মিউনিসিপ্যালিটির কতিপয় কাক – আব্দুল আজিজ

By Published On: May 10, 2021

বটতলাহাট জাগ্রণী ব্যাংক উধাও – সকাল সকাল হাট করতে আসা মানুষজন এই শিরোনামে খবরটা শুনে চমকিত হয় এবং তা  প্রচারের শেষ দিকে দুই ভ্যান পুলিশ আর রাজ মিস্ত্রিদের একটা দল সেই স্থানে এসে দাঁড়ায়। হলুদ টাই পরা সাংবাদিকদের দঙ্গলের চাপে সাধারণ মানুষ ছিটকে দূরে সরে আছে এবং পুলিশের নির্দেশে খনন কাজ শুরু হয়েছে। কোদাল শাবল চলছে, যে স্থানে এতদিন দোতলা ব্যাংকটি দাঁড়িয়ে ছিল, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নড়ে বসাতেই সাধারণ হাট করতে আসা মানুষেরা এই মাটি কোপাকুপি দেখছে।
একবেলা হয়ে গেছে নাহ, কোন ইট রডের স্তুপের হদিস মিলছেনা, যতদূর খোড়া হয়েছে তাতে আবার বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করা যাবে। 
মানুষ কাকের জাত, কাক যেমন কা-কা ক’রে ময়লা মুখে নিয়ে উড়ে যায়, তেমনি মানুষ এই কাহিনি মুখে ক’রে বয়ে নিয়ে চলে যেতে লাগল নিজ বাড়ি অথবা মহল্লা কিংবা গ্রামের দিকে। যারা চলে যাচ্ছিল তারা যাওয়ার কারণ দেখাল এই বলে যে, আজ সে খচ্চা বা খুচরা মাছ কিনেছে তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি না গেলে ব্যাগে থাকা মাছ মরে যেতে পারে। মছলিখোর মানুষেরা ভীড় ভাঙলে গুজবখোর মানুষেরা এসে জোটে।
গত পরশু তখনো জাগ্রণী ব্যাংক উধাও হয়নি। মঞ্জুর মেম্বারের কথায় ফতেমা বিবি আসে এই ব্যাংকে। তার গায়ের কাপড়টির রং জাগ্রণী ব্যাংক বটতলাহাট শাখার সাইনবোর্ডের লোগোতে থাকা ফ্যাকাসে সবুজ রংটির মতো, ফতেমা বিবি কখনো দাঁড়ায় কখনো বসে, গলা উঁচিয়ে লাইনটা দেখে এসে  পিঁপড়ের লাইন কিংবা খোর খব্বিশের লাইন – তবুও ফতেমা বিবি এ লাইনে এসে কাকের ময়ূর হবার তীব্র বাসনার কৃত্রিম পুচ্ছের মতো এসে ভিড়ে৷ তারপর ভীড় ভেঙে যায় যোহর অক্তে, সেই সকাল দশটার দিক থেকে এসে তার লাভটা কী হল!  যে কাজে ফতেমা বিবি লাইন ধরেছিল পরে সে জানতে পারে জাগ্রণী ব্যাংক বটতলাহাট শাখার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে মেম্বার তাকে এই ব্যাংকে আসতেই বা বলল কেন? 
এসব ঘটনার উত্তর না পেয়ে এবার ফতেমা বিবি সোজা মুঞ্জুর মেম্বারের বাড়ি চলে যায়, সে তাকে ভাই ডেকে বলে – ‘ভাই ছ’মাস থেকে ঘুরছি, এটার একটা বিধি করো। ‘  মুঞ্জুর মেম্বার তার গলা হাংড়ে কথা বের করে বলল, জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি আর তোমার হাতের বুড়া আঙুলের ছাপ লাগবে। ফতেমা বিবি বলে ভাই জি হাতের আঙুলের ছাপ যে হবে না, তারপর সে তার দুহাত বের করে তার সামনে ধরে। এই দ্যাখো দু হাতের বুড়া আঙুল জন্ম থেকেই নাই। তাই ভোটের আইডি কার্ডও হয়নি। মুঞ্জুর মেম্বার এবার ফতেমা বিবির দিকে দুনিয়ার বিরক্তি বিষ এনে ঢেলে বলল, কি ভোটের আইডি কার্ড নাই! তোমার ভোট নাই! কী লাভ অ্যাঁ –  তাহলে জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি করারও দরকার নেই।
বয়স্কভাতার কার্ড হবেনা, যাও।
মেম্বারের কথা শুনে মুষড়ে পড়ে সে এবং  বিমর্ষ হয়ে ফতেমা বিবি বলে আমার টাকা?
তিনহাজার মাত্র! মুঞ্জুরের থুথুতে এসব সংখ্যা আসার প্রশ্নই ওঠেনা একজন ন’হাজার টাকা দিয়ে গুম মেরে বসে আছে আসলে সে একজন বোবা কালা মানুষ, তার থুথু মুঞ্জুর মেম্বারের থুথুর কাছে পাত্তা পাবেনা। গুম মেরে বসে থাকা পুরুষটির জিব্বা এ কদিনে শুকিয়ে এসেছে সে ঘন ঘন পানি খেয়েও থুথু ফেরাতে পারছেনা আর সেই মহান দয়ালুর থুথু যদি জায়গা মতো পড়ে তাহলে ন’হাজারের মতো কত সংখ্যা নাই হয়ে যাবে তা প্রেত থুথুদের আত্মা জানে।
ফতেমা বিবি বঞ্চিত হল জন্মসুত্রে পাওয়া ফ্রি আঙুল থেকে, কিন্তু পৃথিবীর সেরা পোকার কাতারে সে হয়ে গেল খুঁত পোকা, তার দুটি বুড়া আঙুল না থাকার জন্য রাষ্ট্রের নিয়ম তাকে তাচ্ছিল্য করল। তবে তাচ্ছিল্যের এই খেলায় সে তার জন্মকে প্রশ্ন করে বসল এবং আঙুলহীন জীবনের কি মানে সেটাও জিজ্ঞাসার জন্য তার হৃদয়, মগজে ঢুকে ঢিপঢিপ করে বাজতে থাকল – ক্ষুধার চেয়ে কি মৃত্যু শ্রেয় ?
দেরী হয়নি তেমন, মুঞ্জুর মেম্বারের কানে জাগ্রণী ব্যাংকের উধাও হয়ে যাওয়ার খবরটা এসে পৌঁছায় –
হায়রে মুঞ্জুর মেম্বার, কেন যে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখল না, সে ভাবে যা টাকা তা কি মাটির ছোট কয়েকটা ব্যাংকে আটতো! সে জন্যই তো জাগ্রণীতে রাখা। মেম্বার পরিকল্পনা করতে থাকে মাটির ব্যাংকের এবং বাড়ির পেছনটা কল্পনায় খনন করে তারপর সে দ্যাখে মাটির ব্যাংকটি অবিকল আকারে কবরের ন্যায় খনন করা হয়ে গেছে। মুঞ্জুর মেম্বার কল্পনার মধ্যেই স্বপ্নজালে জড়িয়ে পড়ে এবং ভাবতে আরম্ভ করে যে সে মারা গেছে, তার লাশ ধুয়ে – কাফনে বাড়ির আঙিনাতে খাটলিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাদ জোহর মাটি। সবাই দাফনকাজ সেরে গোরস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারে তার বুকের উপর থেকে সব মাটি সরে যাচ্ছে, যত বাতাস লাগছে তত। তখনো কোন ফেরেস্তা আসেনি তার কবরে। সে ভয় পেয়ে যায়। এমনি করে মুঞ্জুর মেম্বার বুঝতে পারে আসলে তাকে মাটি দিয়ে নয় টাকা চাপা দিয়ে গেছে,  যে টাকা গুলো বয়স্ক ভাতা আর প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিবে বলে সংখ্যাহীন মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিল। তার কাফন সেই টাকায় কেনা বিধায় কাফনের কাপড় টাকার মতো টুকরো হয়ে বাতাসে ভেসে যেতে থাকল। সে ভয়ে কাকড়ি মাকড়ি হয়ে বলে ইয়াল্লা আমি তো সম্পূর্ণ উলংগ হয়ে পড়লাম। তারপর একটা বেড়াল জাতীয় প্রাণী তার কবরে নেমে যেতেই সে চিৎকার দিয়ে উঠে। আর মুঞ্জুর মেম্বারের কল্পিত ঘুম ভেংগে যায়।
তারপর?
‘জাগ্রণী ব্যাংক বটতলাহাট শাখা’- উধাও হওয়ার সমস্ত নিঃসঙ্গতা কাটাতে মিউনিসিপ্যালিটির কতিপয় কাক টা-কা..টা-কা..টা-কা শব্দে হস্তমৈথুন শুরু করে…

Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop