নজরুল পরিচালিত রবীন্দ্রসংগীতও আটকে দিয়েছিল বিশ্বভারতী

By Published On: May 27, 2021
বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীতের দায়িত্ব সামলাবেন বলে তখন ময়দানে নেমে পড়েছেন নজরুল ইসলাম। গান রচনা এবং সঙ্গীত পরিচালনা দুইয়েরই ভার তাঁর ওপর। ‘ধ্রুব’ সবাক চিত্রের হাত ধরে প্রথম কাজ শুরু। ম্যাডান কোম্পানির প্রোপারাইটার গ্রামজি সাহেব তাঁর সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন মাসিক ৫০০ টাকার। সঙ্গীত পরিচালনার সঙ্গে জুড়ল আরো একটা আজব অনুরোধ— নারদ চরিত্রে কবিকে অভিনয়ও করতে হবে। সে অনুরোধ রাখলেন নজরুল। অশীতিপর বৃদ্ধ মুনির পরিবর্তে বাঙালি দর্শক প্রথমবার দেখলেন একজন যুবক নারদকে। ‘ধ্রুব’-র গানগুলি জনপ্রিয়তা পেল ভালোই। কিন্তু, অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ খানিক প্রতারিত হলেন নজরুল। এই কোম্পানির সঙ্গে আর কাজ করেননি।
ইতিমধ্যে নজরুলের হাতে এল শৈলজানন্দের ‘পাতালপুরি’-র কাজ। তারপর একে একে মুক্তি, সাপুড়ে, বিদ্যাপতি-র মতো সিনেমা। ‘মুক্তি’ সিনেমায় অবশ্য সংগীতের সামগ্রিক দায়িত্ব সামলাননি নজরুল। রবীন্দ্রকাহিনীর বাইরে এটাই প্রথম চলচ্চিত্র যেখানে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই রবীন্দ্রসংগীতগুলি গেয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং কানন দেবী।
এরপরই দেবদত্ত ফিল্মস ‘গোরা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব নিল। সংগীত পরিচালনায় নজরুল ইসলাম। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীতগুলি তোলাবার এবং আয়োজনের দায়িত্বে বাংলার আরেক বিখ্যাত কবি। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যাকে বলে মাহেন্দ্রক্ষণ।
মহানন্দে গান তোলালেন নজরুল। নিজের ছাপও বুনে দিলেন সেইসব রবীন্দ্রসংগীতে। তখন রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করতে গেলে বা কোনো ফিল্মে ব্যবহার করতে গেলে আগে ‘বিশ্বভারতী’-র সংগীত বিভাগীয় বোর্ড থেকে অনুমতি নিতে হত। কিন্তু ‘গোরা’-র গানগুলি রেকর্ডের সময় নজরুল কোনো অনুমতি নেননি। তাঁর সহজ বিশ্বাস ছিল, যেখানে তিনি স্বয়ং সংগীত পরিচালক সেখানে বিশ্বভারতী নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি করবে না। অতএব, হইহই করেই গান তোলার কাজ শেষ হল। ফিল্মের জন্য গান রেকর্ডও হল।
বিপত্তি ঘটল ছবিমুক্তির দিন দুয়েক আগে। সেদিন ছবির ‘ট্রেড শো’। বিশ্বভারতী থেকেও পর্যবেক্ষক হাজির সেখানে। নজরুলের পরিচালনায় গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতগুলিতে নানা খুঁত খুঁজে পেলেন তিনি। ব্যাস, অনুমতি মিলল না। ছবির মুক্তিও বন্ধ হয়ে গেল। প্রযোজক পড়লেন ভীষণ বিপদে। নজরুল ইসলামের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কিংবা খামখেয়ালিপনার জন্য তাঁর না টাকা ডুবে যায়। অনেকটা বিনিয়োগ হয়েছে এই ফিল্মে।
ধাক্কা খেলেন নজরুলও। তাঁর শেখানো গানও যে বিশ্বভারতী নাকচ করবে, ভাবেননি। ঠিক করলেন এর বিহিত দেখেই ছাড়বেন। ‘গোরা’ ফিল্মটির একটা কপি, একটি ছোটো প্রোজেকশন মেশিন সঙ্গে নিয়ে তিনি দ্রুত রওনা দিলেন শান্তিনিকেতন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করতে। সঙ্গে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন দেবদত্ত ফিল্মস-এর প্রোপারাইটার মানু গাঙ্গুলিকেও।
নজরুলের আকস্মিক আগমনে যুগপৎ বিস্মিত এবং আনন্দিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। খবরাখবর নিলেন তাঁর, কিছুদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধও করলেন। লোভনীয় প্রস্তাব, কিন্তু নজরুল তো এসেছেন বিশেষ কাজে। সেই কাজ সেরে দ্রুত ফিরতেও হবে কলকাতায়। নাহলে ‘গোরা’-র মুক্তিই আটকে যাবে। অতএব, আসল কথাটা পাড়লেন দ্রুতই। এই বিপদ থেকে যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই তাঁদের রক্ষা করতে পারেন, সেই কথাও বললেন স্পষ্ট করে।
সবটা শুনে বিশ্বভারতীর কাজে বেশ অসন্তুষ্ট হলেন রবীন্দ্রনাথ। “কী কাণ্ড বল তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন্‌ আক্কেলে তার দোষ ধরে…? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে! আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?” রবীন্দ্রনাথের কথায় বুক থেকে পাথর নেমে গেল নজরুলের। রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, লিখিত অনুমতি না পেলে ঘোষিত তারিখে ছবির মুক্তি আটকে যাবে। সঙ্গে করে তাই ছবি আর প্রোজেক্টর নিয়েই এসেছেন তাঁরা। অনুরোধ, রবীন্দ্রনাথ যদি একটিবার ছবিটি দেখে অনুমতিপত্রে সই করে দেন।
ফের অসন্তুষ্ট হলেন রবীন্দ্রনাথ। এবার অবশ্য স্নেহবশত। “ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও কীসে সই করতে হবে।” এরপর, নজরুলের হাত থেকে আগেভাগেই লিখে রাখা সেই অনুমতিপত্রটি নিয়ে তাতে সই করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। অনুজের কাজ তাঁর নিজস্ব সুরারোপ থেকে কতখানি বিচ্যুত হয়েছে তা তদন্ত করে দেখার প্রয়োজনই বোধ করলেন না। নজরুলের প্রতি এতটাই গভীর আস্থা তাঁর।
‘গোরা’ মুক্তি পেল নির্দিষ্ট দিনেই। ‘গোরা’-য় ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীতগুলি শুনে রবীন্দ্রনাথ খুব আহত বা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, এমন প্রমাণ অন্তত আমাদের হাতে নেই।
 
সূত্র : নজরুলের স্মৃতি, নিতাই ঘটক।
বাংলা গান অদীন ভুবন, সম্পাদনা সুধীর চক্রবর্তী।
Share:
0 0 votes
Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Nandik Shop