে পুন:প্রকাশ হয়েছে। এর পর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস- তার কিছু স্বপ্ন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয় – বুকের কাছে জল, কে জেগে আছো, বনবালিকার গান, ভালোবাসি, কিছু দূরে নদী, এক শালিকে দুঃখ, তোমার নীল খাম, এখানে তোমার আকাশ সহ প্রায় পঞ্চাশটির মতো উপন্যাস।

ফেরদৌস হাসান রাানার সাথে মাঝখানে অনেকদিন আমার যোগাযোগ ছিলো না। আমি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় চাকুরি নিয়ে রাজশাহীর বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যাই। আর কমিশনড অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় রানা। তবে চাকুরীতে যোগদান করলেও নাটক লেখালেখি অব্যাহত ছিলো তার। ওর নাটক টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে দেখতাম। খুব ভালো লাগতো। গর্বিত মনে হতো নিজেকে। পরবর্তীতে অনেক বছর পর হঠাৎ একদিন ওর কথা শুনলাম নাজাতের কাছে। আমাদের প্রয়াত বন্ধু বিশিষ্ট ছড়াকার সৈয়দ নাজাত হোসেন। রানা ছিলো নাজাতের খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু। নাজাত ছিলো আমারও খুব কাছের বন্ধুদের একজন। বিটিভির সাথে নাজাতেরও সম্পর্ক বহুদিনের। বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ততা ছিলো তার। নাটকও লিখতো। সেই সুত্রে নাজাতের সাথে রানার গভীর বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছিলো। লিভারসিরোসিসে আক্রান্ত নাজাতের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই বন্ধুত্ব অটুট ছিলো। চাকুরীজীবন থেকে অবসর নেবার পর কাওরানবাজারে নিজস্ব একটা অফিস নেয় ফেরদৌস হাসান। সেখানে একসময় নিয়মিত যেতো সৈয়দ নাজাত হোসেন। আমাকে ডাকতো নাজাত সাথে যাবার জন্য। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যাওয়া হয়ে উঠতো না। এরপর হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেলো ঢাকাস্থ রাজশাহী সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। দেখি, সেই আগের মতোই আসর জমিয়ে বসে আছে সবার মাঝখানে। সাথে ছিলো আমাদের আরো কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু । ছিলো বন্ধু মাসুম ওয়াদুদ, শাহ মাসুদুর রহমান বকুল, সানোয়ার মনি, আমিনুর রহমান বাচ্চু, মুস্তাগিসুর রহমান বাবু, শামিম রাব্বানী নিরো, মইদুল ইসলাম, শফিকুল আলম শফিক প্রমুখ। আমিও জমে গেলাম সেই আড্ডায়। এরপর থেকে তৈরী হয় আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ। নিয়মিত আড্ডা। কখনো কাওরানবাজারে রানার অফিসে, কখনো জিপিওতে শফিকের রুমে। কখনো ধানমন্ডি ২৭ এর সাম্পানে, আবার কখনো মাসুমের পশ্চিম ধানমন্ডির বাসায়। কখনো বইমেলাতে। সেই আড্ডা এখনো চলমান রয়েছে।

একুশের বইমেলা নিয়ে ফেরদৌস হাসানের প্রচন্ড আগ্রহ। সারাবছর একটানা লেখালেখি না করলেও বইমেলার আগে দিনরাত লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে। প্রতি বছর বইমেলাতে প্রকাশিত হয় তার ২/৩টি উপন্যাস। বইমেলা প্রাঙ্গণ তার প্রিয় একটি স্থান। ফেব্রুয়ারীর পুরোটাই বইমেলায় কাটায় সে। আমরা বন্ধুরা নিয়মিত বইমেলায় না গেলে হৈ চৈ বাধিয়ে দেয়। যদিও আমি নিজেও লেখালেখি করি, আমার বইও প্রতি বছর বইমেলায় আসে কিন্তু রানার মতো এত সময় বইমেলায় দেয়া হয় না আমার। বইমেলাতে রানার জীবনসঙ্গীনি আমাদের প্রিয় ভাবী জিনিয়া ফেরদৌস রুনারও উজ্জ্বল উপস্থিতি- যা আমাদের ভালো লাগে। রুনা ভাবী নিজেও একজন অভিনেত্রী, বাচিকশিল্পী এবং কবি।

অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ফেরদৌস হাসান কোন মাধ্যমে বেশি শক্তিশালী? টিভির পর্দায় নাকি তার বইয়ে? তার নাটকে নাকি তার উপন্যাসে? নাটক রচনায় না নাটক পরিচালনায়? গান রচনায় না সুরকার হিসেবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। যদিও নাট্যকার হিসেবে তার পরিচিতি সবচেয়ে বেশি কিন্তু অন্যান্য মাধ্যমেও তার প্রতিভা অনস্বীকার্য। যেখানেই হাত রেখেছেন তিনি সেখানেই তার ব্যতিক্রমী সৃষ্টিকর্মের ছাপ রেখেছেন। তার প্রধান কারণ তার বিস্তর পড়াশোনা। ব্যক্তি ও কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাও তার সৃষ্টিকর্মে ানেক অবদান রেখেছে। চাকুরিসুত্রে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রচুর ঘুরেছেন তিনি। তার মেধা, নিষ্ঠা, শ্রম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ছাপ রয়েছে তার নাটকে, তার উপন্যাসে। তার একান্ত কিছু নিজস্বতা আছে যা অন্য লেখকদের সাথে ঠিক মেলে না। উপস্থাপনাও তাই কিছুটা ভিন্ন।। প্রতি বছর বইমেলায় তার উপন্যাস নিয়মিত প্রকাশিত হয়, যা তার পাঠকেরা খুব ভালো করেই জানেন। একইভাবে টিভির পর্দায় সমানভাবে প্রচারিত হচ্ছে নিত্য নতুন নাটক।

তার নাটকের যেমন আলাদা কিছু বৈশিষ্ঠ্য আছে ঠিক একইভাবে তার লেখা উপন্যাসেরও আলাদা কিছু ভাষা আছে, আছে আলাদা কিছু প্রকাশভঙ্গী। তার বন বালিকার গান, পা, মায়া, চাঁদের গায়ে চাঁদ, ভালোবাসি, কিছু দূরে নদী, এক শালিকে দুঃখ, তোমার নীল খাম, এখানে তোমার আকাশ ইত্যাদি উপন্যাসের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। ২০২১ এর বইমেলায় প্রকাশিত তার উপন্যাস – কে জেগে আছো পাঠ করলে তার স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কাজল- যে চমৎকারভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে পুরো উপন্যাসটি। ফেরদৌস হাসানের সাথে কাজল নামটির কী যোগসাজস রয়েছে আমার ঠিক জানা নেই, কোনোদিন জিজ্ঞেসও করা হয়নি। তবে তার প্রচুর নাটক ও উপন্যাসে এই নামের চরিত্রের সাথে আমাদের বহুবার পরিচয় ঘটেছে। তার অনেকগুলো নাটকে কাজল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকির আহমেদ। কে জেগে আছো উপন্যাসটির কাজল চরিত্র পড়তে গিয়েও আমার চোখের সামনে কেনো জানি বার বার ভেসে উঠেছে কাজল নয়, ভেসে উঠেছে তৌকির আহমেদের মুখ। কে জেগে আছো উপন্যাসের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। নব্বই দশকের ঠিক সেই সময় যখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের শেষের দিক। অবশ্য কাহিনী এর পরের সময়েও কিছুটা চলমান ছিলো। কাহিনীতে রয়েছে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, রয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতি, রয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী পুলিশ অফিসার ও তার কন্যা বীথির কথা। পাশাপাশি আছে প্রত্নতাত্বিক ঐতিহ্যের অন্যতম চিহ্ন পুঠিয়ার জমিদারবাড়ি, আছে আড়তদার, আছে পুরোহিত কন্যাসহ অনেক কিছু। আছে দেশপ্রেম, আছে সততা, আছে ব্যর্থ বিপ্লব। আছে বিবেক, আছে নীতিবোধ। আছে গ্রাম। গ্রামের অড়হর ক্ষেত। আছে বড়াল ব্রীজ। আর আছে প্রেম। কাজল আর বীথির অদ্ভুত প্রেম যার প্রকাশ অনেক পরে ঘটেছে। সব মিলিয়ে এটি একটি চমৎকার কোলাজচিত্র যা ব্যতিক্রমী। আর একটি উপন্যাস বন বালিকার গান – পড়েছি একটানে। বন বালিকার গানে আছে সুন্দর গতিময়তা, আছে বিশেষ বার্তা, যা এই সময়ের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অবহেলিত বাউলদের সামাজিক অবস্থান চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে বন্ধু ফেরদৌস হাসান। আছে রাজধানী ঢাকার কর্পোরেট কালচারের চিত্র। আছে অপু, শায়লা, কুমি এদের কথা। ভালোলাগার মত চমৎকার এক উপন্যাস। কিছু দূরে নদী- ফেরদৌস হাসান রানার একটি অসাধারণ উপন্যাস। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠার উপায় নাই। এই জাদুকরী লেখনশৈলী ফেরদৌস হাসানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তা আগেই জানি। এই গল্পের নায়ক অরুণের জীবনে পরীর আগমন আন্দোলিত করে মনকে! সেইসাথে ইকবাল, গণি, ড. হারুনদের বুদ্ধিজীবী ভালোমানুষি মুখোশের আড়ালে ধাপ্পাবাজী, মিডিয়ার চামচামি, নারী শরীরের নগ্ন লালসা মনকে প্রচন্ড নাড়া দেয় এবং ক্ষিপ্ত করে তোলে। এর বিপরীতে হাজার লোভের হাতছানিকে অগ্রাহ্য করা অরুণ, ডাক্তার সদরুল, রশিদ স্যারের সততা আশা জাগায়। সর্বোপরি উপন্যাসটি পড়তে পড়তে তা আর গল্প থাকে না, হয়ে ওঠে এ সমাজের এ সময়ের দূর্দান্ত দলিল।

ফেরদৌস হাসান রানার মতো একজন বন্ধুবৎসল, হাসিখুশি ও প্রতিভাবান লেখকবন্ধু আমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। বন্ধুদের যে কোনো সমস্যায় তাৎক্ষনিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো এমন মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আমাদের আড্ডা তাকে ছাড়া জমে না। এই বাষট্টি বছর বয়সেও রানার মনের মধ্যে বাস করে এক দুরন্ত কিশোর। আবার মাঝে মাঝে তাকে মনে হয় পঁচিশ বছরের সাহসী ও অপ্রতিরোধ্য এক যুবক। আর তাইতো রানা না থাকলে আমাদের আড্ডা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। লেখালেখির জগতে তার যেমন উজ্জ্বল অবস্থান, ঠিক তেমন-ই উজ্জ্বল অবস্থান বন্ধুদের কাছেও। প্রার্থনা করি আগামী দিনেও এমনভাবেই টিকে থাকুক তার সৃষ্টিকর্ম। টিকে থাকুক তার নাটক অগনিত দর্শকের মনের গহীনে। টিকে থাকুক তার সকল উপন্যাস তার প্রিয় পাঠকের কাছে। সেইসাথে লেগে থাকুক তার ভালোবাসার স্পর্শ আমাদের মতো বন্ধুদের কাছেও।

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop